×

মুক্তচিন্তা

পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:৪৫ পিএম

কাল-অকালের কাহনকথা

সম্প্রতি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সে দেশের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু কির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে দেশটির স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ের সঙ্গে এক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। এরপর সু কির দপ্তরের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত লোকজনকে ফিরিয়ে আনতে নিয়মতান্ত্রিক ব্যাপারে তাদের পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে।’ উদ্ধৃত বাক্যটি কত যে জটিল, কত যে মর্মান্তিক তা মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারাই জানে। আমরা কেবল বাক্যটির ভেতরকার অন্তঃসারশূন্য শঠতাকে উপলব্ধি করেই বসে থাকি, হতাশ হই। বুঝতে পারি এই সমঝোতা চুক্তিও মানবিক মর্যাদায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনে তড়িৎ কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারবে না। আর চুক্তির বাইরে সে দেশের সেনাপ্রধান আরো এক ধাপ এগিয়ে ঘোষণা করেন ‘সরকারের জারি করা পরিচয়পত্র যারা দেখাবেন, তাদেরই মিয়ানমার ফেরত নেবে।’ নেতৃস্থানীয়দের এমন বক্তব্য রোহিঙ্গা-সংশ্লিষ্ট যে কোনো সমঝোতা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। তা ছাড়া উদ্বাস্তু এসব রোহিঙ্গার জন্মের পর যখন সে দেশে কোনো পরিচয়পত্রই দেয়া হয় না, তখন তারা কোথায় পাবে পরিচয়পত্র! আর ‘নিয়মতান্ত্রিক’ শব্দটিরই বা কী গতি হবে তা কেবল সে দেশের সেনাশাসকরাই জানেন, আর জানেন ঈশ্বর!’ এর আগেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফলকালে কিছু চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এরূপ অনেক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কৌশলী আচরণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবান আলোর মুখ দেখতে পাবে বলে আশা করা কঠিন। তাদের ভিন্ন কোনো স্বার্থচিন্তাও থাকতে পারে যা আমরা হয়তো খতিয়ে দেখছি না। আমরা কেবল মানবিকতার দিকটিকেই সর্বোচ্চে তুলে ধরে সেই মতো কাজ করে যাচ্ছি। চতুর মিয়ানমারের সঙ্গে ক‚টচালে আমরা কতটুকু দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছি তাও বিবেচনার টেবিলে রাখা উচিত।

বাঙালি শান্তিপ্রিয় জাতি। সহজেই কোনো কাজিয়া-ফ্যাসাদ বা যুদ্ধ- বিগ্রহে জড়ানোর অভিপ্রায় তার নেই। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যে কোনো সংকট আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ ধৈর্য প্রদর্শনই বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কিন্তু বাঙালির এই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এখন হুমকির সম্মুখীন। বিগত তিন মাসের অধিক সময় ধরে মিয়ানমার তার রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লাখো মানুষকে নানা প্রকার নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে বাধ্য করেছে। এ বছরই কেবল সাড়ে ছয় লাখাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যাও পাঁচ লাখের অধিক। জনবহুল বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট গোদের ওপর বিষফোঁড়া। বাংলাদেশকে তার মোট জনসংখ্যার অতিরিক্ত প্রায় বারো লাখ মানুষের ভরণ-পোষণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শরণার্থী-ভারে দেশের সামগ্রিক বাজেটের ওপর যেমন চাপ পড়েছে তেমনি চাপ পড়েছে পরিবেশ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়।

মিয়ানমার কেবল রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা সময়ে সময়ে সামরিক উসকানিও দিয়েছে। বাংলাদেশ চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত রেখেছে। কোনো অবস্থাতেই মিয়ানমারের সামরিক উসকানির ফাঁদে পা দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সতর্ক নির্দেশনা আছে। সীমান্ত অতিক্রমকারী বার্মিজ ড্রোন ও হেলিকপ্টারগুলো তাই অক্ষত অবস্থায় দেশে ফিরতে পেরেছে। মিয়ানমার চেয়েছিল যে কোনোভাবেই বাংলাদেশের সঙ্গে একটি উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে অধিকতর সুবিধা নেয়া। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, ঠিক এমন পরিস্থিতি যদি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ঘটত তবে সেখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিত। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সতর্ক নির্দেশনায় একটি নিশ্চিত যুদ্ধাবস্থা থেকে আমরা মুক্ত আছি। যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেয়েছে অসংখ্য মানুষ। যুদ্ধ মানেই রক্তপাত, যুদ্ধ মানেই প্রাণের সংহার।

বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথেই হাঁটছে। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশের এই অবস্থানকে সমর্থন করছে বটে কিন্তু মিয়ানমারের অমানবিক অবস্থানকে তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কঠোর প্রশ্নের মুখোমুখি করছে না। বড় বড় রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সংকট সমাধানেরই দাওয়াই দিয়ে চলেছে। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আলোচনার নামে টালবাহানা চলছে ধারাবাহিকভাবেই। তার আরেকটি নজির গত ২৩ নভেম্বর উভয় দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমেও লাখ করা গেল! এবারের চুক্তিতেও মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের চাতুরিপূর্ণ বক্তব্যে ঘেরা যেসব শর্তারোপ দেখলাম তাতে ‘আগামী তিন মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু’ নিয়ে আশঙ্কাও আছে। মিয়ানমার যে প্রক্রিয়ায় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী (!) তাতে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুগের পর যুগ পেরিয়ে যাবে। আর এ সময়ে এই জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যাও দাঁড়াবে বর্তমানের কয়েক গুণ। কার্যত, এসব সমঝোতা আসলে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নয়। এ হলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি ও অবস্থানকে ‘ভালো’ রাখার কৌশলী বুদ্ধি মাত্র!

বিগত তিন মাসের বেশি সময় ধরে দেখছি পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এসে রোহিঙ্গা সমস্যায় ‘মানবিক সহায়তা’ নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে চলেছেন কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক ‘চাপ’ প্রদর্শন করছেন না। এ জন্য সুযোগ বুঝে সময় সময় মিয়ানমারের বিভিন্ন স্তরের নেতারা বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে হাস্যকরও করে তুলছেন। তাদের বক্তব্য-বিবৃতি পাঠ বা শ্রবণে আলোচনার প্রতি সাধারণের কোনো ভরসা থাকে না। তবু আমরা দেখছি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সারির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কূটনীতির শিষ্টাচার বজার রাখার স্বার্থে হলেও অসীম ধৈর্য ধারণ করে আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে সংকট সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার প্রত্যয়ে অটল। কিন্তু একপাক্ষিক ধৈর্য ও সহনশীলতা আর কত? মাঝেমধ্যে মনে হয় আমাদের এই ধৈর্যধারণকে মিয়ানমার কি তবে দুর্বলতা ভেবে বসে আছে? তবে কি বাংলাদেশেরও উচিত নয় অন্তত দুই-একবার হুঙ্কার দিয়ে ক্ষণিকটা হলেও গর্জে ওঠার? অন্তত কোনো না কোনো উপায়ে মিয়ানমারকে এটা বুঝানো প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ কেবল শান্তিপূর্ণ আলোচনার কথাই মুখস্থ করেনি, তাদেরও গায়ে-গতরে শক্তি আছে এবং সেই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তারাও যে কোনো সময়ে অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ তার ধৈর্যের সীমারেখাটা অন্তত বুঝিয়ে দিতে পারে।

