×

মুক্তচিন্তা

বসনিয়া থেকে রাখাইন স্লাডিক থেকে অং লাইং

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:২৪ পিএম

লন্ডন থেকে

বসনিয়া হারজেগোভিনা- মূলত বসনিয়া হিসেবেই পরিচিত দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এই দেশটা পৃথিবীর রক্তাক্ত ইতিহাসের আরেকটা নাম। আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকা সত্তে¡ও একটা জাতির স্বাধীনতার প্রশ্নে রেফারেন্ডাম কিংবা গণভোটকে প্রত্যাখ্যান করে তৎকালীন বসনিয়ার সরকার এবং সেই থেকে তারা শুরু করে একটা জাতি নিধন। মূলত মুসলিম জাতিসত্তার ওপর শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ, মুসলিম সম্প্রদায় নিধন। শুরু হয় যুদ্ধ। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫- বসনিয়ার সার্ভ সেনা কমান্ডারের নির্দেশে শুরু হয় ইতিহাসের এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ। কেঁপে ওঠে বসনিয়া, বন্দুক আর বোমার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হতে থাকে বসনিয়ার প্রতিটি দিন, প্রতিটা রাত। একটা পাশবিক নেশা নিয়ে গগনবিদারী চিৎকারকে উল্লাসে রূপ দিয়ে হত্যায় মেতে ওঠেন সেনা প্রধান রাটকো       স্লাডিক। এই তিন বছরে প্রায় দুলাখ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং প্রায় ৫০ হাজার ধর্ষণের নৃশংসতম ঘটনা ঘটে ওই সেনাপ্রধানের নির্দেশে এবং সরকারের সহযোগিতা কিংবা সমর্থন নিয়ে। ইউরোপের ইতিহাসে এরকম হত্যাযজ্ঞকে শুধুই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হিটলারের হলোকাস্ট হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

কিন্তু বাস্তবতা এতই নির্মম যে, স্লাডিককেও দাঁড়াতে হয় ইতিহাসের কাঠগড়ায়। তৎকালীন প্রধান যুদ্ধবাজদের সবাইকেই বরণ করতে হয় সভ্যতার অনিবার্য পরিণতি। সাবেক ইউগোস্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লবোডান মিলোসেভিক এবং বসনিয়ার সার্ভ নেতা রাডোভান কার্ডজিক সেই হত্যাযজ্ঞের চালিকাশক্তির আরো দুজন। মূলত এরাই চালিয়েছে নৃশংস অপরাধ-তাণ্ডব। ইতিহাসের সেই প্রবল পরাক্রমশালী খলনায়কদেরও আসতে হয় বিচারের আওতায়। কয়েকটা বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই দুজনকে বিচারের আওতায় নিয়ে এলেও নৃশংস প্রভাবশালী ‘বসনিয়ার কসাই’ (বুচার অব বসনিয়া) বলে কুখ্যাত স্লাডিক ছিলেন পলাতক। কিন্তু বিশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি মুক্ত হতে পারেননি। বীভৎস হত্যাযজ্ঞের কসাই হয়ে তাকে ফিরে আসতেই হয়েছে। ৭৪ বছর বয়সী স্লাডিককে দাঁড়াতে হয়েছে কাঠগড়ায়। মানবতাবিরোধী অপরাধ আর হত্যাযজ্ঞ চালানোর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ২২ নভেম্বর ‘বসনিয়ার কসাই’কে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বসনিয়ার নিপীড়িত মানুষ এতে স্বস্তি প্রকাশ করলেও স্লাডিককের যদি ১ হাজার বার যাবজ্জীবন হয়, তাও তার অপরাধের শাস্তি হবে না বলে মতপ্রকাশ করছেন সার্ভের স্বজনহারা মানুষ।

২. রাখাইন এরকমই আরেক বীভৎস উল্লাসের নগরী। বসনিয়ার স্লাডিকের মতোই মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং লাইং রাখাইনকে রোহিঙ্গাশূন্য করতে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। এবং সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নে তিনি চালিয়েছেন হত্যাযজ্ঞ-ধর্ষণ। তার নির্দেশেই জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। কসাই যেমন তার পেশাদারিত্ব চালায় প্রাণীর ওপর, ঠিক তেমনি লাইংও যেন এক জীবন্ত কসাই। মানুষ হত্যাই যেন তার পেশা, তাই তো তিনি পরিকল্পনা করেই মানুষ হত্যা করেছেন, ধর্ষণ করিয়েছেন। ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে বৌদ্ধদের দিয়ে মুসলিম নিধনে উসকানি দিয়েছেন। বিরান করে দিয়েছেন একটা জনপদ।

