×

মুক্তচিন্তা

আত্তীকৃত শিক্ষকদের ক্যাডার মর্যাদা কতটা যৌক্তিক?

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০১৭, ০৬:৫০ পিএম

বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা জেনেশুনেই সেই চাকরি গ্রহণ করেছেন। তারা স্বপ্নেও ভাবেননি কোনোদিন তারা ক্যাডার হবেন। তাদের অদেখা স্বপ্নকে কারা, কেন, কী কারণে বাস্তবে রূপ দিতে চাচ্ছে এ বিষয়ে সরকারকে মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষাকে ধ্বংস করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা হলে এর পরিণাম অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে বলেই শিক্ষাবিদরা মনে করছেন।

অভিমত

একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্যই থাকে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশ ও জাতির জন্য অবদান রাখা। এ ক্ষেত্রে স্ব-স্ব বিষয়ে দক্ষ শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করেন। সবাই সব চাকরি পছন্দ করেন না। আবার সবার ভাগ্যেই মিলে না তার কাঙ্খিত পদ-পজিশন। তবু মানুষ একটা পর্যায়ে গিয়ে প্রতিকূল বাধা-বিপত্তি মেনে নিয়ে কর্মজীবনে থিতু হয়। পৃথিবীর সব দেশেই এমন চিত্র দৃশ্যমান।

ব্যক্তিগত জীবনে আমি একজন শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১১ সালে যোগদান করি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে। জীবনে স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবো। শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করে সাধ্যমতো চেষ্টা করছি নিজ পেশার পবিত্রতা রক্ষা করতে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশায় কোনো আকর্ষণীয় সুযোগ নেই। নেই তেমন কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা। তবু জেনেশুনেই এ পেশায় নিজেকে হাসিমুখে মানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই বিষময় হয়ে উঠছে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের জীবন। চাকরির শুরুতেই আমি আমার প্রথম কর্মস্থলে অধ্যক্ষ হিসেবে পাই একজন আত্তীকৃত শিক্ষককে। নবীন শিক্ষক হিসেবে আমার যে কিছু দোষ-ত্রুটি ছিল না তা নয়, আমি দেখতাম আমার অধ্যক্ষ আমার ত্রুটি সংশোধন না করে আমাকে ও আমার মতো আরো অনেক শিক্ষককেই শাস্তি দিতেন ও বেদনাদায়ক কথা শোনাতেন। এই অভিজ্ঞতা পরে আরো অনেক জায়গায় লাভ করেছি। আমার জীবনের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমি এখন পর্যন্ত একজনও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সরাসরি সদস্যকে অধ্যক্ষ হিসেবে পাইনি। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যত সরকারি কলেজ আছে, তার বেশিরভাগ কলেজেই আত্তীকৃত শিক্ষকরা অধ্যক্ষ পদে আসীন। এই আত্তীকৃত শিক্ষকদের সঙ্গে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চিন্তা-চেতনা ও পেশাগত দক্ষতায় থাকে আকাশ-পাতাল ফারাক। এগুলো বাইরে থেকে ততটা বোঝা যায় না, যতটা কাছে থেকে অনুভব করা যায়।

বিসিএস পরীক্ষা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে যেসব যোগ্যতা লাগে সেই যোগ্যতার মাপকাঠি নতুন করে ব্যাখ্যা দেয়ার কিছু নেই। আজ যখন দেখি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাডার কর্মকর্তার চেয়ে আত্মীকৃতরাই বেশি লাভবান তখন নিজের সান্ত¡নার জন্য কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। আজ অনেকেই বলছেন বেসরকারি শিক্ষকই যদি শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন, তাহলে বিসিএস পরীক্ষার এই প্রহসন কেন?

আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শুরু থেকেই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার নানাবিধ দুর্বলতা ও অপুষ্টিতে ভুগতে ভুগতে এখন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সরকার চাইলেই শিক্ষা ক্যাডারের এই মৃত্যুকে পরাস্ত করতে পারেন, কিন্তু সরকার তো শিক্ষকরা চালায় না, চালায় আমলারা ও তাদের পোষ্যরা। আমলাদের আত্মঘাতী পরামর্শে দেশের সব সরকারি কলেজে আজ সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হচ্ছে, ছাত্রসমাজ পতিত হচ্ছে এক সীমাহীন দুর্ভোগে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যত পরিসংখ্যানই দেখানো হোক না কেন- বাংলাদেশের কোনো স্তরের (প্রাথমিক/মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক/বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষাই মানসম্পন্ন নয়। হওয়ার কথাও নয়। শিক্ষা নিয়ে এখন যেসব বুদ্ধিজীবী আমলা নানারকম কথা বলছেন, সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা বুঝেন বলে মনে হয় না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সাবেক এক আমলার একক বক্তব্য শোনার একটা দারুণ সুযোগ পেয়েছিলাম নায়েমে ট্রেনিংরত অবস্থায়। এরপরেও বিভিন্ন জায়গায় তার বক্তব্য শুনেছি। তার কোনো বক্তব্যই আমার কাছে কখনো স্পষ্ট মনে হয়নি। তিনি শিক্ষা বুঝেন, আইন বুঝেন, প্রযুুক্তি বুঝেন- এমন কি রাষ্ট্র পরিচালনার কলাকৌশলও বুঝেন বলে নিজে মনে করেন। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারছি তার নানারকম ছল-চাতুরির গোপন কথা। তিনিই প্রকারান্তরে শিক্ষা ক্যাডারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়ে গেছেন বলে অনেকে মনে করছেন। তিনি এক টেলিভিশন বিবৃতিতে যা বলেছেন, তার মূল কথা হলো- সরকারি কলেজে পড়ানোর জন্য বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক দরকার, রাজনীতির জন্য দরকার বেসরকারি শিক্ষকদের। কেন তিনি এমন কথা বলেছেন, কার স্বার্থে বললেন, তা আজ মোটামুটি স্পষ্ট।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কী পরিমাণ বঞ্চনা সহ্য করে জীবন পার করছে তা জাতির জানা দরকার। এই বঞ্চনার কিছু দৃশ্য অনুমান করা যাবে, যদি কোনো একটি উপজেলার একজন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা, একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা, একজন পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তার দিকে তাকাই। জেলার দিকে তাকালে এই পার্থক্য আরো বড় হয়। বিভাগের দিকে তাকালে তো হিসাব করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার এখন যে সাইজে আছে সেই সাইজকে ঠিকমতো ভরণ-পোষণ করাই সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সাইজ যখন দ্বিগুণ হবে তখন এই ক্যাডারের পরিস্থিতি হবে ছিন্নমূল শরণার্থীদের মতোই ভয়াবহ। কেন ভয়াবহ হবে? তার অনেকগুলো বাস্তব কারণ আছে। তখন জুনিয়রা সিনিয়র হবে, পদের সংকট তীব্র হবে, বৈষম্য গগনচুম্বী হবে, হতাশা বাড়বে। মুখ থুবড়ে পড়বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরের (উচ্চ মাধ্যমিক) শিক্ষা কার্যক্রম। এটি কোনোভাবেই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা জেনেশুনেই সেই চাকরি গ্রহণ করেছেন। তারা স্বপ্নেও ভাবেননি কোনোদিন তারা ক্যাডার হবেন। তাদের অদেখা স্বপ্নকে কারা, কেন, কী কারণে বাস্তবে রূপ দিতে চাচ্ছে এ বিষয়ে সরকারকে মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষাকে ধ্বংস করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা হলে এর পরিণাম অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে বলেই শিক্ষাবিদরা মনে করছেন।

বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ পদ্ধতি ও মান নিয়ে কথা বলতে চাই না। শুধু একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। সম্প্রতি ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) এক জনসভায় হাজার হাজার মানুষের সামনে বলেছেন, তার নির্বাচনী এলাকা সদরপুরের একটি (আমার সাবেক কর্মস্থল) মহিলা কলেজে শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সেই কলেজের সভাপতি কোটি টাকার ওপরে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। শুধু সদরপুর নয়, বেসরকারি কলেজে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরো বাংলাদেশের চিত্র একই রকম। দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের যদি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষকদের চেয়ে উচ্চ বা সমমর্যাদায় আত্তীকরণ করা হয়, তাহলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কেন এই অন্যায় মেনে নেবে? অতীতে এরকম অন্যায় মেনে নেয়া হয়েছে বলে বর্তমানেও মেনে নিতে হবে?

একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আমার প্রাপ্য সম্মান চাইতেই পারি। এটি আমার পেশাগত অধিকার তো বটেই মৌলিক ও মানবিক অধিকারও। আজ যখন দেখি আমার সেই স্বপ্ন ভ‚লুণ্ঠিত হচ্ছে তখন প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া আমার আর কি করার থাকতে পারে? বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৩৩৫টি সরকারি কলেজে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা রয়েছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে। নতুন করে ২৮৩টি বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করা হলে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা। তাদের মনোবল ভেঙে যাবে, বিতৃষ্ণা জন্মাবে নিজ পেশায়। মানহীন হয়ে পড়বে সরকারি কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা। এমন এক সংকটকালে প্রধানমন্ত্রীই পারেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের দাবি মেনে সুন্দর সমাধান দিতে। শুধু বিসিএস শিক্ষা সমিতি নয়, পুরো দেশ এখন প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের দিকেই আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

বর্তমানের কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই- ৩৩তম বিসিএসে যোগদান করা আমার এক মেধাবী সহকর্মী হতাশ হয়ে ইতোমধ্যেই চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ৩৪তম বিসিএসের গণিত বিভাগের আরেক শিক্ষক বিদেশে পাড়ি দিতে কাগজপত্র তৈরি করছেন। ব্যবস্থাপনা বিভাগের আরেক সহকর্মী এর মধ্যেই চেষ্টা করছেন একটি নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে। এরকম উদাহরণ অনেক দেয়া যেতে পারে। জাতির মেধাবী সন্তানরা এখন এমনিতেই শিক্ষা পেশায় আসতে চাচ্ছে না- এর মধ্যে যদি শিক্ষা ক্যাডারে অন্ধকার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, তাহলে এর পরিণাম কত ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমেয়। গত ২৪ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে স্মরণকালের সবচেয়ে বৃহৎ মহাসমাবেশ করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। এই সমাবেশ থেকে যেসব সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপিত হয়েছে সেসব দাবি মেনে নিয়ে সরকার বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের মূল্যায়ন করে দেশের চলমান শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল রাখবেন বলেই আমি ও আমার সম্মানিত সহকর্মীরা প্রত্যাশা করেন।

সৈয়দ জাহিদ হাসান : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App