আমরা জানি, মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ তাদের অনিবার্য নয়। তবে এও আমরা জানি প্রায় এগারো লাখ শরণার্থীকে দীর্ঘদিন ভরণ-পোষণের দায় কেবল বাংলাদেশেরই নয়। প্রায় আঠারো কোটি মানুষের এই দেশে বাড়তি এগারো লাখ উদ্বাস্তু জনতা কত বড় বোঝা তা কেবল বাংলাদেশই বুঝে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় এবং অনেক ধনী ধনী রাষ্ট্র আছে সেসব রাষ্ট্র একবার শুধু মুহূর্তের জন্য কল্পনা করুক যে, তাদের সে দেশটিতে হঠাৎ করে এগারো লাখ ভিনদেশি মানুষ এসে উপস্থিত হয়েছে! তখন তারা কীভাবে সেই সংকট মোকাবেলা করবে? চীন, রাশিয়া কিংবা ভারত ব্যবসায়িক স্বার্থের কথা ভেবে মানবিক বিবেচনায় এই বিষয়টি ভেবে দেখছে না। তারা কি এরূপভাবে কখনো ভেবেছে, সেসব দেশে হঠাৎ করে বাড়তি জনসংখ্যার এমন চাপ কী রূপ ধারণ করত! ১৯৭১ সালে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা তা আজো ভুলিনি। ভারতের কাছে সে প্রসঙ্গে দমে দমে আমরা কৃতজ্ঞবোধে অবনত হই তাদের তখনকার সহায়তার জন্য। আবার এও তো নিন্দুকেরা (!) বলে যে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লাভবান দেশটির নামও ভারত। ভারত নানাভাবে তখন তার লাভের হিস্যা বুঝে নিয়েছিল। তারপরও আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে কখনো কুণ্ঠিত নই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দ্বৈতনীতি বা রহস্যজনক নীতি গ্রহণ করেনি। এখন পর্যন্ত তারাই আমাদের ‘সবছে পেহেলে’ এবং ‘সবছে বড় বন্ধু’।

কল্পনাপ্রসূত মন নিয়ে একবার এমন ভাবনা তো ভাবতেই পারি যে, যে অনাকাক্সিক্ষত বোঝা মিয়ানমার বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তার প্রত্যাবাসন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না করলে সতেরো কোটি বাঙালি মিয়ানমারের দিকে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা শুরু করবে- প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মিয়ানমার না হোক অন্তত বিশ্ববাসীকে এমন একটি ‘আল্টিমেটাম’ আমরা দিতে তো পারি! আশা করি, তখন বাংলাদেশের এই সংকটকে অনেকেই পাত্তা দেবে। কারণ ‘নরম’ হয়ে থাকলে কেউ ‘পাত্তা’ দেয় বলে আমাদের জানা নেই। নরম থাকার কারণেই যে ভারত তার ‘সবছে পেহেলে বন্ধু’ বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি নিয়ে ছিনিমিনি খেলে সেই ভারতই আবার তার ‘চিরশত্রু’ পাকিস্তানকে সিন্ধু নদের পানির ন্যায্য হিস্যা না দিয়ে থাকতে পারে না। এখানেই ‘নরমে নরম, আর গরমে গরম’ প্রবাদটির বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায়। সুতরাং মিয়ানমারের সঙ্গে যথেষ্ট ভদ্রতা দেখানো হয়েছে বলে মনে করি। তাদের ভদ্রতা দেখাতে দেখাতে আমাদের ভদ্রতা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এবার একটু সোচ্চার আওয়াজ দেয়ার সময় এসেছে হয়তো! আত্মমর্যাদার জন্য হলেও একটি মৃদু হুংকার শান্তিপ্রিয় বাঙালির পক্ষ থেকে উচ্চারণ করা যেতেই পারে। আমরা সর্বদাই শান্তি চাই। তবু যদি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ক্ষীণ হলেও একটি আওয়াজ না তুলি তবে অদূর ভবিষ্যতে প্রায় বারো লাখ রোহিঙ্গাকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই আত্তীকরণ করতে হবে। আর সে দেশে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের জন্যও একই পথ উন্মুক্ত রাখতে হবে। বলা যায় না, একদা হয়তো তাদের কারো কারো আবদার মতে ‘ফেনী পর্যন্ত মিয়ানমারের অংশটুকু গ্রহণেও উদ্যোগ নিতে পারে। শান্তিপূর্ণ আলোচনার পাশাপাশি একটি রূঢ় রূপও বাংলাদেশকে ধারণ করা প্রয়োজন। তা না হলে যে পথ আমরা খুলে দিয়েছি সে ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে’ তা কেউ জানে না!

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App