×

মুক্তচিন্তা

দেশের রাজনীতিতে ভারত-চীন প্রসঙ্গ

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:০৯ পিএম

চেতনায় প্রত্যাশা

‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কাঁটা চীন’ বিগত বুধবার ২২ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকার চতুর্থ পৃষ্ঠায় এই হেডিংটি হচ্ছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরীর বক্তৃতার একটি লাইন। আগের দিন তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ‘ইতিহাসের আলোয় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক’ শীর্ষক আলোচনায় ওই কথাটা বলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন যে, ‘চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যসঙ্গী। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্র কেনে চীন থেকে। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরকালে এখানে বিপুল বিনিয়োগের ঘোষণাও দিয়েছেন। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগে বাংলাদেশ সঙ্গী হওয়ায় ভারতকে উদ্বিগ্ন করছে।’

ভারতের কাঁটার কথা উল্লেখ করে তিনি বাংলাদেশের প্রধান সমস্যার কথা সম্পর্কে বলেছেন, ‘তবে এখন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন পানি বণ্টনের সমস্যার সমাধান হয়নি। সম্ভবত এটাই এখন দুই দেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য অভিন্ন নদীগুলোর উৎস থেকে ভাটি পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব দেশ ও রাজ্যকে আলোচনায় সম্পৃক্ত করা দরকার।’ উল্লিখিত কথাগুলো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো বক্তব্য ও অবস্থান নয়; প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধির বক্তব্য। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচার এবং ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করলে এটা প্রতীয়মান হবে যে, উল্লিখিত কথাগুলোতে ভারত সরকারের মনোভাব ও অবস্থানের প্রতিফলন রয়েছে। বেশ স্পষ্ট খোলামেলা ও সুন্দরভাবে কথাগুলো বলায় সম্পর্কের সমস্যার দিকটা সহজভাবে বুঝতে পারা সম্ভব হচ্ছে এবং আলোচনা করার সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে। তাই প্রথমেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদকে জানানো হচ্ছে সাধুবাদ।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের দীর্ঘদিনের জমাটবাঁধা বরফ গলতে থাকে। দুই দেশই পারস্পরিক স্বার্থ সমুন্নত রেখে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যেমন মনস্তাস্তি¡ক বাধা অপসারণের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রকাশ করে, তেমনি সন্দেহ অবিশ্বাস দূরীভূত হতে থাকে। এক কথায় বলা যায়, বর্তমান সরকারের প্রথম পাঁচ বছর ও পরবর্তীতে বেশ কিছু কাল দুই দেশ সম্পর্কের সুন্দর সময় অতিক্রম করছে। কেউ কেউ বলেন, এটা সোনালি সময়। প্রসঙ্গত দুটো বড় সমস্যা যেমন এক. বাংলাদেশের মাটি অভয়ারণ্যের মতো ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী তথা রাজখোর-পরেশ বড়ূয়া গংদের সশস্ত্র অপতৎপরতা বন্ধ হয়েছে। দুই. স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমলে ঐকমত্য হওয়া সত্তে¡ও সুদীর্ঘ বছর সীমান্ত সমস্যা ঝুলে ছিল, তার সমাধান হয়েছে।

এই দুই সমস্যা সমাধানের সঙ্গে অন্যান্য দিকে সম্পর্কোন্নয়নের অগ্রগতি ছিল বর্তমান ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্বে পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অনন্য ও উদাহরণস্থানীয় ঘটনা। তবে বাণিজ্য ঘাটতি, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্তে গোলাগুলিসহ কতক সমস্যা থাকলেও বড় সমস্যা ছিল মতৈক্য হওয়া তিস্তা পানি চুক্তি সম্পাদনের সমস্যা। ধারণা করা হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। কালক্রমে সেই চুক্তিও স্বাক্ষর হয়ে যাবে বলে ভারতের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল। এমনটাই ধারণা করা হচ্ছিল যে, চলার পথে সমস্যার উদ্ভব হলেও দুই দেশের সম্পর্ক জটিলতা ও কঠিনতার মধ্যে পড়বে না। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ঐতিহাসিক অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে সুদীর্ঘ বছরের কমবেশি শীতল সম্পর্কের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের সরকারই পারস্পরিক স্বার্থ সমুন্নত রেখে অগ্রসর থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছিল।

