×

মুক্তচিন্তা

যুক্তরাষ্ট্রে তিন ডব্লিউর কোনো স্থায়িত্ব নেই

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:৩৩ পিএম

ট্রাম্পকে তো সবাই নাক সিটকায়, তার পরিবারটি দেখুন। তার বিয়ে তিনটি, কিন্তু কপাল খুলেছে মেলানিয়ার! ক্লিনটন বৌকে ফাঁকি দিয়ে বজ্জাতি করেছেন বটে, কিন্তু খেসারত দিয়েছেন ব্যাপক। বুশ, ওবামা এদের চরিত্র তো  ‘ফুলের মতো’ পবিত্র। এ দেশের সাধারণ মানুষও আসলেই ভালো। সেটা বোঝা যায় গ্রামাঞ্চলে গেলে। এরা পরিশ্রমী, পরনিন্দা-পরচর্চার সময় নেই এদের। তাহলে খারাপ লোক নেই? নিশ্চয়ই আছে, তবে ভালোর সংখ্যা বেশি। এরা বাইরে গিয়ে ছড়ি ঘুরালেও দেশের ভেতরে ‘চমৎকার গণতন্ত্র’ বিদ্যমান। এ দেশের প্রেসিডেন্ট অনেক ক্ষমতাধর, কিন্তু ‘চেক এন্ড ব্যালান্স’ সর্বত্র। প্রেসিডেন্ট চাইলে একজন সাধারণ মানুষকেও নাগরিকত্ব দিতে পারেন না। আমাদের বন্ধু প্রদীপ সাহা প্রায়শ বলেন, ‘আমেরিকানরা আসলেই বোকা, নইলে ওরা আমাদের আনে?’।

আমেরিকায় আসার পর ১৯৯০ সালে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, শিরোনাম ছিল, ‘মার্কিন মুলুকে তিন ডব্লিউর কোনো স্থায়িত্ব নেই’। হেডিং হুবহু ও রকম না হলেও ভাবার্থ একই। এটি দৈনিক বাংলার বাণীতে ছাপা হয়েছিল। নিউইয়র্কের মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা ওটি পড়েছেন এবং দেখা হলেই বলেন, ওই লেখা পড়ে তিনি আমায় চেনেন এবং আমেরিকায় আসার উৎসাহবোধ করেন। লেখাটি নাকি ভালো হয়েছিল। কেন জানি না, ‘তিন ডব্লিউ’ নিয়ে আবার লিখতে ইচ্ছে হলো। কারণ ‘তিন ডব্লিউ’ এখনো স্থায়ী নয় এবং কখনো স্থায়ী হবে না। কী লিখব জানি না, তবে ভাবার্থ ঠিক থাকবে। ওই সময় লিখেছিলাম, ‘এখন যৌবন যার, আমেরিকা আসার সময় তার’। তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, বাংলাদেশিতে সয়লাব হয়ে গেছে বেশ কটি মার্কিন শহর। আগে বাঙালি দেখলে সবাই আগ বাড়িয়ে কথা বলত, এখন দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড, বা পার্কচেস্টার, ওজনপার্ক এলাকা বাঙালিতে গিজ গিজ করে।

