×

মুক্তচিন্তা

১৯৭১’র বিজয় দিবসের বাংলাদেশ ফেরত চাই

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:৩০ পিএম

বাংলাদেশকে বেঁচে থাকতে হবে বিজয় দিবসের চেতনায়। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, ৭ কোটি বাঙালির সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং সর্বোপরি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে স্মরণ না করলে স্বাধীনতা, বিজয় দিবস অর্থহীন। তাই ৪৭তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, ১৯৭১’র বিজয় দিবসের ‘বাংলাদেশ’ ফেরত চাই।

পরদেশ

বিজয়ের মাসে সবাইকে বিজয়ের শুভেচ্ছা। এই মহান মাসে হাইকোর্ট ‘জয়বাংলা’ কেন জাতীয় স্লোগান হবে না বলে যে রুলিং দিয়েছেন তা যথার্থ। ‘জয়বাংলা’ হোক জাতীয় স্লোগান। জয়বাংলা গগনবিদারী স্লোগানের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত এবং বিজয় অর্জিত হয়েছিল। এই স্লোগানই পারে বাঙালিকে আবার একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ করতে। এই স্লোগান হানাদার পাকিস্তানিদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিত। যারা এই স্লোগানের বিরোধী হয়তো এই স্লোগান আজো তাদের বুকে কাঁপন ধরায়? জয়বাংলা একটি খাঁটি বাংলা শব্দ। ‘জয়’ শব্দটি যাদের পছন্দ নয়, তারা মূলত সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের পছন্দ ‘জিন্দাবাদ’। তারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদের’ মতো ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলতে পছন্দ করেন এবং ওনারা ‘জয়বাংলা’র সঙ্গে ‘জয়হিন্দ’র সম্পর্ক খুঁজে বেড়ান। এই গোষ্ঠীই স্বাধীনতার পর স্লোগান তুলেছিল, ‘জয়বাংলা জয়হিন্দ লুঙ্গি ছাইড়া ধুতি পিন্দ’। এসবই ভারতবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির অপকর্ম। এরা অবশ্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। যাই হোক, আদালত পারেন ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি প্রতিষ্ঠিত করতে।

অর্ধেক ঢাকার মেয়র আনিসুল হক মারা গেছেন, তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তাকে জানতাম না, চিনতাম না, তবে তাকে ভদ্রলোক মনে হয়েছে। মানুষ তাকে পছন্দ করে, একজন মেয়রের জন্য এটাই বড় পাওনা। অনেকদিন পর ঢাকার দুই অর্ধেকে দুজন মেয়র হয়েছেন, যারা ‘হোমরাচোমড়া’ নন, সাধারণ ভদ্রলোক। অন্য মেয়রকেও চিনি না, তবে তার বাবাকে দেখেছি। এই দুজনের আগে আমার ঢাকা থাকাকালীন (১৯৭২-১৯৯০) যত মেয়র দেখেছি, সবাই ছিলেন ‘হোমড়াচোমড়া’, যেমন মেয়র হাসনাত বা মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান। শেষের জনের নামে তো ঢাকায় বিশাল বিশাল পোস্টার পড়েছিল, ‘মাহমুদুল হাসানের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’। নেপথ্যে অবশ্য সবাই বলতেন, ‘থিফ অব বাগদাদ’। অভিযোগ থাকলেও ঢাকাবাসী মনে হয় তাদের দুই মেয়র নিয়ে মোটামুটি খুশি। মেয়র আনিস নেই, ঢাকা থাকলে তাকে শেষ দেখা দেখতে যেতাম। বেগম জিয়া যাননি। কাজটি ঠিক হয়নি। মাসুদা ভাট্টির সঙ্গে আমি একমত তিনি যেতে পারতেন। জাতীয় নেতানেত্রীদের কাছ থেকে জাতি আর একটু ‘উদারতা’ আশা করে। ২ ডিসেম্বর ছিল পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২০ বছর। চুক্তিটি পুরো বাস্তবায়ন হয়নি। আদৌ কোনোদিন হবে কিনা এর কোনো গ্যারান্টি নেই। রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সমঝোতা স্মারক বা এক ধরনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন যদি বার্মা এই চুক্তি না মানে তাহলে আমরা ওদের কী বলব, বা কী করব? তবে প্রফেসর জাফর ইকবাল চমৎকার বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের বুক পেতে গ্রহণ করেছি, হিন্দুদের বুক আগলে রক্ষা করবো না’? স্বীকার করি বা না করি, রোহিঙ্গারা মুসলমান, তাই ওদের জন্য আমাদের ভালোবাসা উথলে পড়ছে। পাহাড়িরা অমুসলমান তাই ওদের জন্য আমাদের ভালোবাসার একটু ঘাটতি আছে। ভালোবাসা নাকি জাতপাত-ধর্ম মানে না, মনে হয় আমাদের ভালোবাসায়ও খাদ আছে। শাকিব-অপু ভালোবাসায় কোনো ক্ষতি নেই, উল্টোটা হলে রক্ষে নেই? এর মধ্যে মহামান্য পোপ বাংলাদেশে এসে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র এক বিরাট সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন। আমরা খুশি। প্রশ্ন হলো, আমাদের সম্প্রীতি প্রমাণে অন্যদের সার্টিফিকেট লাগে কেন? ৩ ডিসেম্বর ছিল ক্ষুদিরামের জন্মদিন। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’- বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ওপর এই গান এখন আর খুব একটা শোনা যায় না। কেউ ক্ষুদিরামকে নিয়ে সভা-সমিতি করে না, কলাম লেখে না। সূর্যসেন, ক্ষুদিরামরা এ দেশে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে পাবনায় সুচিত্রা সেনের বাড়িটি জনগণের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে।