কিন্তু বর্তমান দিনগুলোতে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে টানাপড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে। তাই ‘সম্পর্কের কাঁটা চীন’ এমন বক্তব্য উঠে আসছে। তদুপরি এত দিন তো মনে করা হচ্ছিল, অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তবে তিস্তা চুক্তি করতে গিয়ে এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝা গিয়েছিল যে, ভারতের রাজ্যগুলোও এক্ষেত্রে একটা ফ্যাক্টর। আর তাই বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গেও বোঝাপড়ার চেষ্টা চলিয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কথা পড়ে এখন দেখা যাচ্ছে কেবল সংশ্লিষ্ট রাজ্য নয়, উৎস থেকে ভাটি পর্যন্ত সব দেশও এই সমস্যা সমাধানের পক্ষে। এমন কথা ভারতে সুশীল সমাজের মধ্যে রয়েছে। এমনটা যদি হয়, তবে এখানেও আসবে চীন প্রসঙ্গ।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে আরো বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে চীন। লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারেও দেখা গেল চীন হচ্ছে বড় ফ্যাক্টর। প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, এত বড় একক ফ্যাক্টর হিসেবে আগে চীন আর কখনো বাংলাদেশের সামনে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা-চীন-পাকিস্তান অক্ষ অবস্থান নিয়ে গণহত্যার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তা ছিল আমেরিকার ছাতির নিচে, আলাদাভাবে নয়। পঁচাত্তরের কালো রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং সাহায্যে এগিয়ে আসে। ওই সময় সেনাশাসকরা পূর্বমুখী কূটনীতির কথা বলে চীনমুখী হতেও সচেষ্ট থাকে। কিন্তু তখনো আমেরিকা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান ফ্যাক্টর। এবারেই কেবল এর ব্যতিক্রম দেখা গেল।

এটা বোধকরি অবিতর্কিত হবে যে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যখন সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়, তখন বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল যে, যেহেতু ন্যায্য তাই ভারত সর্বতোভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এটা প্রমাণিত হয়নি। সর্বোপরি ভারতের সাবেক ক‚টনীতিক ও বাংলাদেশের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।’ তিনি অনেকটাই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘চায়না ওদের বিশেষ বন্ধু হয়েছে এখন। চায়নাকে জিজ্ঞাসা করুক। ওরা কিছু করুক। যখন দরকার হয় তখন তো চায়নার কাছে ছুটে যায় ওরা। ... কিছু রোহিঙ্গা চায়না নিয়ে নিক না।’ তার মতে, মিয়ামারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা ভারতের উচিত হবে না। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের একটা ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে। এ ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের কিছু আশা করা ঠিক হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অফিসিয়াল না হলেও ভারতের আরো একটি বিশেষজ্ঞ মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি। তবে স্মরণ করতে পারছি না সেই বিশেষজ্ঞের নাম। সেখানে যা লেখা হয়েছিল এর মূল কথা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে চীনের শীতল সম্পর্ক। কখনো বা তা মুখোমুখি যুদ্ধ পর্যায়ে যায়। এতে আবার চীনের সঙ্গে যুক্ত আছে ভারতের বৈরী দেশ পাকিস্তান। এতদসত্তে¡ও বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কেবল বৃদ্ধিই করে না, সাবমেরিনসহ অস্ত্র পর্যন্ত কেনে। চীন হচ্ছে বাংলাদেশের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় জোগানদার। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কে যদি টানাপড়েন সৃষ্টি হয়, তবে ভারত কোন যুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বতোভাবে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নষ্ট করবে। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে রাখবে না কেন? এখানে বলতেই হয়, উল্লিখিত দুই বক্তব্য ভারত সরকারের অফিসিয়াল বক্তব্য না হলেও ঘটনাপ্রবাহ থেকে সুস্পষ্ট রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের অবস্থানের পক্ষে এসব যুক্তিই কমবেশি কাজ করছে।