‘তিন ডব্লিউ’ হচ্ছে, ‘ওয়াইফ/ওমেন’, ‘ওয়েদার’ এবং ‘ওয়ার্ক’ অর্থাৎ স্ত্রী/নারী, আবহাওয়া এবং কাজ। আসলেই এ দেশে এ তিনটি বেশ দ্রæত পরিবর্তনশীল। আমেরিকা বিশাল দেশ, এ দেশে সব ধরনের আবহাওয়া পাওয়া যায়। কোথাও গরম, কোথাও ঠাণ্ডা, আবার অন্যত্র নাতিশীতোষ্ণ। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ফ্লোরিডা গিয়েছিলাম, রীতিমতো আমাদের দেশের মতো গরম, অথচ নিউইয়র্ক নেমে হেভি জ্যাকেট গায়ে দিতে হয়। আমার বন্ধু ও এক সময়ের কলেজ সহকর্মী ড. মুজতবা আলী ব্যাটনরুজ থাকেন। তিনি জানান, ওখানকার ওয়েদার নাকি সব সময় সিঙ্গাপুরের মতো। পুরো আমেরিকার আবহাওয়া নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, আমি শুধু নিউইয়র্কের কথা বলব। এখানে শীত থাকে প্রায় ছয় মাস। সেটাও যেমন-তেমন শীত নয়, হাড়কাঁপানো শীত। তদুপরি কখনো-সখনো থাকে বাতাস এবং বরফ। বরফ পড়ছে টিভিতে দেখতে ভালোই লাগে, কিন্তু বাস্তবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আর বরফ পরিষ্কার করতে হলে তো কথাই নেই। বরফ পরিষ্কারের ভয়ে অনেকে বাড়ি বিক্রি করে ফ্লোরিডা চলে যান।

এ দেশে মিডিয়া আবহাওয়া নিয়ে যত সময় ব্যয় করে, আমাদের দেশে এর লাখো ভাগের এক ভাগও নয়, হয়তো দরকারও নেই। নিউইয়র্কের আবহাওয়ার আসলেই কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। অনেক অনেক দিন আগে এক ভদ্রমহিলা নিউইয়র্কে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ওমা, এখানেও সূর্য ওঠে!’ হ্যাঁ, নিউইয়র্কেও সূর্য ওঠে এবং শুধু ওঠে না, কখনো কখনো গরম বাংলাদেশের মতো মনে হয়। এখানে গরম আছে, বৃষ্টি আছে এবং প্রচণ্ড শীত, বরফ পড়ে। এখানে দুই ফুট বরফের মধ্যেও লোকে কাজে যায়। সচরাচর ডিসেম্বর থেকে মার্চ এ দেশে ঘুরতে না আসাই উচিত। জাঁকালো শীতে কষ্ট বটে। গ্রীষ্ম বা বর্ষা আসে, গ্রীষ্ম কখনো শর্ট, কখনো লম্বা। শীতকালে বৃষ্টি হয়। এখানে মোটামুটিভাবে সকালে গরম, বিকালে ঠাণ্ডা, মধ্য রাতে কম্বল গায়ে দেয়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। নিউইয়র্কে বেড়াতে আসার ভালো সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। আবার ফ্লোরিডাতে শীতকালে। অক্টোবরে কখনো গরম, কখনো ঠাণ্ডা। মাঝেমধ্যে বরফও পড়ে। আমার দেখা একবার ৩১ অক্টোবর প্রায় ২ ফুট বরফ পড়ে, রাস্তার গাড়ি বরফে ডুবে যায়।

আবহাওয়ার মতো কাজের অবস্থায়ও একই। কোম্পানি যেমন এখানে দ্রুত কর্মচারী বদলাতে পারে, কর্মচারীও পারেন কোম্পানি বদলাতে। যৌবনে এদেশীয়রা সাধারণত দ্রুত চাকরি বদলায়। তিন থেকে পাঁচ বছর বাদে বাদে চাকরি বদলায় এবং অতঃপর বয়স একটু বাড়লে এরা এক জায়গায় স্থিতি লাভ করতে চেষ্টা করে। যারা সরকারি চাকরি করেন, তারা বেতন একটু কম পান কিন্তু কিছুটা সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় টিকে থাকতে চেষ্টা করেন। তবে এ দেশের সরকারি চাকরিও কিন্তু আমাদের দেশের মতো স্থায়ী নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো দ্রুত চাকরি না গেলেও প্রায়শ চাকরি যায়। এখানে কোট অফিসে রেখে চলে যাওয়া যায় না। এ দেশে একটি ভালো জিনিস হলো- কাজ করলে মালিককে পয়সা দিতেই হবে। আমাদের দেশে শ্রমিককে বেতন না দেয়ার বা কম দেয়ার একটি প্রবণতা আছে। আমি যখন আমেরিকায় আসি, তখন প্রায় দেড় বছরের বেতন পাওনা ছিলাম। কর্তৃপক্ষ সামান্য কিছু টাকা দিয়েছিল চাকরি ছাড়ার সময়।

