×

মুক্তচিন্তা

আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের দায়

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০১৭, ০৬:৩৬ পিএম

চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিয়ম ও আইন সেবাগ্রহীতার সুবিধার দিক বিবেচনা করেই হওয়া উচিত। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নে ও নিয়ন্ত্রণের সময় সবাই অন্তত খাদিজা আক্তার, পারভীন আক্তারদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্টটা একটু অনুভব করার চেষ্টা করবেন- এমনটাই প্রত্যাশা করছি।

সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ব্যাপারে আমাদের অনেকের ধারণাই নেতিবাচক। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার পাঠকদের কাছে প্রশ্ন ছিল ‘চিকিৎসাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে করণীয় কী?’ প্রায় সব পাঠকই এই ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেছেন যে আমাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার অভাব প্রকট; ফলে চিকিৎসাব্যবস্থায় মানুষের আস্থা বিলীয়মান। এবং যার প্রায় সম্পূর্ণ দায় চেপেছে চিকিৎসকদের ওপর। নিঃসন্দেহে ডাক্তারি একটি মহান পেশা। প্রশ্ন হচ্ছে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই বিশৃঙ্খলার পেছনে চিকিৎসকদের দায় কতটা? তার আগে জানতে হবে আমাদের দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নেও নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসকরা কতটা সম্পৃক্ত।

আমাদের ইদানীংকার ঘটনাই বেশি মনে থাকে। তার মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা আমাদের ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রথমটি কুমিল্লার খাদিজা আক্তারের। তার গর্ভে দুটি সন্তান থাকলেও গত ১৮ সেপ্টেম্বর চিকিৎসক অপারেশন করে একটি সন্তান বের করেন এবং অন্যটি টিউমার বলে অপারেশন শেষ করেন। বাড়িতে যাওয়ার পর দীর্ঘ এক মাস তার পেটে ব্যথা ছিল। পরে পেটের ব্যথা বাড়তে থাকলে খাদিজা উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ২৫ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। দ্বিতীয় অপারেশনের পর তার গর্ভে থাকা অন্য সন্তান মারা যায়। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঢাকার পারভীন আক্তারের। গত ১৬ অক্টোবর প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, পরে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তার কাছে ১৫শ টাকা চাওয়া হয়। টাকা না দেয়ায় সেখান থেকে তাকে অন্য কোথাও যেতে বলা হয়। পরদিন তাকে নেয়া হয় আজিমপুর মেটারনিটিতে। কিন্তু হাসপাতালের একজন আয়া চিকিৎসা হবে না বলেই তাকে টেনে দোতলা থেকে নিচে নামায়। হাসপাতাল থেকে বের হতেই প্রসব বেদনায় রাস্তার ওপর বসে পড়ে সে এবং সেখানেই সন্তানপ্রসব করে। প্রথমে নড়াচড়া করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই নবজাতক নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কখনো একটি জন্ম যে মৃত্যুর মতোই শোকাবহ হতে পারে, ওই ঘটনা তা আরেকবার প্রমাণ করল।

অনেকেই মনে করেন মহান সৃষ্টিকর্তার পরেই চিকিৎসকের স্থান। এই শিশু দুটির মৃত্যুর জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? চিকিৎসককে না চিকিৎসাব্যবস্থাকে? নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রেখে বলেছিলেন, ‘এটি একজন মানুষের জন্য ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য এক বিশাল অগ্রযাত্রা’। ওপরের ঘটনাগুলো হয়তো সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে নাম না জানা দুটি শিশুর মৃত্যু, কিন্তু মানবতার ওপর তা এক বিশাল কালিমা! পরিসংখ্যান বলছে, সারাবিশ্বে প্রতি বছর ৪০ লাখ শিশু জন্মের প্রথম ২৮ দিনের মধ্যেই মারা যায়। কিন্তু সারাবিশ্বে কতজন মা’কে টাকার অভাবে রাস্তায় সন্তানপ্রসব করতে হয়?

আমাদের মেট্রোপলিটন শহরগুলো এখন আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর উড়াল সেতু দিয়ে মোড়ানো। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার; গত অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশ। খাদিজা বা পারভীনের মতো সাধারণ মানুষ যারা এই দেশে বাস করে, তারা নিশ্চয়ই এই দেশ নিয়ে গর্ব করে। পেটে সন্তানকে রেখেই সেলাই করে দেয়ার পর খাদিজা যখন দীর্ঘ ৩৭ দিন পেটে ব্যথার যন্ত্রণা সহ্য করে ছিল, কিংবা ৯ মাস ১০ দিন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে প্রসব বেদনায় ছটফট করতে করতে পারভীন যখন ঢাকা শহরের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরছিল, তখন নিশ্চয়ই তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল জীবন কত কঠিন!

বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে। যে জাতি যত উন্নত হবে তার স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার তত প্রয়োজন হবে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও এই তিনটি বিষয়কে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। অনেকেই মনে করেন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে সরকারি খরচে পড়াশোনা করে যারা ডাক্তার হচ্ছেন, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। আচ্ছা, সরকারি মেডিকেল কলেজ ছাড়া অন্য সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি খরচে পড়াশোনা করে যারা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নিয়োগ পাচ্ছেন, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন তো?

চিকিৎসা ক্ষেত্র একটা ব্যবস্থাপনা যেখানে প্রশাসক, ব্যবস্থাপক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই সম্পৃক্ত। একটি হাসপাতালে ডাক্তারদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ট্রেড ইউনিয়নের নামে হাসপাতালের ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপতৎপরতা চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমাদের সমস্ত অর্জনকে স্লান করে দিতে পারে। তবে এটাও ঠিক, কিছু অসৎ কর্মীদের অপতৎপরতা সত্ত্বে ও আমাদের অনেক হাসপাতাল সেবা প্রদানে আন্তরিক। হয়তো এ কারণেই বারডেম হাসপাতালে প্রতিদিন তিন হাজার রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে; হয়তো এ কারণেই জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের জীবন রক্ষাকারী ইনজেকশন বিনামূল্যে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।

সমাজে সাধারণত যারা নিয়ম ও আইন তৈরি করেন, সেটা তারা নিজেদের সুবিধার দিক বিবেচনা করেই করেন। তবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিয়ম ও আইন সেবাগ্রহীতার সুবিধার দিক বিবেচনা করেই হওয়া উচিত। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নীতিমালা প্রণয়নে ও নিয়ন্ত্রণে যারা আছেন, ধারণা করি সবাই স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা নন; অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই আছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নে ও নিয়ন্ত্রণের সময় তারা সবাই অন্তত খাদিজা আক্তার, পারভীন আক্তারদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্টটা একটু অনুভব করার চেষ্টা করবেন- এমনটাই প্রত্যাশা করছি।

নজরুল ইসলাম : শিক্ষক, লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App