×

মুক্তচিন্তা

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির চেতনাভিত্তিক একটা সমঝোতা দরকার

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৭:৪৩ পিএম

বিভিন্ন দলে অবস্থানের কারণে মুক্তিযোদ্ধার ভাষায় যে চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তা অনেক ক্ষেত্রে আত্মপ্রবঞ্চনাকারী বহিঃপ্রকাশ। তাই সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সব শক্তির ভেতরে অন্তত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক একটা সমঝোতা। আর এটাই সময়ের দাবি। চেতনার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান যদি সঠিক না হয়, তাহলে সঠিক লক্ষ্য অর্জন করা যাবে কী করে?

সময়ের প্রয়োজনে

মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেই বলতে হয়, সেই চেতনার কথা যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রথমেই কিন্তু সৃষ্টি হয় চেতনার। চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ না হলে আমরা কখনোই যুদ্ধ করতে আগ্রহী হতাম না। স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় সাড়ে চার দশক পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে আজ যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে, তা সত্যিই বিভ্রান্তিকর। কিছুদিন আগে টিভির পর্দায় এক টকশোতে দেখলাম একজন মডারেটর নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামরিক বাহিনী এখনো ধারণ করছে কিনা? প্রশ্নটির প্রকৃতি ঠিক অনুরূপ না হলেও তিনি যা জানতে চেয়েছেন, তার প্রকৃতি-অনুরূপ উত্তরে সামরিক বাহিনীর ওই কর্মকর্তা বললেন, তারা যে দেশপ্রেম ধারণ করে চলেছেন ওইটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আসলে দেশপ্রেম বলতে একেক জনে একেক রকম বোঝেন। দেশের মানুষকে ভালোবাসার কারণে দেশের প্রতি যে মমত্ববোধ ওটাই দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবশ্যই সম্পর্কিত। কিন্তু দেশপ্রেম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাও হতে পারে।

ধরা যাক, একজন আ.লীগ ও একজন বিএনপির কথা; একজন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন অমুক্তিযোদ্ধার কথা। এদের সবারই দেশের প্রতি মমত্ববোধ আছে বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার প্রশ্নে কি এরা এক? বিএনপির জন্মদাতা মেজর জেনারেল জিয়া মুক্তিযুদ্ধ করেননি, এ কথা কেউ বলবে না। অথচ ক্ষমতা দখল করার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যা বোঝায়, তিনি তা একে একে ধ্বংস করে ফেলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যেসব মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা আমাদের সংবিধানে মৌলিক উপাদান হিসেবে সংরক্ষিত ছিল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্র কোনো প্রকার বিতর্কে না জড়িয়ে সংবিধানের এই চার মূল উপাদানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফসল বলে উল্লেখ করা যেতে পারে। ধরে নেয়া যাক, জেনারেল জিয়ার দেশপ্রেম ছিল, দেশের মানুষকেও হয়তো তিনি ভালোবাসতেন ও দেশের মানুষের জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধও করেছেন। আবার সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে তার একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থানও ছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাই ক্ষমতা দখল করে, রাজনৈতিক দল গঠন করে, অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে নিজের অবস্থান সুনির্দিষ্ট করার প্রয়োজনে, এমন কোনো অপরাধ নেই যা তিনি করেননি। তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর, সেই ক্ষমতা তিনি যেভাবে অপব্যবহার করেছেন, তা জনগণের প্রতি দেশপ্রেমের কোনোই নিদর্শন হতে পারে না।

পূর্ববাংলার বাঙালিদের পাকিস্তানি শাসকরা নির্মমভাবে শাসন করত। দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। ১৯৭১-এ তা সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হলো। দেশ স্বাধীনও হলো। যেসব প্রয়োজনে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তাই আমাদের প্রণীত জাতীয় সংবিধানে স্থান করে নিয়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যখন বলা হয়, তখন অবশ্যই প্রশ্ন জাগে যে কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। ওই চেতনা না থাকলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারতাম না। তখন পূর্ববাংলার বাঙালিদের সামনে সমস্যা ছিল কী? প্রথম সমস্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক তাদের শাসন করত। বাঙালি যে ভাষা, আচরণ, সংস্কৃতি ও জীবনধারায় একটা পৃথক জাতি, এটা ওরা মানতে রাজি ছিল না। ওদের ধারণা ছিল, বাঙালি জাতিসত্তার সব কিছু মুছে ফেলে পূর্ববাংলার মুসলমানদের পাকিস্তানি জাতিসত্তা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যাবে এবং ওই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে নির্মমভাবে তারা বাঙালিদের শোষণও করেছে। তাই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ করার একটা কারণ ছিল শোষণমুক্ত একটা সমাজ গঠন করা। যেহেতু সামরিক শাসন জারি করে, গণতন্ত্রকে নির্বাসিত করে, বাঙালিদের শাসন ও শোষণ করা হতো। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কখনো বাঙালি অধিষ্ঠিত হতে পারেনি। বারবার সামরিক শাসক দ্বারা বাঙালিদের অধীনস্থ করে রাখা হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের আরেক লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তখন বাঙালিদের ধারণা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই সাংবিধানিক ধারায় বাঙালি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারবে।

