×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতি কোন পথে?

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:৩২ পিএম

আত্মনির্ভরতার নীতি নিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক উন্নত করে বাংলাদেশ শক্তিশালী হতে পারে। দেশের রাজনীতি গণমুখী হলে, বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা চালালে জনজীবনের সমস্যাবলির পর্যায়ক্রমিক সমাধান সম্ভব হবে। রাজনীতি গণমুখী হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থাকে অনেক উন্নত করা যাবে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা বাংলাদেশে ভালো অর্থে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হবে।

রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভালো চলছে না। বাংলাদেশে রাজনীতির উন্নতি দরকার। তার জন্য প্রথমে দরকার চলমান কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া। ১৯৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে ডিপলিটিসাইজেশন (depoliticization) বা ‘নিঃরাজনীতিকরণ’ বা ‘বিরাজনীতিকরণ’ কথাগুলো অনেকে উচ্চারণ করেন। কিন্তু ডিপলিটিসাইজেশন বা নিঃরাজনীতিকরণ ব্যাপারটা কী তা ব্যাখা-বিশ্লেষণ করে কেউ দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট করেননি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বামপন্থী দলগুলো মনে হয় ১৯৮০’র দশক থেকেই অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে চলছে নিঃরাজনীতিকরণের ধারা ধরে। সিএসওগুলো (সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশন) নিঃরাজনীতিকরণে সক্রিয় আছে। প্রচার মাধ্যমও সেই ধারায় কাজ করছে।

১৯৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে গণতন্ত্রকে বলা হচ্ছে উদার গণতন্ত্র। ‘গণতন্ত্র’ কী ছিল? ‘উদার গণতন্ত্র’ কী? এ নিয়েও কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। অনেকেই তোতা পাখির মতো ‘উদার গণতন্ত্র’ কথাটা উচ্চারণ করেন এবং সব রাজনৈতিক দল বিশ্বব্যাংকের কর্মনীতি অনুসরণ করে চলে। গত প্রায় চার দশক ধরে উদার গণতন্ত্র নিয়ে নিঃরাজনীতিকরণের বা ডিপলিটিসাইজেশন (depoliticization)-এর কর্মনীতি বাস্তবায়িত হয়েছে।

রাজনীতিতে ‘মৌলবাদ’ ও ‘মৌলবাদ-বিরোধী’ দুই প্রতিদ্ব›দ্বী শক্তি পাল্টাপাল্টি আছে। তবে আগের তুলনায় দুই পক্ষেরই কণ্ঠস্বর কিছুটা নিম্ন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ নিয়েও বিতর্ক চলছে। সমাজতন্ত্রের কথা সংবিধানে বেশ বড় জায়গা নিয়ে লেখা থাকলেও সমাজতন্ত্র নিয়ে দেশে কোনো চিন্তা বা কাজ নেই। সংবিধানে বর্ণিত গণতন্ত্র নিয়েও কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। উদার গণতন্ত্র মানে নির্বাচন- বলা যায় নির্বাচনতন্ত্র। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে কথা চালাচালি চলে, তাতে গণতান্ত্রিক মানসিকতার কোনো পরিচয়ই পাওয়া যায় না। গণতন্ত্র সম্পর্কে দুই দলের ধারণাই এক ও অভিন্ন। দল দুটোর ভেতরেও গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও আচরণ নেই। আওয়ামী লীগের ভেতরে দলীয় ঐক্য দুর্বল, উপদলীয় সংঘাত-সংঘর্ষ আছে। বিএনপির মধ্যেও ঐক্যের অভাব আছে। ক্ষমতার স্বাদ নেয়ার ভাবনা ছাড়া দলের ভেতরে তো কোনো নীতি-আদর্শ নেই। এ অবস্থায় দলগুলোর একনায়কত্ববাদী চরিত্র লাভ খুব স্বাভাবিক। চলমান রাজনীতিতে নেতা যতটা একনায়কত্ববাদী, অনুসারীরা নেতাকে তার চেয়ে অনেক বেশি একনায়কত্ববাদী করে তুলতে তৎপর।

জুলুম-জবরদস্তির ও ভয়-ভীতির সংস্কৃতি সর্বস্তরে বিরাজমান। অসামাজিক কার্যকলাপ বেড়ে চলছে। জাতিগঠন, রাষ্ট্রগঠন ও জনজীবনের সমস্যাবলির সমাধান কোনো নেতার, কোনো দলের, দলীয়ভাবে সক্রিয় কোনো বুদ্ধিজীবীর বা বিশিষ্ট নাগরিকের বিবেচনায় নেই।

প্রধান দুই দলের রাজনীতি বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অভিমুখী। গণতন্ত্র চাওয়ার জন্য তারা জনগণের কাছে না গিয়ে এই দূতাবাসগুলোর দিকে ছোটাছুটি করে। গণতন্ত্র চাইতে তারা ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে চলে যায়।

বাংলাদেশের জনগণ ভাঁওতায় সাড়া দেয়, হুজুগে মাতে। বাঙালিকে বলা হয় হুজুগে বাঙালি। রাজনৈতিক দলগুলো সহজেই জনসাধারণকে স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করতে পারে। জনসাধারণ ঘুমন্ত- চেতনাহীন। টাকাওয়ালাদের টাকা, পেশিশক্তি ও বিদেশি শক্তির পরিকল্পনার সামনে জনগণ অসহায়।

ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এতটা সক্রিয় ছিল না। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী ভারতবিরোধী শক্তি বাংলাদেশে কয়েক বছর ক্ষমতাসীন ছিল। কিন্তু দেখা গেল তাতে ভারতের নিরাপত্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এবং অভ্যন্তরীণ অনৈক্যের দিক থেকে হুমকিতে পড়ে। ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কে আছে। তা সত্তে¡ও ভারত বাংলাদেশে ভারতবিরোধী যুক্তরাষ্ট্রপন্থী কোনো শক্তিকে ক্ষমতায় আসতে দিতে চায় না। বাংলাদেশে কারা সরকার গঠন করবে, তা নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা আছে। এখন কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতাসীন হবে, তা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যুক্তভাবে পরামর্শ করে ঠিক করবে। যদি তা হয়, তাহলে তা দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতি উন্নত হবে না, কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এজেন্টরা লাভবান হবে। রাজনীতি সুস্থ হলে সবার জন্য মঙ্গলকর হবে।

ডিপলিটিসাইজেশন (depoliticization) আসলে এনার্কিজম (anarchism)। উনিশ শতকের মধ্য পর্বে এনার্কিজম বা নিঃরাষ্ট্রকরণের মতবাদ ইউরোপে দেখা দেয়। তখন তা ছিল সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারারই এক শাখা। মার্কসবাদের সঙ্গে তার ছিল প্রতিযোগিতা। এনার্কিজমের প্রবক্তা বাকুনিন ছিলেন আজীবন কার্ল মার্কসের প্রতিদ্বন্দ্বী। এনার্কিস্টরা চাইতেন, রাষ্ট্রকে যথাসম্ভব দুর্বল রাখতে, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে যথাসম্ভব দুর্বল রাখতে। তারা চাইতেন স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। ব্যক্তির স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, মানবিক গুণাবলির বিকাশ, বহুত্ববাদ ইত্যাদি ছিল তাদের কাম্য। তাদের প্রতিপক্ষ সব ধারা থেকে তাদের চিন্তাকে বলা হতো অবাস্তব, অবান্তর। আসলে বিচার করতে গেলে দেখা যায়, এনার্কিজমের দর্শন অবলম্বন করে কোনো সমাজব্যবস্থা গঠন করতে গেলে তা দার্শনিকদের ঘোষিত উদ্দেশ্যের ধারে কাছেও থাকবে না, তাতে দেখা দেবে এমন এক ব্যবস্থা যাকে বলা যায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’।

এখন নিঃরাজনীতিকরণ বা নিঃরাষ্ট্রকরণ বা এনার্কিজম অবলম্বন করে বিশ্বায়নবাদী মহল যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাইছে তাও কেবল শক্তিমানদের ও ধনীদের স্বার্থে। সাধারণ মানুষ তাতে কেবল প্রতারিত ও বঞ্চিত হবে। দরকার বহুত্বমূলক ঐক্য বা সমন্বয়। কিংবা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। বৈচিত্র্য বা বহুত্ব এবং ঐক্য- দুটোতেই যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। বহুত্ববাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য বিলুপ্ত করা হচ্ছে, নিঃরাজনীতিকরণ বা নিঃরাষ্ট্রকরণের দিকে অগ্রগতি হচ্ছে। এটা এমন এক অবস্থায় নিয়ে যাবে এতে দেখা দেবে ‘জোর যার মুল্লুক তার’।

এতক্ষণ আমি বর্তমান ব্যবস্থার কেবল নেগেটিভ দিকগুলো দেখালাম। এ ধারায় উল্লেখ করার মতো আরো অনেক বিষয় আছে। আমাদের দরকার পজিটিভ সম্ভাবনাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া। সেদিকে দৃষ্টি দিতে গেলে বিরাট বিপুল সম্ভাবনাও বাংলাদেশের অনেক আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে সম্ভাবনা অফুরন্ত। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাবনা কেবল কৃষিতে সীমাবদ্ধ নয়- খনিজসম্পদ অনেক আছে। ভ‚রাজনৈতিক দিক দিয়েও বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় আছে। আত্মনির্ভরতার নীতি নিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক উন্নত করে বাংলাদেশ শক্তিশালী হতে পারে। দেশের রাজনীতি গণমুখী হলে, বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা চালালে জনজীবনের সমস্যাবলির পর্যায়ক্রমিক সমাধান সম্ভব হবে। রাজনীতি গণমুখী হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থাকে অনেক উন্নত করা যাবে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা বাংলাদেশে ভালো অর্থে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হবে।

কথিত লিবারেল ডেমোক্রেসি বা নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্র দিয়ে হবে না, গণতন্ত্রের ধারণাকে পুনর্গঠিত করে সর্বজনীন গণতন্ত্রের বা শতভাগ মানুষের গণতন্ত্র উদ্ভাবন করতে হবে এবং তার বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। সে ধারার সূচনা করা হলে দেশে গণজাগরণ দেখা দেবে। তখন জনজীবনের সম্ভাবনা প্রতিভাত হবে। বিশিষ্ট নাগরিকরা, এনজিওপতিরা এবং বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব সে ধারায় একটুও চিন্তা করছেন না। তারা গত প্রায় চার দশক ধরে উদার গণতন্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে, নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করায়, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে। গত দুই বছর ধরে তারা দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথাও বলছেন।

যে অবস্থা চলছে তাতে বিরাট বিপুল সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রচিন্তার ও রাজনীতির উন্নতি দরকার। তার জন্য রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন দরকার। স্ট্যাটাস-ক্যু (Status quo)-তেও পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। স্ট্যাটাস-ক্যু (Status quo) সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখে অবস্থার উন্নতি অল্পই করা যাবে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : চিন্তাবিদ ও অধ্যাপক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App