প্রসঙ্গত বলতেই হয়, এত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণের মনে একটা ধারণা ছিল যে, চীন ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া অন্য বিষয়ে নাক গলাতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু সেই ধারণাও পাল্টাচ্ছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে রেহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। ক‚টনৈতিক সূত্রে থেকে পাওয়া পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এই চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করেন। তিনি রাজধানী নেপিডোতে অং সান সু কির সঙ্গে যেমন বৈঠক করেন, তেমনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গেও কয়েক দফা বৈঠক করেন। এরই ফলাফল হচ্ছে চুক্তি। এমনটা করে চীন এটা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, দুই দেশই চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে তৃতীয় পক্ষ আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে আন্তর্জাতিক শক্তির উপস্থিতি চীন চাইছে না। যদি ওই খবরের সবটা সত্য হয় আর ওপরে উল্লিখিত ভারতের সঙ্গে টানাপড়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়, তবে বাংলাদেশ বর্তমান দিনগুলোতে কোন ধরনের উচ্চ চাপের মধ্যে রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

সর্বোপরি এই দ্বিমুখী চাপটা বুঝতে হবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে। নবজাত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আমলে ঠাণ্ডাযুদ্ধ যুগে বিশ্ব ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও আমেরিকার নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক বিশ্ব। ক্ষুদ্র এ কলামে বেশি কথায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলতে হয়, তখন আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর ছিল দ্বিমুখী চাপ। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা এবং পাকিস্তানি আমলে আন্দোলন-সংগ্রাম বামমুখী হওয়ার কারণে দেশ ছিল সোভিয়েতের দিকে। তবু খাদ্যসহ নানা সমস্যার মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পরিস্থিতির কারণে আমেরিকার কাছে যাওয়া ছাড়া দেশের সামনে বিকল্প ছিল না। বঙ্গবন্ধু দেশের ভেতর সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ করেও ইসলামি সম্মেলনে যান। পরবর্তীতে বন্যার পর উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে খাদ্য জাহাজ বিলম্ব করার ভেতর দিয়ে বুঝা যায়, চাপটা এক সময় সর্বতোভাবে হয়ে যায় যড়যন্ত্র-চক্রান্ত। ফলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখা বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিপ্লব, একদল প্রভৃতি সবই ছিল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলা করে ভারসাম্য রক্ষার সংগ্রাম। কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, দেশের ভারসাম্যের ভরকেন্দ্র হত্যা-ক্যু ও প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সামরিক শাসনের ভেতর দিয়েই অগ্রসর হয়।

এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের ভেতর দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বের সৃষ্টি হয় এবং মনে করা হতে থাকে এটাই মানবজাতির ললাট লিখন। কিন্তু বিশ্ব তথা আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা, টুইন টাওয়ার ধ্বংস, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ কার্যত বিফল হওয়া, দেশে দেশে উগ্র ধর্মীয় জাত্যাভিমান জাগ্রত হওয়া প্রভৃতির পর বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। বিশেষভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। বাধ্য হয়ে আমেরিকা যখন লম্বা ও বহু হাত গুটিয়ে আমেরিকামুখী হচ্ছে, তখন এককেন্দ্রিক বিশ্ব আর থাকছে না।

বহুকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। আমেরিকার সঙ্গে বৃহৎ শক্তি হিসেবে কেবল বড় দেশ চীন রাশিয়া ভারত প্রভৃতি দেশই দাঁড়াচ্ছে না, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশও বিশ্ব ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। এককথায় বলা যায়, ঠাণ্ডাযুদ্ধের পর রাশিয়ার শূন্যস্থান পূরণ করতে চলছিল আমেরিকা, কিন্তু তা স্থায়ী না হয়ে এখন আমেরিকার শূন্যস্থান পূরণে নেমেছে বিশেষভাবে এশিয়ার এই অঞ্চলে চীন ও ভারত। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়ছে। দুই দেশই প্রভাব বলয় বাড়াতে তৎপর থাকছে। নতুন পলারাইজেশন বা অক্ষশক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্ধ শতক পার না হতেই উপমহাদেশে আমেরিকা-চীন-পাকিস্তান অক্ষ ও ভারত-সোভিয়েত অক্ষ অপসৃত হয়ে আমেরিকা-ভারত ও চীন-পাকিস্তান অক্ষ অবস্থান নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনিয়োগের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ, অপেক্ষাকৃত সুলভে পণ্য ও অস্ত্র উৎপাদনে সাফল্য, আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহারে অগ্রগতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রভৃতির কারণে চীন নানা প্রতিক‚লতার মধ্যেও নিজ সক্ষমতার প্রমাণ রাখছে।

এই অবস্থায় ভ‚-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রসরমান ও গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ যে রয়েছে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে তা কিন্তু অনুমানের অপেক্ষা রাখে না। এক সময় কেউ কেউ মনে করতেন, বাংলাদেশে শক্তিশালী ও বৃহৎ সেনা-বিমান-নৌবাহিনীর প্রয়োজন নেই। কিন্তু মিয়ানমারের ঘটনা বিশেষত হেলিকপ্টারের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা ঘটনার পর দেখা যাচ্ছে, বর্তমান অবস্থা আগের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তদুপরি বাংলাদেশের প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগের জন্য অর্থ। চাই কম পয়সায় পণ্য। এই অবস্থার মধ্যে প্রভাব বলয়ের চাপ সামলানো আসলেই কঠিন ও জটিল এক বিষয়। সর্বোপরি বাংলাদেশের ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে, সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রু তা নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ও পরীক্ষিত বন্ধু বিধায় ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নীতিকে বাংলাদেশ অধিকতর গুরুত্ব দেয়। এদিকে বাংলাদেশের জনমনস্তত্তে¡র প্রধান দিক হলো, একেবারে কোনো এক বিশেষ দেশমুখী না হওয়া। এই অবস্থায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারসাম্য সুরক্ষার বিষয়টা খুবই জরুরি ও অবশ্য পালনীয় বিষয়।

রাজনীতিতে একটা কথা আছে যে, ভারসাম্যের ভরকেন্দ্র সদা চঞ্চল। আগু পিছু ডান বাম কখন কী হবে তার সবটা কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠী মহল দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর তা নির্ভর করে না। তবে প্রভাবিত করতে পারে। তাই সদা সর্বদা ভারসাম্যের ভরকেন্দ্র খুঁজে নেয়াটা রাজনীতির আর্ট ও বিজ্ঞান। যিনি বা যে দল তা সঠিকভাবে করতে পারে, তার মাথায়ই পড়ে বিজয়ের মুকুট। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বর্তমান সময় পর্যন্ত ক্ষমতাসীন জাতীয় মূলধারার রাজনৈতিক শক্তি ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে সফল হয়েছে। কিন্তু সামনে নির্বাচন। তাই নানামুখী চাপ স্বভাবতই বাড়বে। দেশ রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারায়। তবে ভোটে সব দলের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে রয়েছে সমস্যা। আর উগ্রতা সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বৃদ্ধি আর সেই সঙ্গে নৈতিকতার অবক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে দেশ। সামনে আসছে বিজয়ের মাস। সর্বোপরি ২০২১ সালে সশস্র  সংগ্রামের ভেতর দিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর বছর পালিত হবে। এই অবস্থায় ক্ষমতাসীন জাতীয় মূলধারার রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব বিভিন্নমুখী চাপের মুখে কতটা ভারসাম্য রক্ষা করে অগ্রসর হতে পারবে, তা দিয়েই নির্ভর করবে দেশ কোন পথে যাবে।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App