খবরে প্রকাশ, ৫৭ ধারা উঠে যাচ্ছে। তথ্যমন্ত্রী তাই বলছেন। অবশ্য ৫৭ ধারা থাকলে বা না থাকলেই কি? রাষ্ট্র যদি অত্যাচারী হয়, তখন কোনো ধারা লাগে না? পার্থ’র সময় ৫৭ ধারা ছিল না! মনে পড়ে শৈবাল সাহা পার্থ’র কথা? এই সেই পার্থ, বিএনপি আমলে ই-মেইলে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগে যাকে গ্রেপ্তার, অকথ্য নির্যাতন, দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয়েছিল। অমানুষিক নির্যাতন করা হয় পার্থকে। অনেকটা ‘জজ মিয়া’ নাটকের মতো? পরে প্রমাণ হলো, পার্থ নির্দোষ। উত্তম দাস, রসরাজ বা রাকেশ, সবাই জেল খেটেছেন, মাইর খেয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়েছেন এবং তা বিনাদোষে? টিটোর ঘটনাও তাই। টিটো এখনো জেলে, বিজয় দিবস কি নিরপরাধ টিটোর জন্য নয়?

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ঠিক পূর্বক্ষণে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান ও এর দোসররা বাংলাদেশেকে মেধাশূন্য করার জন্য বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। এ জন্য আমরা এদিনটি ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকি। ১১৯৩ সালে ঠিক একই কারণে নালন্দা ইউনিভার্সিটির ৯০ লাখ বই পুড়িয়ে দিয়েছিলেন বখতিয়ার খিলজি। এত বছর পর একজন কমিউনিস্ট শিক্ষামন্ত্রীর হাত দিয়ে পাঠ্যপুস্তক জিহাদিকরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে আবার মেধাশূন্য করার প্রচেষ্টা হচ্ছে না তো? শরণার্থী রোহিঙ্গাদের জন্য অতিমাত্রায় প্রেম, নাসিরনগর, রংপুরে উদাসীনতা অথবা ‘সিলেকটিভ মানবতা’ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা কি ভেবেছেন? শিক্ষার মানের দৈন্যতা এবং সিলেকটিভ মানবতা বাংলাদেশের জন্য শুভ নয়।

জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাস্তবায়ন, জয়বাংলা স্লোগান, জাতীয় চার মূলনীতি এবং ১৯৭১ সালের বিজয় দিবসের চেতনায়ই কেবল বাংলাদেশ চিরজীবী হতে পারে। পাকিস্তানের ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পেয়ে আর একটি ধর্মান্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল না, বাংলাদেশকে বেঁচে থাকতে হবে বিজয় দিবসের চেতনায়। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, ৭ কোটি বাঙালির সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং সর্বোপরি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে স্মরণ না করলে স্বাধীনতা, বিজয় দিবস অর্থহীন। তাই ৪৭তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, ১৯৭১-এর বিজয় দিবসের ‘বাংলাদেশ’ ফেরত চাই।

নিউইয়র্ক, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭ শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App