পূর্ববাংলার জনগণের আরেকটা সংকট ছিল সম্প্রদায় বিষয়ক। ব্রিটিশ আমল থেকেই ওই সাম্প্রদায়িকতা চলে আসছে। ইংরেজরা ভাবত হিন্দু-মুসলমান বিরোধ অব্যাহত থাকলে তারা ভারত শাসন করতে পারবে। একই কায়দায় পাকিস্তানও ভাবত পূর্ববাংলায় তাদের শাসন অব্যাহত রাখা যাবে। পূর্ববাংলার জনগণ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান প্রকৃত জাতিসত্তাই ছিল বাঙালি। ভাষা, সাহিত্য, আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক ও চালচলনে তারা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির অনুসারী। অথচ বাঙালি শব্দটাই পাকিস্তানের কাছে ছিল অগ্রহণযোগ্য। বাঙালিত্ব বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে পাকিস্তানিকরণ করা হবে- এটাই ছিল তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তাই বাঙালি জাতিসত্তা রক্ষার চেতনাই ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সবচেয়ে বড় কারণ। আরেকটা চেতনার পরিব্যাপ্তিও ছিল- সামগ্রিক সামাজিক ন্যায়বিচার। ব্যক্তি শ্রেণি ও গোষ্ঠীগতভাবে যে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান ছিল, তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তথা সামাজিক ন্যায়বিচার দাবি উঠেছিল। মোটামুটিভাবে এগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এগুলোকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আসা অযৌক্তিক ও অর্থহীন।

এমন প্রচার মাধ্যম নেই, যেখানে দিনে একাধিকবার বিভিন্ন প্রবক্তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেননি। এমন দলও আছে, এমন বুদ্ধিজীবীও আছে, যারা এই ৪টি মূলমন্ত্রের একটিতেও বিশ্বাসী নয়। তাদের বলতে শোনা যায়, শুধু নাকি গণতন্ত্রের জন্যই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। আর সে গণতন্ত্র হচ্ছে তাদের শ্রেণিগত অবস্থানের সঙ্গে সম্পূরক গণতন্ত্র। জনগণতন্ত্রের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এরাই বলে থাকেন, জিয়া নাকি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করে গেছেন। জিয়ার শাসনামলে সাড়ে ছয় বছর ও জেনারের এরশাদের নয় বছর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি কার্যকর ছিল? নির্বাচন কমিশনের কি স্বাধীনতা ছিল? নির্বাচনে জনগণ অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে ভোট দিতে পারতেন? ইচ্ছামতো কোনো ব্যক্তি কি প্রার্থী হতে পারতেন? সংসদও কি সার্বভৌম ছিল? জেনারেল জিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো মন্ত্রী, সাংসদ কি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন? প্রতিবাদের ভাষায় কথা বলতে পারতেন? স্বাধীন, সচেতনভাবে, কোনো বুদ্ধিজীবী কি কোনো মতামত প্রকাশ করতে পারতেন? এসব প্রশ্নের উত্তর না সূচক। তথাপি যারা বলতে ছাড়েন না যে, জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক, তাদের কাছ জিজ্ঞাসা ওই গণতন্ত্রের গতি ও প্রকৃতি কী ছিল এবং তার দ্বারা সাধারণ মানুষ কতটুকু উপকৃত হয়েছিল?

আরেক দল বলেন, ধর্মকে রক্ষা করার জন্যই নাকি বাংলাদেশের সৃষ্টি। ধর্মনিরপেক্ষতাকে তারা ধর্মহীনতা বলেন। তারা মৌলবাদী, ধর্মসর্বস্ব রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করাই তাদের উদ্দেশ্য। সাম্প্রদায়িকতাকে তারা ধর্মীয় চেতনাতে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে তারা ধর্মীয় দর্শন বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেন। কী কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন করা হলো, সে সম্পর্কে তারা একেবারেই বিপরীতমুখী। এরাই মূলত বাংলাদেশকে একটা ধর্মরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে চায়। আরেক দল আছে, তারা হলো চরম বামপন্থী। মার্কসিস্ট রিভ্যুলুশনের ফলে যে দুটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, স্বাধীন করা বাংলাদেশকে তারা সেই রকম রাষ্ট্র বানাবার পরিকল্পনা করছিল। সমাজতন্ত্র বলতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যা বলে গেছেন, তার সঙ্গে তাদের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। ধর্মকে তারা আফিম বলে মনে করেন। বস্তুনিষ্ঠ ধর্মহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে তাদের লক্ষ্য। সাধারণভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বুর্জোয়াশ্রেণি বলে অভিহিত করে থাকেন। অথচ শ্রেণিগত অবস্থানে তারা যে বুর্জোয়া নয়, তা তাদের আচার-আচরণে ও জীবনযাপনের ব্যবস্থায় কোনো প্রকারেই পরিদৃষ্ট হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যে যাই বলুক না কেন, ওই চেতনা উদঘাটন করতে হলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কাছে ফিরে যেতে হবে। স্মরণ করতে হবে ২৩ বছরের পূর্ববাংলার বাঙালির কথা। যে কারণে স্বাধীনতার প্রয়োজন, সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সেই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তাই চেতনা নিয়ে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করার কোনো অবকাশ নেই। স্বাধীনতার সপক্ষের প্রতিটি শক্তি এটা হাড়ে হাড়ে বুঝে ও জানে।

বিভিন্ন দলে অবস্থানের কারণে মুক্তিযোদ্ধার ভাষায় যে চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তা অনেক ক্ষেত্রে আত্মপ্রবঞ্চনাকারী বহিঃপ্রকাশ। তাই সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব শক্তির ভেতরে অন্তত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক একটা সমঝোতা। আর এটাই সময়ের দাবি। চেতনার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান যদি সঠিক না হয়, তাহলে সঠিক লক্ষ্য অর্জন করা যাবে কী করে? তাই মহান বিজয় দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সামনে রেখে বলতে চাই, যে কোনো মূল্যেই হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হবে এবং সবাইকে অঙ্গীকার করতে হবে- ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বৃথা যেতে দেব না’।

ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App