আমেরিকায় এখন ন্যূনতম বেতন ঘণ্টায় ১২ ডলার। তবে বিভিন্ন স্টেটে সেটা তারতম্য আছে। একজন শ্রমিক সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করলে ৪০*১২=৪৮০ ডলার রোজগার করতে পারেন। করেনও। ওপরের দিকে বেতনের কোনো হিসাব নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বেতন বছরে আধা মিলিয়ন ডলারের কম। অথচ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সিইওর বেতন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। তবে প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা ছাড়ার পর আর গরিব থাকেন না, যেমন বিল ক্লিনটন। আগের চেয়ে তিনি এখন ধনী। ব্যবস্থাটাই ওই রকম। বই লিখে বা বক্তৃতা দিয়ে এরা বড়লোক হয়ে যান। ব্যবস্থাটা অনেকটা আমাদের দেশের সংসদ সদস্যদের মতো। সংসদে ঢোকার সময় তিনি কোটিপতি না হলেও ঢুকেই কোটিপতি হয়ে যান। কারণ তিনি একটি শুল্ক ফ্রি গাড়ি আনার সুযোগ পান। অর্থাৎ এক কোটি টাকা দিয়ে তিনি একটি গাড়ি আমদানি করে অনায়াসে ৩/৪ কোটি টাকা বিক্রি করে দিতে পারেন। কোটিপতি হওয়ার এই সুযোগ কে ছাড়ে। যা হোক, এই দেশে গরিবরা বেশি চাইনিজ খায়, কারণ ওটা সস্তা। ৫ ডলারে এক-চতুর্থাংশ মুরগি দিয়ে ভালোই লাঞ্চ হয়ে যায়।

আগে আমাদের দেশে রাজনীতিকরা জনগণকে বোকা বানানোর জন্য বলতেন, আমেরিকার তুলনায় বাংলাদেশে মুরগি সস্তা। দাম হিসাব করলে এখনো হয়তো মুরগির দাম আমেরিকা ও বাংলাদেশে সমান। কিন্তু দাম সমান হলেও ক্রয়ক্ষমতা তো সমান নয়। বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের দৈনিক বেতন ৫০০-১০০০ টাকা। আর আমেরিকায় একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন ৮ ঘণ্টা কাজ করলে মোটামুটিভাবে ১০০ ডলার, অর্থাৎ কমবেশি ৮০০০ টাকা। এ জন্যই আমেরিকার শ্রমিক অর্ধেক মুরগি দিয়ে লাঞ্চ করতে পারে। আর একটি উদাহরণ দেই। গরিবের কথা বাদ দেই, বাংলাদেশে একজন মধ্যবিত্ত এক বছর চাকরি করেও একটি টিভি বা ফ্রিজ কিনতে হিমশিম খায়। আমেরিকায় একজন শ্রমিক এক সপ্তাহের রোজগারে টিভি-ফ্রিজ দুটোই কিনতে পারে। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা বেশি। যা হোক, দুই দেশের মধ্যকার হিসাব-নিকাশ করার দরকার নেই, তবে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ ঘোরার পর আমার মনে হয়েছে, খাবার জন্য আমেরিকা সবচেয়ে ভালো জায়গা।