পশ্চিমা বিশ্ব কী-ই করল এতে। জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাব কি শরণার্থীদের ঢল ঠেকাতে পেরেছে বাংলাদেশে? নাফ নদীতে রক্তের স্রোতধারা কি বন্ধ হয়েছিল? রাখাইন থেকে যখন একটা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে, যখন আরাকানের মুসলমান বলে নিজেদের পরিচয় দেয়ার কেউ রইল না রাখাইনে, তখন যেন বিশ্ব সম্প্রদায় উঠে-পড়ে লেগেছে। রাখাইনে ওই ‘এথনিক ক্লিনজিং’ প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার পরই স্কাই নিউজ প্রথম ভালো কোনো প্রতিবেদন করেছে রাখাইন নিয়ে গত দিন দশেক আগে। কিন্তু যা হওয়ার তা-তো হয়ে গেছে। বিশ্বের মোড়লরা যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল, তা ৮০ ভাগ সফল হয়েছে। ৮০ শতাংশ বলছি এ কারণেই যে, তাদের হয়তো একটা ভিন্ন উদ্দেশ্যও কাজ করেছে এই ক্লিনজিং ইস্যুতে। রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পেছনে হয়তো অন্য কারণও ছিল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও উন্নয়নের একটা গতি আছে। কোটি কোটি মানুষের শ্রমে-ঘামে এ দেশটা বিশ্বে জায়গা করে নিচ্ছে। বিশ্বে বাংলাদেশ শুধুই বন্যা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে এখন চিহ্নিত নয়। আমরা গর্ব ভরেই উচ্চারণ করতে পারি আমাদের দেশের নাম, বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায়। রাখাইনের পাঁচ লাখ মুসলমানকে ঠেলে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের দিকে। নির্মম আর হিংস্রতায় মেতে উঠেছে যখন মিয়ানমারের সেনারা, ঠিক তখন শুধুই রাখাইনের জনগোষ্ঠীর নির্যাতিত হওয়ার চিত্র আমরা দেখেছি। বাংলাদেশে কিছু মানুষের প্রতিবাদ দেখে মনে হয়েছে এ দায় যেন বাংলাদেশ সরকারের। একটা অস্থিরতার আবরণ দিতে চেয়েছে বিশেষত মৌলবাদি গোষ্ঠী। আন্তর্জাতিক চক্রও হয়তো চেয়েছে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদ করুক এবং এ প্রতিবাদ এক সময় ছড়িয়ে যাক মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘর্ষে, যুদ্ধে। কিন্তু অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই বাংলাদেশ সরকার প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর লাফালাফিতে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়নি। কারণ রাখাইনের নির্যাতিত মানুষ মিয়ানমারের নাগরিক। এদের খুন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে। এই হত্যাযজ্ঞের বিপরীতে বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছে মানবিক দায়িত্ব নিয়ে। এটা শুধুই মুসলমান হিসেবে নয়। তাই বাংলাদেশ নয়, যদি কিছু করতেই হয়, বিশ্ব সম্প্রদায়কেই এর দায় নিতে হবে। এরও বাইরে যদি রাখাইনের অধিবাসীদের মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলে, তাও সেই দায় মুসলমান প্রধান দেশ হিসেবে শুধুই বাংলাদেশের নয়। সারা বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোকেই এর দায়ভারের অংশীদার হতে হবে। আর সে জন্যই ক‚টনৈতিকভাবেই বাংলাদেশ এর মীমাংসা চেয়েছে। সরকাররের উচ্চ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ দেন-দরবার চলছে, চেষ্টা চালাচ্ছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এখানেই বাংলাদেশের সার্থকতা। যুুদ্ধ নয়, ক‚টনৈতিক কৌশলই এখানে প্রধান। যা অত্যন্ত সার্থকভাবে করতে পেরেছে বাংলাদেশ।

