×

মুক্তচিন্তা

তাঁরা চরণে দলে গেছে মরণ শঙ্কারে

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:০৩ পিএম

একটি অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-সমৃদ্ধ দেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীরা। আমরা তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে আছি কি না- সে জিজ্ঞাসা সারাক্ষণ আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। যারা চরণে দলে গেছে মরণ শঙ্কা, তাদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমরা নিঃশঙ্ক হওয়ার প্রেরণাই পেয়ে থাকি। এখনই যারা নানা উপায়ে আমাদের ভয় দেখিয়ে পিছু হঠাতে চায়, তাদের উদ্দেশে আমাদের বলতেই হবে- ভয়ের টুঁটি ধরব টিপে, করব তারে জয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

প্রতি বছরই ১৪ ডিসেম্বর আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে থাকি। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যই ১৯৭২ সাল থেকেই সরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর হামলে পড়ার সময় থেকেই শুরু হয়েছিল নির্বিচারে বাঙালি নিধন-পর্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও খ্যাতিমান দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ অনেককে প্রথম রাতেই পাকিস্তানি বর্বররা হত্যা করেছিল। বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে ওরা জয়ী হতে চেয়েছিল। কিন্তু নিরস্ত্র বাঙালি জীবন দিয়েই জীবনের জয়গান গেয়ে রক্তমূল্যে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মদানকারী শহীদদের একসঙ্গে স্মরণ না করে বুদ্ধিজীবীদের জন্য আলাদা একটি দিবস পালন করা কেন?

এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে আমরা একটু বুঝে নেই কাদের আমরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করি। সাধারণভাবে তাদেরই বুদ্ধিজীবী হিসেবে ধরা হয়, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। কারা তারা? লেখক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, চিত্রশিল্পী, নাট্যকর্মী- এ রকম পেশাজীবীদেরই মূলত বুদ্ধিজীবী ধরা হয়। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে সব শ্রেণি-পেশার মানুষেরই ব্যাপক ও স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত একটি জনযুদ্ধ। তাই পাকিস্তানিরা গণহারেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করা খুব সাধারণ ঘটনা নয়। এই ৩০ লাখের মধ্যে যাদের আমরা বুদ্ধিজীবী বলছি তাদের সংখ্যা কত ছিল? কতজন বুদ্ধিজীবী মুক্তির মন্দির সোপান তলে প্রাণ বলিদান করেছেন তার সঠিক তথ্য কেউই দিতে পারবেন বলে মনে হয় না।

অসম্পূর্ণ যেসব হিসাব পাওয়া যায় তা থেকে দেখা যায় একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৩৭ জন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, ২৭০ জন মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক-প্রকৌশলীও হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রকৃত অনুসন্ধানে এই সংখ্যাটি আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এই সংখ্যাটি ৩০ লাখের তুলনায় সামান্য। তারপরও কেন আলাদাভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস? একটি জাতির মানস গঠনে মূল ভ‚মিকা পালন করে থাকেন বুদ্ধিজীবীরাই। মেধা ও মননে যারা অগ্রগামী তারাই পথ রচনা করেন, পথ দেখান। বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের দেখানো পথ অনুসরণ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রামের সফল পরিণতি। তবুও এর পেছনে বুদ্ধিজীবীদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানুষের চেতনার জগতে পরিবর্তন এনেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ না চালালে কি মানুষ অত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারত যে ‘ওদের’ সঙ্গে আমাদের এক হয়ে থাকা সম্ভব নয়! বুদ্ধিজীবীরা সলতে পাকিয়েছেন আর রাজনীতিবিদরা সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর কাজটি সম্পন্ন করেছেন।