বাংলাদেশে থাকতে আমরা কখনো ‘কোয়ালিটি অফ লাইফ’ শব্দটি শুনিনি। এর অর্থ বা পরিধি ব্যাপক। কদিন আগে বাংলাদেশে একটি নিউজ দেখলাম- একজন প্রসূতিকে হাসপাতাল ফিরিয়ে দিয়েছে মাত্র পনেরো শ টাকার জন্য। মহিলার বাচ্চাটি এর ফলে মারা যায়। এ দেশে আগে চিকিৎসা, পরে টাকা। আর প্রসূতিকে ফিরিয়ে দিলে বা বাচ্চা মারা গেলে সংশ্লিষ্টদের বাকি জীবনটা জেলে কাটাতে হতো। বাচ্চাদের কদর ও গুরুত্ব এখানে অনেক। কোনো বাচ্চা হারিয়ে গেলে রাজ্যজুড়ে ‘এম্বার এলার্ট’ জারি হয় এবং পুরো পুলিশ প্রশাসন তটস্থ হয়ে পড়ে। এ দেশে গড় আয়ু বেশি, মানুষ বাঁচে দীর্ঘদিন। শেষ বয়সে অনেকে তাই একাকী হয়ে পড়েন। রাষ্ট্র থাকা, খাওয়া, ওষুধ-ডাক্তার দিলেও একাকিত্ব ঘুচাবার ব্যবস্থা করতে পারে না। ছেলেমেয়েরা যার যার মতো থাকে, হয়তো সপ্তাহান্তে খোঁজখবর নেয় কিন্তু তারপরও একাকিত্ব কাটে না। বিনোদনের ব্যবস্থা প্রচুর থাকলেও আত্মীয়তার অভাব থাকেই। এই নিঃসঙ্গতা কাটাতে অনেকে শেষ বয়সে বিয়ে করেন।

১৯৯০-এ লিখেছিলাম, ‘এখন যৌবন যার আমেরিকা আসার সময় তার’- এখন উল্টোটা লিখতে হবে। আমেরিকায় আসার সুযোগ কমে গেছে। ট্রাম্পের জমানায় আরো কমবে। লটারির সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। তবে উচ্চশিক্ষা ও দক্ষ কারিগরি ক্ষেত্রে আসা যাবে। আমেরিকায় অন্তত ৫ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় আছে, শিক্ষার্থীরা নামকরা ভার্সিটির দিকে না ছুটে স্বল্প পরিচিত ভার্সিটিতে আবেদন করলে সিলেক্ট হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। একবার এসে পড়লে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়াটা কঠিন কিছু নয়। এ দেশে রাত-বিরাতে ছেলেমেয়েরা একাকী ঘুরে বেড়াতে পারে। গুম নেই, তবে রেপ আছে, কিন্তু বিচারও আছে। এ দেশে প্রায় সব রেপ রিপোর্ট হয় এবং বিচারও হয়। এ দেশীয়রা মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত নয়। আমার এক দোস্ত সেলিম সুইডেনে থাকে। ওর দুই ছেলে। আমি জিজ্ঞাসা করি, তোর ছেলেরা কেমন হয়েছে। সেলিম বলে, ‘দোস্ত, আমার চাইতে ভালো’। আসলেই তাই। এসব দেশে আপনি ইচ্ছা করলে সৎ, সুন্দর ও কোয়ালিটি জীবনযাপন করতে পারেন।

এ দেশে বিয়ে বিচ্ছেদের হার অনেক। এর নানাবিধ কারণ আছে কিন্তু বিবাহিতা নারীর অধিকার এখানে বেশি। আর বিচ্ছেদ হলে নারীরা লাভবান হন এবং বড়লোকের ক্ষেত্রে এ জন্য বিচ্ছেদটা বেশি। ইউরোপ-আমেরিকা বা উন্নত বিশ্ব ‘ফ্রি সেক্সের’ দেশ। ফ্রি সেক্স মানে এই নয় যে, আপনি যখন-তখন, যার-তার সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়বেন। এর অর্থ হচ্ছে, প্রাপ্তবয়স্করা একে অপরের সম্মতিতে ঘুমালে রাষ্ট্রের তাতে মাথাব্যথা নেই। কিন্তু স্বেচ্ছায় না হলেই সেটা ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি এবং এর বিচার সাংঘাতিক। রেপ করে এখানে পার পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে নারীর অধিকার অগ্রগণ্য। কোনো মেয়ে ৯১১ নম্বরে ফোন করে ধর্ষিতা হয়েছেন জানালে পুলিশ অভিযুক্তকে ধরে নিয়ে যায়। এ দেশের পুলিশ কিন্তু মেয়েটি সত্য না মিথ্যা বলছে তা দেখবে না, সেটা আদালতের বিষয়। মেয়েটি অভিযোগ করেছে, সেটাই যথেষ্ট ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করার জন্য। আমাদের সময়ে স্কুলে ‘নারীর স্থান’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ্য ছিল, উন্নত দেশগুলো আসলেই নারীর স্থান। নারীর অধিকার এখানে স্বীকৃত। আমার শ্যালক টুটুল মাঝে মধ্যে দেশে ফিরে যেতে চায়, পারে না। ওর বউ যেতে রাজি নয়। টুটুল বলে, ‘আরে, বুঝেন না। এ দেশে এসে ‘জিন্স’ ধইরা ফালাইছে, আর ফেরত যায়?’। বিষয়টি জিন্সের নয়, স্বাধীনতার।

