×

মুক্তচিন্তা

দুই মন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হলাম, কিন্তু...

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:০০ পিএম

২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক হামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রায় ১০ হাজার ঘটনা ঘটেছে। এই দশ হাজার ঘটনার ক্ষেত্রে শতকরা এক ভাগ অপরাধীরও বিচার হয়নি, শাস্তি হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের সরকারের আমলে পরিচালিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার কেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হচ্ছে না এর কোনো হিসাব মেলাতে পারি না। দুই মন্ত্রীর কথায় আশ^স্ত হচ্ছি, ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের কথাটা তারা উল্লেখ করেছেন, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনার তত্ত্ব’ এখানে আসেনি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রংপুরে ঠাকুরপাড়া পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় হিন্দুপাড়ায় হামলা একসূত্রে গাঁথা। এসব পাশবিক হামলা একই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাজ। তিনি আরো বলেন, বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। এ সুসম্পর্ক নষ্ট করার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে যারা এ সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল রংপুরের ঠাকুরপাড়া পরিদর্শন করে এসে বলেছিলেন, ফেসবুকে উসকানিমূলক ছবি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে গভীর ষড়যন্ত্র। তিনি আরো বলেন, তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারিভাবে কিছু বলছি না। তবে আমরা মনে করছি এটা একটা ষড়যন্ত্র, সবকিছু আমরা টের পাচ্ছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইঙ্গিত দেন, কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ বিভিন্ন স্থানে একইভাবে ধর্মীয় উসকানি দিয়ে হামলা হয়েছিল। তার মতে, রংপুরের ঘটনায়ও ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। তিনি সরাসরি বলেন, আমাদের কাছে খবর রয়েছে ওই ঘটনার সঙ্গে জামায়াত, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি রয়েছে। এর আগে রংপুরের এসপি মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নির্বাচনের আগে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্য জামায়াত-শিবির এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