বুদ্ধিজীবীরা তাই জাতির মানসিক শক্তির ভিত। একটি জাতিকে হীনবল করার জন্য বড় উপায় হলো তার মেধাশক্তিকে ধ্বংস করে দেয়া। পাকিস্তানি বাহিনী তাই একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি বেছে বেছে দেশের মেধাবী সন্তান বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করেছে। বিশেষ করে তারা যখন বুঝতে পারে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেও তারা বাংলাদেশে পরাজয় এড়াতে পারছে না, তখন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বুদ্ধিজীবী নিধনপর্ব শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যাতে মেধাহীন একটি পঙ্গু জাতিতে পরিণত হয় সেটাই তারা করতে চেয়েছে বাছাই করে গণতন্ত্রমনস্ক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এ কাজে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে কিছু কুলাঙ্গার বাঙালি।

এটা ঠিক যে, এ দেশীয় দালালদের সমর্থন-সহযোগিতা না পেলে পাকিস্তানিদের পক্ষে এত বুদ্ধিজীবী হত্যা করা সম্ভব হতো না। বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানিদের পরাজয় যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়, সম্মুখ সমরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীকে মেকাবেলা করতে যখন তারা ব্যর্থ হচ্ছিল, তখনই তারা রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দিয়ে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় বরেণ্য সব ব্যক্তিকে।

ধারণা করা হয়, ১৪ ডিসেম্বরেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন বধ্যভ‚মিতে লাশ ফেলে দেয়া হয়। তাই এই দিনটিকে প্রতীকী হিসেবে গ্রহণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। নয় মাসজুড়ে যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে তাদের সবার প্রতি বাঙালি জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটা একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র নয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমরা আসলে শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথও নিয়ে থাকি। বিপদে আমরা যে হতবিহ্বল না হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও যে রাখি- সেটা এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে স্মরণ করি এবং সাহসী হয়ে উঠি।

যারা বুদ্ধিজীবী হত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ছিল, যারা মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করেছিল, অনেক বিলম্বে হলেও তাদের কয়েকজনকে আমরা বিচারের সম্মুখীন করতে পেরেছি। কয়েকজনের শাস্তি কার্যকর করে আমরা জাতি হিসেবে কলঙ্কমুক্ত হয়েছি। তবে এটাও ঠিক যে, ওই দুরাত্মারা এখনো আমাদের সমাজে আছে। একাত্তরের ঘাতকদের, তাদের অনুসারীদের আমরা সম্পূর্ণ পরাভ‚ত করতে পারিনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা এখনো মরিয়া। এখনো তারা পাকিস্তানি ধারায় দেশের গতিমুখ পরিবর্তনে সক্রিয়। সুযোগ পেলেই তারা তাদের গোপন অস্ত্র বের করছে। মরণ কামড় হানছে।

১৪ ডিসেম্বর কোনোভাবেই গোপন অশ্রু বিসর্জনের দিন নয়। কারণ এর মাত্র একদিন পরই আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন। বিজয় দিবস। একটি হারানোর শোক, অন্যদিকে পাওয়ার উল্লাস- আমাদের উদ্বেলিত করে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর বেদনা বুকে চেপে আমরা আমাদের দৃষ্টিকে সমানে প্রসারিত করব। একটি অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-সমৃদ্ধ দেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীরা। আমরা তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে আছি কি না- সে জিজ্ঞাসা সারাক্ষণ আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। যারা চরণে দলে গেছে মরণ শঙ্কা, তাদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমরা নিঃশঙ্ক হওয়ার প্রেরণাই পেয়ে থাকি। এখনই যারা নানা উপায়ে আমাদের ভয় দেখিয়ে পিছু হঠাতে চায়, তাদের উদ্দেশে আমাদের বলতেই হবে- ভয়ের টুঁটি ধরব টিপে, করব তারে জয়।

নিঃশেষে যারা প্রাণ দান করে তাদের যে ক্ষয় নেই সেটা প্রমাণ হবে তখনই, যখন পরাজিত শক্তির কাছে আমরা পরাভব মানব না। মাথা উঁচু করে মর্যাদাবান জাতি হিসেবে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা শহীদ বুদ্ধিজীবীরা সব সময় আমাদের জুগিয়ে যাবেন। আর এভাবেই তারা আমাদের মধ্যে না থেকেও থাকবেন অনন্তকাল।

বিভুরঞ্জন সরকার : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App