এ দেশে বিয়ে একটাই। একসঙ্গে ৪ বৌ, বা হারেম রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবে স্বামীরা যেমন বৌকে ফাঁকি দিয়ে অন্য রমণীর সঙ্গে প্রেম করেন, স্ত্রীও করেন বটে, তাই বিয়ে বিচ্ছেদ বেশি। একাধিক গার্ল বা বয় ফ্রেন্ড আইনের চোখে দোষণীয় নয়, কিন্তু সামাজিকভাবে নিন্দনীয়। যেমন- টাইগার উড, বেচারা ঘরে বৌ রেখে লুকিয়ে লুকিয়ে সুন্দরীদের সঙ্গে ঘুমাচ্ছিলেন। তার ‘আম ও ছালা’ দুটোই গেছে। আবার রিপাবলিকান সিনেটর ৪০ বছর আগে ৩২ বছর বয়সে ১৪ বছরের এক কিশোরীর সঙ্গে নাকি ফস্টিনস্টি করেছেন, তাই নিয়ে তার পতন আসন্ন। আমেরিকা হলে আমাদের এরশাদ চাচার কী হতো কে জানে। এ দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্ত বয়স্কের মধ্যকার প্রেম বা এমনকি বিয়ে পর্যন্ত আইনত দণ্ডনীয়। নিউইয়র্কের সাবেক কংগ্রেসম্যান এন্থনি উইনার এখন জেলে, কারণ তিনি একজন অপ্রাপ্ত বয়স্কের কাছে প্রেম নিবেদন করেছিলেন! প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার দেশ আমেরিকা। কথায় কথায় এরা বলে, ‘আই লাভ ইউ’। এর মধ্যে ‘লাভ’ কতটা আছে, তা বোঝা মুশকিল।

গে বা লেসবিয়ানদের কথা আলোচনা না-ই বা করলাম। তবে একটা গল্প বলি। গল্প নয়, সত্যি। আমি একবার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে যাই। গিয়ে দেখি, ভদ্রলোক নয়, এক যুবা, বয়স ৩০। কথা হলো, কফি খেলাম। মোটামুটি একটা সৌজন্যমূলক সম্পর্ক তৈরি হলো, ব্যক্তিগত কথাবার্তার পর্যায়ে পৌঁছলে তাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আর ইউ ম্যারিড’। যুবক বললেন, ‘ইয়েস’। ‘হোয়াট ইজ ইয়োর ওয়াইফ ডুয়িং’। যুবক সাবলীলভাবে উত্তর দিলেন, ‘নট ওয়াইফ, মাই হ্যাজবেন্ড ইজ এন ইঞ্জিনিয়ার’। আমার তো ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার অবস্থা। বুঝলাম, যুবক ‘গে’। আমাদের দেশে কি ‘গে’ আছে? পৃথিবীর সব দেশেই ‘গে’ আছে, কেউ স্বীকার করে, কেউ করে না! এ দেশে ‘গে-লেসবিয়ান’ হওয়াটা লজ্জার কিছু নয়। অনেক স্টেটে এখন সমকামী বিয়ে স্বীকৃত, ওনারা স্বামী-স্ত্রীর মতোই বসবাস করেন।

