×

মুক্তচিন্তা

অবিনশ্বর চেতনার নাম বিজয়

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:১৯ পিএম

শব্দে-চিত্রে-গানে আমাদের যে বিজয়গাথা তার প্রতিটি রেণুতে মিশে আছে শেখ মুজিবের প্রাণ। বিজয় দিবস ও শেখ মুজিব তাই এক অভিন্ন সত্তা।

সবাই মিলে একটি অনুভ‚তিতে, একই আবেগে, একই লক্ষ্যে শোরগোল তুলে যে কবিতার কোরাস তাকেই বলি জয় বা বিজয়ের উল্লাস। স্বাধীনতার পাশে বিজয় শব্দটি কিছুটা হালকা ও কোমল হলেও ‘জ’ বর্ণটির কারণে শব্দটি উজ্জ্বলতা ধরে মুক্তার মতো। স্বাধীনতা যদি হয় মুক্তি, বিজয় হয়ে যায় উড্ডীনতার প্রতীক, আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রতীক, উৎসবের প্রতীক। বিজয় মানে জিতে নেয়া, জিতে যাওয়া। কাউকে বা অনেককেই পরাজিত করে জয়ের উদ্গীত। স্বাধীনতা পেলে অনেকে পরাধীন হতে ভালোবাসে (নির্মলেন্দু গুণ) কিন্তু জয়ী হলে কেউ আর পরাজিত হতে চায় না।

জয় বা বিজয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে গর্ব, শ্রেষ্ঠের অভিধা, বীরত্বের অভিজ্ঞান। জয় বললেই মনে পড়ে আলেকজান্ডারের কথা, সিজারের কথা, মার্ক অ্যান্টনির কথা, খালিদ বিন ওয়ালিদ, চেঙ্গিস, নাদির, হালাকু খানের কথা বা কোনো জাতির সম্মিলিত জয়ের কথা। বাঙালির বিজয় দিবস তেমনই এক জয়গাথা। জয় কেড়ে বা ছিনিয়ে নিতে হয় কাউকে না কাউকে পরাজিত করে। বিষয়টা খুব চ্যালেঞ্জিং। ‘বিজিগীষা’ থেকে জয়ের উৎসারণ। যে বিজিগীষা থেকে ১৯৭১ সালে সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজাতীয় পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছিল প্রোজ্জ্বল প্রয়াসে। প্রায় অর্ধশত বছর বাঙালি সেই জয়-পতাকা সমুন্নত রয়েছে শত সংকটে, সংহরণে। সেই যে জয়ের শিখরচ‚ড়া আমরা ছুঁয়েছিলাম তা এখন স্বর্ণ শিখার প্রাঙ্গণ হয়ে দ্যুতি ছড়ায় সূর্যকরোজ্জ্বল।

নয় মাসের ব্যবধানে একটি দেশে একই ধরনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস উদযাপিত হয়- ‘স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস।’ এমনটি পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই, এও এক নতুন ইতিহাস। ’৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ২৬ মার্চ তাঁরই ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই দিবস থেকে ৮ মাস ২০ দিন পর তারই নির্দেশে এ দেশের আপামর জনসাধারণ এক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের পরাজিত করে অর্জন করে এক মহান বিজয়। সেই থেকে ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে নিতে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে ৩০ লাখ মানুষকে, ২ লাখ মা-বোনকে হতে হয়েছে ধর্ষিত ও লাঞ্ছিত। ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল সহস্র কোটি টাকার সম্পদ, পোড়ামাটিতে পরিণত হয়েছিল সারাদেশ। বোমা বর্ষণে শুধু মানুষ নয়, পালিয়েছিল দেশের পশু-পাখি পর্যন্ত। রক্তগঙ্গা বয়েছিল রাজপথ, জনপদ, প্রান্তর, নদীনালায়- এমন বীভৎস দৃশ্য কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গেই তুলনীয়। এ যেন এলিয়টের এক দ্বিতীয় ডধংঃব খধহফ কিংবা বিষ্ণুদের ‘স্মৃতি-সত্তা ভবিষ্যৎ’ কাব্যের আর্ত নাট্যনাদ। এই বিজয় আনতে আমাদের কোটি মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়েছে ভারতে, যারা যাপন করেছি এক মানবেতর জীবন। সে দিন মায়ের বুকে দুধ ছিল না, শিশু কেঁদেছিল ওদনের তরে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চোখে জল ছিল না, পরনের কাপড় ছিল না শরীরে, বাস ছিল পচা জলে, ফুটপাতে, রেললাইনে। ডাল-চাল রাঁধা ভাত আর পায়খানায় সে দিন কোনো ভেদ ছিল না। আর যারা দেশের ভেতরে ছিলেন তারা প্রতি মুহূর্তে ছিল আতঙ্কে, মৃত্যুর পদধ্বনির মধ্যে। তবু তারা যুদ্ধে ছিল নিরত। তাদের বুকে ছিল শেখ মুজিবের বিশাল বুক, চোখে ছিল শেখ মুজিবের স্বপ্ন, আর হাতে ছিল শেখ মুজিবের উদ্ধত হাত, আর কণ্ঠে ছিল শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এর অবিনাশী বাণী। যুদ্ধটা যেন শেখ মুজিবের জন্য। মূলত তাঁরই অদৃশ্য সরব উপস্থিতিতে সংঘটিত হয় মহা বিজয়ের যুদ্ধ। আমাদের বিজয় পতাকা, বিজয় সঙ্গীতে তাঁরই প্রতিকৃতি আঁকা উজ্জ্বলতায়।

একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই সেই নেতা ও বীর বালার্ক যিনি এক দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন বাঙালির স্বপ্ন। তাইতো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্থপতি এবং কালান্তরের ইতিহাস। আব্রাহাম লিংকন থেকে লেনিন, গান্ধী, জিন্নাহ, মাও সে তুংয়ের মতো বিশ্ববরেণ্য নেতাদের এত কৃতী কি কারো ভাগ্যে জুটেছে? ইতিহাসে সেই অনন্য সাধারণ কৃতিত্বের একমাত্র বরমাল্য পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর নেতৃত্ব, বীরত্ব আপসহীনতা, মানবিক গুণ, আদর্শ-নিষ্ঠা, দেশপ্রেম এবং নীতিতে অটল থাকার যে ক্যারিশমা তাই তাঁকে করেছে রাজনীতির কবি, মুক্তির মহাকবি। আমাদের বিজয় পথের সামনে ছিল কালাপাহাড় সদৃশ শেখ মুজিবের মূর্তি। তিনিই ছিলেন বাঙালির মুক্তির প্রেরণা, সংগ্রামের প্রেষণা আর জয় করে ভয় ঘোচানোর প্রোৎসাহক। তাইতো সে দিন ঘরে ঘরে, যুদ্ধের মাঠে সোৎসাহে ধ্বনিত হতো- ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’। গানের মতো কবিতায়ও সে দিন শেখ মুজিবই ছিলেন মুক্তির প্রেরণা- ‘মুজিবুর রহমান/ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারী বান’ (জসীমউদ্দীন), কিংবা ‘তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়/আমরা বাঙালি মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়’ (জসীমউদ্দীন)। এরপর আর অন্য কোনো উদাহরণের প্রয়োজন নেই যে, শেখ মুজিবের নামের প্রেরণায়ই রচিত হয়েছিল আমাদের বিজয়গাথা। মুজিবই ছিলেন মুক্তিকামী প্রতিটি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন, সংগ্রামের হাতিয়ার, সাহসের সমাচার, ঝড়, তুফানের কাণ্ডারি। আমাদের মহান বিজয়ের প্রতিটি ধাপে স্পন্দনমান তাঁর জীবন, তাঁর সংগ্রাম, তাঁর বজ্রকণ্ঠ।

