×

মুক্তচিন্তা

প্রযুক্তি ও প্রকৌশলমনস্ক প্রজন্ম গড়ে উঠতে সহায়ক হবে

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:১৭ পিএম

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরমাণু শক্তি, পরমাণু চুল্লি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পরমাণু বোমা এ বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, পেশাজীবী ও শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য শ্রেণি-পেশা মানুষের মধ্যে তেমন ধারণা নেই বললেই চলে। আবার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা মানুষের মাঝে নেতিবাচক ধারণাও যে নেই তা কিন্তু নয়। এ চিত্র শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়, সব নবাগত পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ থেকে শুরু করে পরমাণু শক্তিতে উন্নত দেশগুলোর মধ্যেও কমবেশি বিরাজমান। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশের বাসিন্দারা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে গুজব ছড়ালেও তাদের কেউ বিভ্রান্ত করতে পারে না। তারাই সবচেয়ে বেশি পরমাণু বিদ্যুৎবান্ধব পরিবার হিসেবে কাজ করে। কারণ হচ্ছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকি সম্পর্কে তারা অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। কাজেই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, দক্ষ ও টেকসইভাবে চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে জনসাধারণের স্বচ্ছ ধারণা, সচেতনতা ও সহযোগিতা।

ফুকুশিমা পরমাণু দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সম্পর্কে মানুষের আস্থা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে বটে। কিন্তু আধুনিক পরমাণু প্রযুক্তির অনেক উন্নতি লাভ করেছে। চেরনোবিল (১৯৮৬) ও ফুকুশিমা (২০১১) দুর্ঘটনার শিকার রিএক্টরগুলো হচ্ছে জেনারেশন-২ টাইপ। এসব রিএক্টরে পরোক্ষ নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ও রিএক্টর অপারেটরের হস্তক্ষেপ ছাড়া মাত্র অর্ধঘণ্টা রিএক্টর ঝুঁকিবিহীন অবস্থায় চলতে পারে। রিএক্টরটি একক কন্টেইমেন্ট বিল্ডিং দ্বারা বেষ্টিত এবং অতিমাত্রায় ভূমিকম্প সহনীয় নয়। অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান হামলা প্রতিরোধক্ষম নয়। দুর্ঘটনায় পতিত হলে উৎপন্ন হাইড্রোজেন গ্যাস শোষণের ব্যবস্থা নেই, নেই কোর ক্যাচার। ফলে যে কোনো প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ে চুল্লির দুর্ঘটনা ঠেকানো দুরূহ হয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল অব্দি জেনারেশন-২ টাইপ রিএক্টর মূলত বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে ৪৩৯টি রিএক্টরের মধ্যে জেনারেশন-২ টাইপ রিএক্টরের সংখ্যাই বেশি এবং এগুলোকে অধিকতর নিরাপদ করে চালনা করা হচ্ছে। ১৯৮৬ সালে রাশিয়ার চেরনোবিল পরমাণু দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ও বহুস্তর নিরাপত্তা বেষ্টনী সংবলিত সব বিষয় বিবেচনায় এনে ডিজাইন করা হয় জেনারেশন-৩ টাইপ রিএক্টর। জেনারেশন-৩ টাইপ রিএক্টরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- যে কোনো প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে রিএক্টর কোরের বিপর্যয় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, পরিবেশের ওপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব অত্যন্ত সীমিত, কম পরিমাণে বর্জ্য তৈরি হবে, রিএক্টর এবং জ্বালানি রডের আয়ুষ্কাল দীর্ঘ। উন্নত দেশগুলো নিরলস গবেষণার মাধ্যমে এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তি রপ্ত করেছে এবং অধিকতর শক্তিশালী জেনারেশন-৩ টাইপ পরমাণু চুল্লি আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এসব পরমাণু চুল্লির কোর বিপর্যয়ের সম্ভাব্য হার প্রায় প্রতি ৩০ লাখ বছরে একবার যা গাড়ি, জাহাজ কিংবা বিমানে চড়া, ফ্যাক্টরিতে কাজ করা, স্পেসশাটল করে মহাকাশে যাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্ঘটনা হারের চেয়েও কয়েকশ’ গুণ কম। আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত জেনারেশন-৩ টাইপ পরমাণু চুল্লিতে দৈবক্রমে দুর্ঘটনা ঘটলেও জননিরাপত্তার জন্য তেমন কোনো হুমকি নেই। বর্তমানে ৪টি জেনারেশন-৩ পরমাণু চুল্লি চালু রয়েছে। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমায় পরমাণু দুর্ঘটনার পরবর্তীকালে আরো উন্নততর জেনারেশন-৩+ টাইপ রিএক্টর নির্মাণ করা হচ্ছে। আসলে জেনারেশন-৩+ রিএক্টর হচ্ছে জেনারেশন-৩ এর উন্নত ভার্সন। রাশিয়ার ডিজাইনকৃত এবং আইএইএ’র সুপারিশকৃত ভিভিইআর-১২০০ মডেলের অত্যাধুনিক রিএক্টর এখন রাশিয়া, বেলারুশ, হাঙ্গেরি, তুরস্ক, ফিনল্যান্ড, মিসর, ফ্রান্স ও চীনে নির্মাণাধীন রয়েছে। রূপপুরেও নির্মিত হতে যাচ্ছে জেনারেশন-৩+ ভিভিইআর-১২০০ টাইপ আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত রিএক্টর। এ ধরনের রিএক্টরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। রিএক্টরটি ডাবল কন্টেইমেন্ট বিল্ডিং দ্বারা আচ্ছাদিত এবং স্ট্রাকচারদ্বয় অতি মাত্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- টর্নেডো, হারিকেন, ভ‚মিকম্প ও বন্যা নিরোধক। অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান হামলা প্রতিরোধক্ষম। পরোক্ষ নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকার ফলে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ও রিএক্টর অপারেটরের হস্তক্ষেপ ছাড়া রিএক্টর ৭২ ঘণ্টাব্যাপী ঝুঁকিবিহীন অবস্থায় চলতে সক্ষম। এ ছাড়াও রয়েছে কোর ক্যাচার। যদি কোনো কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে এবং ফুয়েল রড গলে অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় তরলে পরিণত হয় সেই পদার্থকে আঁকড়ে ধরতে পারবে। এতে তেজস্ক্রিয়তা মাটি, পানি কিংবা বাতাসের সংস্পর্শে আসার কোনো সুযোগ থাকছে না। ফলে দুর্ঘটনাজনিত কারণে মানুষের তেজস্ক্রিয়তা গ্রহণের কোনো সম্ভাবনা নেই। অপরদিকে পরমাণু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও মানুষের মাঝে রয়েছে দুশ্চিন্তা। কিন্তু রূপপুরের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত পরমাণু বর্জ্য (ব্যয়িত জ্বালানি দণ্ড) সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিজ দেশে নিয়ে যাবে বিধায় আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ করার জন্য নিবিড়ভাবে তদারকি করছেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। রূপপুরে জেনারেশন-৩+ টাইপ দুটি ভিভিইআর-১২০০ মডেলের ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বিশিষ্ট পরমাণু চুল্লির মূল ভিত্তিপ্রস্তর অর্থাৎ প্রথম কংক্রিট ঢালাই গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন। দিনটি পরমাণু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অগ্রযাত্রার প্রথম ধাপটি পরমাণু বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পরমাণু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন একটি বহুশাস্ত্রীয় উচ্চ প্রযুক্তিঘন, জটিল, স্পর্শকাতর ও পেশাদারিত্বের বিষয়। রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে পরমাণু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলমনস্ক একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠতে সহায়ক হবে। যা পরমাণু শিক্ষা, গবেষণা ও পরমাণু শক্তির অধিকতর শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রাখবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সঠিক জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ হবে। পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ, টেকসই কৃষি, আধুনিক পরমাণু চিকিৎসাসেবা, পরিবেশ সুরক্ষা, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদন বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা করা অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনা যেমন আছে, চ্যালেঞ্জও রয়েছে বিস্তর। আশা করি তরুণ মেধাবীরা এ ক্ষেত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কখনো পিছপা হবে না।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম : লেখক, শিক্ষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App