×

মুক্তচিন্তা

প্রশ্নপত্র ফাঁস মেধাকেও ফাঁস পরাবে

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:২২ পিএম

প্রশ্নপত্র ফাঁস- শিক্ষা ব্যবস্থার এক কঠিন বিষফোঁড়া যেন। এই ফাঁস যেন নিরীহ মেধাবী শিক্ষার্থীদের গলায় ফাঁস দেয়ার মতো ব্যবস্থা করে রেখেছে। ফাঁসের ঘটনা ঘটছে অবলীলায়, সহজে ও সরলে এবং বিঘ্নহীনভাবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা বেপরোয়া, দাপুটে। এতে শিক্ষার্থীর চাইতে মেধার অপমৃত্যু হচ্ছে বেশি এবং তা প্রতিনিয়ত। বোর্ড পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ছিল অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস সীমা ছাড়িয়েছে। বেপরোয়া হয়েছে। যদি বলি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভর্তি জালিয়াতি এখন ফরমালিনের ব্যবহারের চাইতেও উন্মুক্ত, সহজ এবং সুলভ, তবে তা ভুল বলা হবে না। বরং অবস্থাদৃষ্টে জোর দিয়ে বলা যায় যে, উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিকে কেন্দ্র করে একটি পেশার জন্ম হয়েছে। পেশাজীবীর আবির্ভাব ঘটেছে। দিনে দিনে তা লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত হচ্ছে, হয়েছে এবং এ নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে।

নৈতিক অবক্ষয়ের বিষে যেন এই ভর্তি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় জড়িত কতিপয় শিক্ষক, ছাত্র, প্রশাসন, কর্তৃপক্ষ। প্রতি বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ঘটনার শেষ নেই। বরং এই ধারাবাহিক বিষক্রিয়ায় প্রকৃত মেধাবীদের মেধা হতাশার দিকে ধাবিত হচ্ছে ক্রমশ, ধ্বংস হচ্ছে মেধানুযায়ী শিক্ষার যোগ্য অধিকারটুকু। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা, যারা সাধারণ অথচ মেধাবী শিক্ষার্থী। যাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেনি, রাজনৈতিক কোনো লিংক বা সম্পৃক্ততা নেই। নেই অর্থ দিয়ে প্রশ্নপত্র কেনার সামর্থ্যও। আমার একজন পরিচিত শিক্ষার্থী বেশ আক্ষেপ করে বললেন, আমি ভর্তির সুযোগ পেলাম না। কিন্তু আমার ক্লাসে খুব সহজে পাস করে না এমন একজন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। কী করে সম্ভব হলো, তা জানতে চেয়ে উত্তর যা এল, তা হলো মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে প্রশ্নপত্র কেনা হয়েছে। কোথায়, কীভাবে পাওয়া যায় এসব প্রশ্নপত্র- এমন প্রশ্নের উত্তরও আমরা দেখেছি দৈনিক পত্রপত্রিকায়, স্যাটেলাইট চ্যানেলে। সেটা আর না-ই উল্লেখ করি। আমার সেই পরিচিত শিক্ষার্থী এখন আর পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চায় না। তার সাফ জবাব, এই অবস্থায় সে পড়াশোনা করবে না।

দুঃখ, হতাশার মতো বিষয়গুলো বোধহয় নিবৃত্ত হওয়ার নয় যখন দেখি শিক্ষার মতো একটি বিষয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয় বা হচ্ছে। সম্প্রতি বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু ছাত্রের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে, এমন সংবাদ প্রচারমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা কী শাস্তির ব্যবস্থা নেবেন, এটা তাদের ব্যাপার। বিচারিক পদক্ষেপ আইনানুগ চলবে। সেদিকে আর না-ই যাই। কিন্তু যেখানে না যেয়েই নয় যে তা হলো উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থায় এত জঘন্যতম ঘৃণ্য অপরাধ ঘটাবার দুঃসাহস কী করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এই অঙ্গ সংগঠনের কতিপয় সদস্য পেল বা পায়? যেখানে রাজনৈতিক সততা, স্বচ্ছতার প্রশ্নে দলটির আপসহীনতার কথা শুনি, দেখি প্রতিনিয়ত বারবার! দুঃখ করে বলতে হয়, নেতৃস্থানীয় কারোর ক্ষোভ দেখিনি এই অপকর্মের বিরোধিতায়। দেখেনি শাসনও। শুনিনি প্রকাশ্যে ধিক্কার। খুব আশা ছিল, অন্তত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলটি থেকে এই অপকর্মের সমালোচনা হবে। হয়নি কিংবা হয়ে থাকলেও আওয়াজ পাইনি। হয়তো আমি পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছায়নি। এতে জনমনে গতানুগতিক ধারণাই জন্মেছে, জন্মে যায়। তা হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার শিক্ষাকেও ছাড় দেয়নি, দেয় না টেন্ডার, চাঁদাবাজ কিংবা দখলবাজের মতো। দলে যারা সচেতন, বোধসম্পন্ন, সৎ নেতা আছেন, তাদের কঠোর অবস্থান কিন্তু পারে এ ধরনের অপরাধকে নিবৃত্ত করতে। রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের সদস্যদের কার্যকলাপ নজরদারি করে তাদের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর বর্তায়। এই দায় বা দায়িত্ব নেতা না নিতে পারলে, তার ব্যর্থতার আঘাত এসে পড়ে জনগণ ও দেশের ভবিষ্যতের ওপর। অন্তত যে দলটির প্রতি মানুষের আস্থা, ভরসা বেশি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষ ও দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া। আবার রাজনৈতিক দলটির ওপর থেকে জনগণের আস্থা কমে আসে। দলের জনপ্রিয়তা হারাবার সুযোগও সৃষ্টি হয়। ইতিহাস আছে বেশ স্পষ্ট।