৩. বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু কির আলোচনাটাও বাংলাদেশের জন্য একটা সফলতা। এ সফলতা কূটনৈতিক। এই ক‚টনৈতিক তৎপরতায়ই সামরিক ক্ষেত্রে ব্রিটেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের অবরোধ নিশ্চিত হচ্ছে। হয়তো সে কারণেই অন্তত আই ওয়াশের জন্যই হোক বাংলাদেশের সঙ্গে একটা গ্রহণযোগ্য আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হয়েছে মিয়ানমার সরকারকে। সেনা প্রধান ও লাইংয়ের রক্তাক্ত হাত শক্তিশালী করা রাখাইন হত্যাযজ্ঞের সহযোগী সু কি শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, মিয়ানমারের নাগরিকদের তারা ফেরত নেবেন। কিন্তু নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, এটা ব্যাখ্যার কোনো অবকাশই নেই। যে সেনা শাসকদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ১৯৮২ সালে এই সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে, যে সেনা শাসকের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে খুন-ধর্ষণে একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে রাখাইন থেকে, সেই শাসকদের ছায়ায় রোহিঙ্গারা নিজেদের কোনোভাবেই নিরাপদ ভাববে না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ মৃত্যুর ক‚প থেকে ফিরে আসা জন্তুও তো সেই মৃত্যুক‚পের কাছাকাছি যেতে চায় না। আর এই পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা তো মানুষ। তাছাড়া ক‚টনৈতিক আলোচনা সফল হলেও অং লাইং তো চীনে বসে এই ক‚টনৈতিক প্রক্রিয়াটাকে থোড়াই কেয়ার করছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক ঈঙ্গিত এখনো আসেনি। সে জন্য জাতিসংঘও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীই প্রধান বাধা।

৪. আন্তর্জাতিক রাজনীতি বড়ই কুটিল। কার প্রয়োজন কখন ফুরোয়, তা সময়ই বলে দেয়। গাদ্দাফিকে কখন কোলে তুলে নিতে হয়, কখন আসাদকে ছুড়ে মারতে হয়, তারা ঠিকই নির্ধারণ করে ফেলে। সৌদির সিংহাসনে কখন কোন ভাইকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বলি হতে হবে কিংবা কোন সময় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা ঘটাতে হবে, তা আন্তর্জাতিক রাজনীতি আমাদের ঠিকই জানিয়ে দিচ্ছে বারবার।

বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষরা ১৯৭১-এ বুকটান করে দাঁড়িয়েছিল। এরা যুদ্ধ করেছে। স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। কিন্তু রাখাইনের মানুষের সেই তেজ নেই, নেই তাদের কোনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, যাকে সামনে নিয়ে তারা এগুতে পারবে। আর হয়তো তাই ইতিহাসের পরিণতির দিকেই আমাদের চেয়ে থাকতে হবে। পলাতক জীবন কাটানো বসনিয়ার কসাই রাটকো স্লাডিককে বিশ বছর পরে হলেও আসতে হয়েছে বিচারের কাঠগড়ায়। অন্ধকার প্রকোষ্ঠই এখন তার শেষ আশ্রয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটকৌশলে এভাবেই একদিন হয়তো অং লাইং নিক্ষিপ্ত হবেন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। কিন্তু নৃশংসতার রাজনীতিতে যে জাতিটি নিশ্চিহ্ন হলো আজকের এই সভ্যতায়, হত্যা-ধর্ষণে মানবতা যেখানে মাটিচাপা পড়লা তার শেষ কি দেখবে আগামী বিশ্ব কোনোকালে। মানবতার স্লোগান নিয়ে কেউ কি কখনো জেগে উঠবে না, উড়বে না-কি কখনো শান্তির সুবাতাস রাখাইনে। কোনো বীজ থেকে কোনোদিন গজাবে কি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নতুন চারা? কোনো একদিন রোহিঙ্গারা কি ফিরে পাবে তাদের নাগরিক অধিকার, তারা কি ফিরে পাবে তাদের আবাস- এসব প্রশ্নের উত্তর তো এই সভ্যতায় আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App