তাই বলে কি এ দেশে মানুষে ঘর-সংসার করে না। নিশ্চয় করে এবং ভালোভাবেই করে। মন্দটা প্রচার হয় বেশি। প্রমাণ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের দিকে তাকান, রাজনীতিকদের ফ্যামিলি দেখুন। সাধারণ মানুষ এ দেশে নিতান্তই ভালো। গ্রামেগঞ্জে না গেলে সেটা বোঝা যায় না। ট্রাম্পকে তো সবাই নাক সিটকায়, তার পরিবারটি দেখুন। তার বিয়ে তিনটি, কিন্তু কপাল খুলেছে মেলানিয়ার! ক্লিনটন বৌকে ফাঁকি দিয়ে বজ্জাতি করেছেন বটে, কিন্তু খেসারত দিয়েছেন ব্যাপক। বুশ, ওবামা এদের চরিত্র তো ‘ফুলের মতো’ পবিত্র। এ দেশের সাধারণ মানুষও আসলেই ভালো। সেটা বোঝা যায় গ্রামাঞ্চলে গেলে। এরা পরিশ্রমী, পরনিন্দা-পরচর্চার সময় নেই এদের। তাহলে খারাপ লোক নেই? নিশ্চয়ই আছে, তবে ভালোর সংখ্যা বেশি। এরা বাইরে গিয়ে ছড়ি ঘুরালেও দেশের ভেতরে ‘চমৎকার গণতন্ত্র’ বিদ্যমান। এ দেশের প্রেসিডেন্ট অনেক ক্ষমতাধর, কিন্তু ‘চেক এন্ড ব্যালান্স’ সর্বত্র। প্রেসিডেন্ট চাইলে একজন সাধারণ মানুষকেও নাগরিকত্ব দিতে পারেন না। আমাদের বন্ধু প্রদীপ সাহা প্রায়শ বলেন, ‘আমেরিকানরা আসলেই বোকা, নইলে ওরা আমাদের আনে?’।

আর একটি গল্প দিয়ে শেষ করি। কিছুদিন আগে মন্দার সময় আমার চাকরিটি চলে যায় (২০০৭)। ভাবছিলাম বাড়ির মর্টগেজ ইত্যাদি দেব কী করে। ফেডারেল সরকার তখন বাড়িওয়ালাদের অনেক রকম ইনসেনটিভ দিচ্ছিল। আমার ইন্টারেস্ট রেট একটু উঁচু ছিল, সেটা কমাতে চেষ্টা করছিলাম। ব্যাংক পাত্তা দিচ্ছিল না। তাই একদিন একটি ই-মেইল করলাম প্রেসিডেন্টের দপ্তরে। বক্তব্যটা অনেকটা এ রকম- ‘আমার চাকরি নেই, বাড়ির মর্টগেজ দেয়াটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ইন্টারেস্ট রেট কমলে সুবিধা হয়। তোমাদের তো এত প্রোগ্রাম, আমি কি একজন নাগরিক হিসেবে কোনোটায় সুযোগ পেতে পারি না’। যথা সময়ে উত্তর এল, কপি গেল সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর ও ব্যাংকে। ফোনকল, ই-মেইলে সবাই যোগাযোগ করল, কাগজপত্র দিলাম। এভাবে মাস দুই পার হলো। এক সময় সব জায়গা থেকেই চিঠি এল, ‘সরি, তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না’। আমরা ফার্স্ট জেনারেশন ইমিগ্র্যান্ট। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্যও এ দেশের হোয়াইট হাউস এগিয়ে আসে, এটাই কোয়ালিটি অফ লাইফ। বাংলাদেশ থেকে এসে অনেকে বিনে পয়সায় ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’ পর্যন্ত করে যান, এটাই কোয়ালিটি অফ লাইফ। বিশ্বাস করুন, বাংলাদেশে গত ৯ বছরে অন্তত দশবার ই-মেইলে গণভবনে যোগাযোগ করেছি। একবারও উত্তর পাইনি। ডিজিটাল বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ কি অন্তত একটি ‘অটোমেটেড রিপ্লাই’ আশা করতে পারে না।

নিউইয়র্ক। ২৮ নভেম্বর ২০১৭ শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App