সম্প্রতি আরো একটি ঘটনা চোখে পড়ল। স্কুল পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের উত্তর লিখে দিচ্ছেন অভিভাবকরা পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে বসে। মোবাইল ফোনের ম্যাসেঞ্জারে প্রশ্নপত্র চালাচালিও হয়েছে। নৈতিক অবক্ষয়ের সঙ্গে প্রযুক্তির অপব্যবহার মিলেমিশে একাকার। নৈতিকবোধকে যেমন আমরা সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি, ঠিক তেমনি মোবাইল ফোনের অবস্থান, ব্যবহারকেও করছি অবমূল্যায়ন। এসব অভিভাবক সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ছেন না, ভাঙছেন। এখানে শিক্ষক, প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের ভ‚মিকাও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এমন কেউ থাকলেন না যে, যিনি এই অবস্থার বিরোধিতা করলেন।

মাঝেসাঝে বিশাল প্রশ্ন নিয়ে বসি, বাংলাদেশে উন্নয়নের জন্য কি বড় বা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সেতু, সড়ক, নাকি শিক্ষা? বিদ্যুৎ, গ্যাস, ক্ষুদ্রঋণ, উদ্যোক্তা, নাকি শিক্ষা? গুরুত্বপূর্ণ সবই। তবে মৌলিক অগ্রাধিকার হলো শিক্ষা। এসবের মধ্যে শিক্ষা হলো ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, যা সংবিধানে স্পষ্টত। এটা সবাই জানেন, বলেনও। সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই হলো যেনতেন। আবেগীয় উন্নয়ন ধারণায় আমরা ভুলে যাই যে, ব্যক্তি শিক্ষিত না হলে প্রকৃত সেবা ভোগ যেমন হয় না, ঠিক তেমনি সেবা ভোগ যথোপযুক্ত হয় না। সেবা ভোগের জন্য ব্যক্তিকে তৈরি হতে হয়, যা পারে কেবল শিক্ষা। অথচ সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। এমন হওয়ার পেছন যে কারণ কম দায়ী নয়, তা হলো শিক্ষক সমাজের নিবিড় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। ফলে দলীয় স্বার্থের কারণে এই সমাজও দ্বিখণ্ডিত, বিভাজিত। শিক্ষার চাইতে এখানে রাজনৈতিক স্বার্থটা বড়। ফলে শিক্ষার প্রশ্নে তারা আপসহীন, সোচ্চার হন না, থাকেন নির্লিপ্ত।

শিক্ষাকে পেছনে ফেলে কোনো দেশ-জাতি সামনে এগিয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই। দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুস্থ, সুষ্ঠু, ন্যায়সঙ্গত, যৌক্তিক এবং সর্বোপরি সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে। মেধার যথাযোগ্য মূল্যায়ন এবং তার পরিচর্যার বিষয়ে জাতিগতভাবে তারা বিতর্কের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে থাকেন। এ ধরনের মানসিকতা, চর্চা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার মতো ন্যক্কারজনক, ঘৃণ্য ঘটনার অবসান হওয়ার পথ তৈরি হবে তাতে। আর যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রশ্নপত্র ফাঁস জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। মানুষ হত্যার মতোই এই অপরাধ। কারণ এখানে দেহ নয়, শিক্ষার্থীর মেধাকে হত্যা করা হয়।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App