×

মুক্তচিন্তা

শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা স্মরণে

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:৩৮ পিএম

যুগবার্তা

কালের পরিক্রমায় আবারো একটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এসে গেল। এ সময়ে বিশেষ করে ভাবনায়, স্মৃতিতে সযতনে, শ্রদ্ধায় চিরস্থায়ী আসন দখল করে থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি মনের মণিকোঠায় জেগে ওঠে। বেদনার্ত বোধ করি বড্ড বেশি বেশি করে এ কারণে যে, তাঁদের এই মহৎ আত্মদানকে আজো আমরা অর্থবহ করে তুলতে পারিনি। তাঁদের মহান আদর্শ আজো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়।

স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে ছোটখাটো শ্রদ্ধেয় যে মুখটি তা হলো পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের রবীন্দ্রভক্ত অধ্যাপক আনোয়ার পাশার। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে থেকে ১৯৫৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে আমি বেরিয়ে আসার কয়েক বছর পরে আনোয়ার পাশা বহরমপুর কলেজ থেকে পদত্যাগ করে এসে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আর আমি তখন চুটিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপের) রাজনীতি করছি। আর আমাদের দৈনন্দিন সান্ধ্য আড্ডা ছিল পাবনার তদানীন্তন বিখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডা. অমলেন্দু দাক্ষীর ডিসপেন্সারি। সেখানে পাবনার সংস্কৃতিসেবী, প্রগতিমনা অন্যরাও এসে ওই প্রগতিশীলদের সান্ধ্যকালীন আড্ডায় শামিল হলেন তাতে। সপ্তাহে দুদিন-তিনদিন করে ওখানে যাতায়াত করলেন, কিছুদিন চিনে-জেনে পরিচিত হয়ে গেলেন সবার সঙ্গে। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। তিনি হয়ে গেলেন আড্ডাটির নিয়মিত একজন সদস্য।

আমরা যখন তাঁর কাব্যিক সাহিত্যিক গুণাবলির সন্ধান পেলাম তখন থেকে তাঁকে অবশ্যই বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানাতাম আমাদেরই সাংস্কৃতিক কাজকর্ম দ্বারা প্রভাবিত অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেবির আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তী, রবীন্দ্র-প্রয়াণ দিবস নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। তিনিও তাতে সোৎসাহে সাড়া দিতেন। অবাক বিস্ময়ে আমরা লক্ষ করলাম, দু-তিনটি অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণের মধ্য দিয়েই অধ্যাপক আনোয়ার পাশা শ্রোতামণ্ডলীর গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করে ফেলেছেন। তাঁর বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ও পণ্ডিত হিসেবে সুনাম ও জনপ্রিয়তা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ল জেলার সর্বত্র। যে ছাত্রছাত্রীরা সরাসরি তাঁর ক্লাস করত, তাঁদের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তা অল্পেই তুঙ্গে উঠে গেল শিক্ষক হিসেবে তাঁর নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা এবং শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের প্রতি বৈষম্যহীন স্নেহ-প্রীতির কারণে। বস্তুত তখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রায় দেড় দশক অতিক্রান্ত হলেও ব্যাপকভাবে হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় যে বিপুল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৬ থেকে শুরু করে তা তখনো পূরণ হয়নি। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সৃষ্ট ভয়াবহ শূন্যতার বেশ খানিকটা পূরণ করলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা তাঁর যোগদানের অল্পদিনের মধ্যেই। আমাদের মনে একটি প্রশ্ন দেখা দিল। এত ভালো একজন শিক্ষক হওয়া সত্তে¡ও মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কলেজের একই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কেন তিনি পাবনার মতো ছোট জেলা শহরের একটি বেসরকারি কলেজে চাকরি করতে এলেন। প্রশ্নটির উত্তর জানতে চাইলে তিনি কি বা মনে করে বসেন এমন একটা দ্বিধাসংকোচ থাকায় বেশ দেরিই হয়ে গেল তাঁকে প্রশ্নটা করতে। কিন্তু মানুষটা তো অত্যন্ত সহজ-সরল এবং সত্যাশ্রয়ী। নির্বিবাদে তিনি প্রশ্নটার উত্তর দিলেন, বহরমপুর কলেজে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হওয়ার আগে তিনি ওই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। ওখান থেকে স্নাতকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। সেখান থেকে মাস্টার্সেও কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। তবে তিনি মাস্টার্সের পর বহরমপুর কলেজ কর্তৃপক্ষের আহ্বানে ওই কলেজেই যোগদান করেন।

ইতোমধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যোগ্য শিক্ষক প্রয়োজন মর্মে দৈনিক আনন্দবাজারের একটি বিজ্ঞাপন তাঁর নজরে আসে। বিজ্ঞাপনটি আদ্যোপান্ত পড়ে দেখলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা যা চেয়েছেন তার সবগুলোই তাঁর আছে। দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন। যথাসময়ে লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা হলো। মাস দুয়েক অপেক্ষা করেও নিয়োগপত্র এল। গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারলেন যে, ওই পদে নিয়োগ দেয়া হয়ে গেছে। খোঁজখবর নিয়ে জানলেন যে, লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা সত্তে¡ও নিয়োগপত্রটি তাঁর কপালে জোটেনি। কেন এমন হলো তা জানার জন্য কৌত‚হলী হয়ে তাঁর একজন সরাসরি শিক্ষককে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলেন। জবাবে তাঁর ওই শিক্ষকটি জানালেন নিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্যতিরেকে বাদবাকি সবাই তাঁকে নিয়োগদানের পক্ষে মত প্রদান করা সত্তে¡ও আনোয়ার পাশা মুসলিম বাবা-মায়ের সন্তান শুধুমাত্র এই অপরাধে ওই চেয়ারম্যান তাকে নিয়োগ না দিয়ে অপরজনকে দিয়েছেন। যাঁকে দিয়েছেন তিনি হিন্দু ঘরের সন্তান। শিক্ষকটি তাঁকে এ নিয়ে মামলা ঠুকে দিতে বললেন আনোয়ার পাশাকে এবং বললেন, এতে নিশ্চিত জয় হবে তাঁর। কিন্তু আনোয়ার পাশা এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, মামলা করার মানসিকতাও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি ফিরে এলেন বহরমপুর কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িকতা সামান্যতম ঠাঁই পাবে এমন বিশ্বাস তিনি কদাপি পোষণ না করায় এবং এ ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িকতামুক্ত এমন দৃঢ় আস্থা এতকাল পোষণ করায় অধ্যাপক আনোয়ার পাশা প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে দীর্ণ হলেন।

যা হোক অতঃপর অল্পকালের মধ্যেই একই সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন দেখলেন সেটিতেও বাংলার অধ্যাপক চাওয়া হয়েছে। মনের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে তিনি দরখাস্ত করেই ফেললেন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবর। অতি অল্পকালের মধ্যেই নিয়োগপত্রও পেয়ে গেলেন ডাকযোগে। এবারে স্থির করলেন, সপরিবারেই দেশত্যাগী হবেন। হলেনও তাই। আনোয়ার পাশা রাজনীতি করতেন না। তবে মনে মনে ছিলেন কংগ্রেসপন্থী। পাকিস্তান ছিল একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সেই সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানেই তিনি চলে এলেন। সপরিবারে বসবাস করতে লাগলেন পাকিস্তানে। সাম্প্রদায়িকতার অনুগামী হয়ে নয় বরং তার ঘোরতর বিরোধী হয়ে। এখানে এসে ওই আড্ডার অংশীদার হয়ে তিনি তাঁর অজান্তেই যেন কিছুটা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপের) সমর্থক বনে গেলেন মনে মনে। বস্তুতই তিনি ছিলেন একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী।