বাংলাদেশের মহান বিজয় দেখার যাদের সৌভাগ্য হয়েছে কেবল তারাই অনুভব করতে পেরেছিলেন এ বিজয় কত বড়, কত মহৎ, কত আনন্দের, কত স্ফ‚র্তির, কত না সুখানুভ‚তির। সে দিনের সেই বিজয়ের কাছে, জুলিয়াস সিজারের বিজয়, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের জয়ও ছিল তুচ্ছ। সে দিনের সূর্যালোক ছিল অন্যরকম- যত আগুনঝরা তত সবুজ ও সোনালি, নীলিমা ছিল যত নীল তারচেয়ে সাগর সুনীল, বৃক্ষেরা ডানা মেলেছিল আকাশে আকাশে, পাখিরা গান ধরেছিল- ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল/জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে/রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল (কথা : গোবিন্দ হালদার, সুর : সমর দাস)। সে দিন না ফোটা ফুলগুলোও ফুটতে শুরু করেছিল। আপন প্রণোদনায়, হিমেল হাওয়ায় পাপড়ি থেকে উড়ে যাচ্ছিল মিষ্টি সুরভি, নদী থেকে উৎসারিত হচ্ছিল- ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না/আমি গাইব/গাইব বিজয়ের গান’। সে দিন তারাও ফুটেছিল ত্রিদিবে যেন লাখো মুজিবের চোখ। সবাই জেন বন্দনায় মুখর ছিল শেখ মুজিবের মহাসত্ত্বে। রবীন্দ্র সুরে ধ্বনিত হয়েছিল ‘আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার’ সে তো সবার প্রিয় মুজিব ভাইয়ের। নদী, পাখি, ফুল, বৃক্ষ, মানুষ- সবাই বলছিল আমিই মুজিব, আমিই বঙ্গবন্ধু। কারণ বিজয় মানেই মুজিবের বিজয়, বিজয় মানেই তাঁর বাংলাদেশ হৃদয়।

আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বাঙ্ময় দিন বিজয় দিবস। যে দিবসটির জন্য আমাদের প্রতীক্ষা ছিল হাজার বছরের। কত না রক্তগঙ্গা পেরিয়ে এই দিবসের স্বর্ণপ্রাঙ্গণে আমাদের অধিবাস। সেই হিরন্ময় দিনে পৌঁছানোর শেষ মুহূর্তেও আমাদের হারাতে হয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর সকালেও পাকিস্তানি নরপিশাচরা কেড়ে নিয়েছিল কত না প্রাণ, গুলিবিদ্ধ হয়েছিল কত না উৎসবেমাতা মানুষ। তাদের অন্তিম চেষ্টা ছিল এই দিনটি যাতে বাঙালির জীবনে বারবার ফিরে আসে। বাঙালি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে দুপুরের মধ্যেই সম্পন্ন করে ঐতিহাসিক বিজয়। চির অবসান ঘটে পাকিস্তানি বর্বর শাসনের। গুলি ছোটে, বিউগলে বেজে ওঠে, কোটি কণ্ঠে ধ্বনিত হয় জয় বাংলার অ্যাটম বোমা। এমন দিনে শুধু বলা যায়, প্রিয় বাংলাদেশ তুমি আমার, আমার প্রেয়সীর চেয়ে তুমি আমার প্রিয়, তোমাকে পাওয়ার জন্যই কত বিনিন্দ্র রজনী, কত অভুক্ত দিনরাত, কত অজানা পথ পাড়ি দেয়া, পিতামাতার স্নেহ-মমতা ছিন্ন করা, লেখাপড়া জলাতুলি দেয়া, ধন-সম্পদ পরিত্যাগ করা। আর এসব ত্যাগ স্বীকার করার মূলে ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক, যা প্রাণে ধারণ করে বাঙালি বীরবিক্রমে পৌঁছেছিল ১৬ ডিসেম্বরের দ্বারপ্রান্তে। তিনি আজ না ফেরার দেশে তবু বলা, ‘মৃত্যু কেবল জীবনেই সম্ভব/মৃত্যু জাগায় মৃত্যুঞ্জয়ের গান’। শব্দে-চিত্রে-গানে আমাদের যে বিজয়গাথা তার প্রতিটি রেণুতে মিশে আছে শেখ মুজিবের প্রাণ। বিজয় দিবস ও শেখ মুজিব তাই এক অভিন্ন সত্তা। বিজয়ের মহাপ্লাবনে ভেসে স্মরণে রক্তাক্ত হওয়া- হে বিজয় তুমি অবিনাশী হও, স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যৎ হও। বিজয়ের মহাকাব্য হোক বাঙালির সার্বিক মুক্তির বাতিঘর।

গাজী আজিজুর রহমান : অধ্যাপক ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App