১৯৬৪ সাল। পাবনাতে হঠাৎ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে গেল। কিছুকাল আগে অনুষ্ঠিত মালদহের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে। পাবনার নিরপরাধ হিন্দুরা তার অসহায় শিকার হলেন। ৩১ জন মানুষ আইনজীবী-শিক্ষক-ব্যবসায়ী নির্বিশেষে নির্মমভাবে নিহত হলেন শত শত নর-নারী হলেন আহত, কিছু যুবতী ধর্ষিত, হাজার হাজার বাড়িঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হলো। পাবনার জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ল আতঙ্কে। যে পুলিশ দাঙ্গা প্রতিরোধ করবে, তারাই দিব্যি দাঙ্গাকারীদের বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করল। পথ দেখিয়ে দেয়া থেকে সব কিছু। দাঙ্গার শুরু একেবারেই সন্ধ্যা রাতে কিন্তু তা চলল রাত ৩টা অবধি। ট্রাকে করে এক এলাকা থেকে অপর এলাকায় সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের আনা-নেয়া চলছিল পুলিশের নাকের ডগায়। কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে অপর এক বন্ধুর বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতভর ওই দৃশ্য দেখলাম আর পাকিস্তান নামক বলিহারি মার্কা দেশটিকে বাহবা দিলাম অনেক নিরপরাধ প্রাণ ও সম্পদের বিনিময়ে।

যা হোক পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ তখন বেসরকারি, হিন্দু ছাত্রাবাসের জনা ত্রিশেক ছাত্র খবরটি শুনে মহাআতঙ্কে ছুটে গেল অধ্যক্ষের বাসভবনে। বহুবার কলিং বেল টেপা ও দরজা ধাক্কানোর পর লুঙ্গি পরা অবস্থায় তিনি বেরিয়ে দরজাটা সামান্য ফাঁক করে রাগতস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তোমরা’। ছাত্ররা পরিচয় দিয়ে আতঙ্কের কথা বলে তাদের প্রাণে বাঁচানোর আবেদন জানালে তিন ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, ‘দরকার হলে এসপির কাছে যাও। আমার কিছু করার নেই।’

হতাশ হয়ে ফিরে এল ছাত্ররা। ইতোমধ্যে দেখা গেল একটি রিকশা নিয়ে ছুটে এলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। তিনি ওই আতঙ্কিত ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন তারা কেমন আছে। সব শুনে তিনি নাইট গার্ডকে ডাকলেন। ডেকে টিচার্স কমন রুমটির দরজা খুলে দিতে বললেন। দরজা খুলতেই আনোয়ার পাশা ছাত্রদের ওই কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে নাইট গার্ডকে তালাবদ্ধ করে দিতে বললেন আর ছাত্রদের বললেন, তোমরা ভেতরে চুপচাপ থাকো। কথাবার্তা চিৎকার-চেঁচামেচি কিছুই করবে না। অন্য কেউ ডাকলেও না। আমি বাসায় যাচ্ছি তোমাদের জন্য কিছু খাবার-পানি নিয়ে আসি। এই কথা কটি বলেই তিনি বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ভাত-তরকারি রান্না করতে বললেন।

রান্না শেষ হতেই আনোয়ার পাশা দুটি রিকশা ডেকে খাবার ও এক হাঁড়ি পানি ও কয়েকটি গ্লাস সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন কলেজ ক্যাম্পাসে। নাইট গার্ডকে ডেকে টিচার্স রুমের দরজা খুলিয়ে খারারগুলো ঢুকিয়ে দিতে বললেন পানির হাঁড়ি ও গ্লাসগুলোসহ। ছাত্রদের ওগুলো খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে এবং নাইট গার্ডকে পুনরায় দরজায় তালা লাগাতে বলে সকালে অবস্থা ভালো থাকলে দরজা খুলে দিতে এবং ছাত্রদের তাদের হোস্টেলে ফিরে যেতে বললেন। তবে অবস্থা খারাপ থাকলে এই রুমেই থাকতে বলে তিনি বাসায় চলে গেলেন। যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির দাপটে দেশ ছেড়ে এসেছিলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা সেই হিন্দু ছাত্রদের এভাবেই তিনি বাঁচালেন। কিন্তু ১৯৭১-এ? তখনো তো উগ্র ইসলামপন্থী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো পাকিস্তান রক্ষার নামে লাখ লাখ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অগণিত বাঙালি নিধনে লিপ্ত হলো। নির্মমভাবে তারা হত্যা করল অধ্যাপক আনোয়ার পাশার মতো আরো অনেক বুদ্ধিজীবীকে। অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ৩০ জন হিন্দু ছাত্রকে বাঁচালেন সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত থেকে কিন্তু পারলেন না একই শক্তির হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে মুসলিম মা-বাবার সন্তান হয়েও। অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাই শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশাসহ মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদকে।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App