এই ষড়যন্ত্রের কথা আমরা গোড়া থেকেই বলে আসছিলাম। বিভিন্ন সময় আমাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জবাবে বলা হয়েছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আজ বাস্তবতা অনুধাবন হচ্ছে। নিশ্চয়ই মনে আছে, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপূজায় হামলা হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নির্মূল করার জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। পাকিস্তানি আমলে জারি করা শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করেন বঙ্গবন্ধু, কিন্তু তাকে হত্যার পর এটা মহাপরাক্রমে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের জমিজমা, বাড়িভিটা দখলের মহোৎসব শুরু হয়ে যায়। জিয়াউর রহমান শত্রু সম্পত্তি খুঁজে বের করার জন্য পারিতোষিকের ব্যবস্থা করেন। কীভাবে আমলারা মাঠে নেমে পড়েন, সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো আমরা দেখেছি। দেখেছি পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানের ইসলামিকরণ। যার ধারাবাহিকতায় অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে পূর্ণাহুতি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। সাম্প্রদায়িক হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, নির্যাতন-নিপীড়ন, অপহরণ করে ধর্মান্তর, জায়গা-জমি দখল এবং দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা নিয়মিত ও স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভোট দিলেও মার খায়, ভোট না দিলেও মার খায়। নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলে সংখ্যালঘুরা প্রমাদ গোনে। নির্বাচন আসছে বলেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০০৮ সাল ছাড়া কোনো নির্বাচনেই সংখ্যালঘুরা শান্তিতে ভোট দিতে পারেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সারাদেশে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা ছিল নজিরবিহীন। ওই নির্বাচনের পর বাগেরহাটের এক হিন্দু মহিলা তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, যেন তিনি ভোটার তালিকা থেকে হিন্দুদের নাম বাদ দিয়ে দেন। হিন্দুরা ভোট দিতে চায় না, শুধু এদেশে থাকতে চায়। শারদীয় দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীর দিন ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির থেকে মহিলারা একটি ব্যতিক্রমী নীরব প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিল, সামনে ব্যানারে শুধু লেখা ছিল, ‘মাগো তুমি ফিরে যাও, এ বাংলায় এসো না’। কতখানি ক্ষোভ এই প্রতিবাদের মধ্যে ভাষা পেয়েছিল, রাজনীতিকরা তা বুঝেছিলেন কিনা জানি না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দিনাজপুরের কর্নাই গিয়ে আর্তনাদ শুনেছিলাম, আমরা ভোট দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি, আমরা আর ভোট দিতে চাই না। তার আগে সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে বলাইবাজার সংলগ্ন তিনটি গ্রাম সাম্প্রদায়িক রোষে ছারখার হয়ে যাওয়ার পর হামলার শিকার অসহায় মানুষগুলোর আর্তি শুনেছি, আমাগো সাহায্যের দরকার নেই। আমাগো দেশত্যাগের ব্যবস্থা করে দাও বাবুরা। বলাইবাজারে একটি পুরনো কালীমন্দিরের বলে বর্ণিত জায়গায় মসজিদ স্থাপনের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন মুসলমান-হিন্দু সবাই। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মুসলমান চেয়ারম্যান। কিন্তু তার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে তিন গ্রামের সংখ্যালঘুদের। শ্যামনগরের ঘটনা খুব ছোট। আক্রান্তদের বাড়িতে গিয়ে যা শোনা গেছে, তা অত্যন্ত তুচ্ছ ব্যাপার। অথচ ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নারকীয় হামলা চালানো হলো।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার নতুন কৌশল দেখা গেল ২০১২ সালে রামুর ঘটনার মধ্য দিয়ে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে একটা সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরির পর ধ্বংসযজ্ঞ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যাকে চিহ্নিত করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ চাপিয়ে দেয়া হয় তিনি দোষী কি নির্দোষ তা যাচাই করার আগে তার বিচার হয়ে যায়। পাবনার সাঁথিয়ার সেই দশম শ্রেণির ছেলেটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজ দাস, সিলেটের জকিগঞ্জের রাকেশ রায়, রংপুরের টিটু রায়- রিমান্ডে যেতে হয়েছে তাদের। রামুর উত্তম বড়ুয়া পালিয়ে বেঁচে যান। কোনো হামলাকারীকে কিন্তু রিমান্ডে নেয়া হয়নি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, ‘আমাদের বিচার ব্যবস্থা এমনই- যে কোনো সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত থানায় গিয়ে নিরপরাধ কোনো অমুসলিম ব্যক্তির নামে মামলা করলে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ তাকে আসামি বানিয়ে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গিয়ে গারদে ঢুকিয়ে দিতে পারে। গ্রেপ্তারে গড়িমসি করলে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তথাকথিত অভিযুক্তকে হত্যা করতে পারে, গোটা সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যাবতীয় সম্পদ, উপাসনাস্থল ধ্বংস করতে পারে, নির্বিচারে লুটতরাজ করতে পারে, নারীদের ধর্ষণ করতে পারে, হুমকি দিয়ে দেশছাড়াও করতে পারে। এত সব করার পর এই দুর্বৃত্তরা থানা, পুলিশ, প্রশাসন ও আদালতের নাকের ডগায় বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কিছু হয় না।’

একটি চমকপ্রদ ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়। নির্মূল কমিটির সংবাদ সম্মেলনেও তা উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছর বাগেরহাটের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষাল ক্লাসে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়িয়েছিলেন। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। হিন্দু হওয়ার অপরাধে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ দিন পর জামিনে তারা বেরিয়ে আসেন। পরে মামলা থেকে প্রধান শিক্ষককে অব্যাহতি দেয়া হলেও অশোক ঘোষালের কারাদণ্ড ও জরিমানা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে ডারউইনের বিবর্তনবাদ কি নিষিদ্ধ? যদি নিষিদ্ধ না হয়, এ শাস্তি কি বৈধ? শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে কোনো ভ‚মিকা নিয়েছে কিনা জানা নেই। অবশ্য যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাঠ্যবই সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছে, তার ভূমিকা আশা করাও অন্যায়। নির্মূল কমিটি বলেছে, কমিটির পক্ষ থেকে দুই শিক্ষককে উচ্চতর আদালতে ন্যায়বিচারের জন্য আপিল করতে বলা সত্তে¡ও চাকরি হারানো ও অধিকতর নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় তারা এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করতে সম্মত হননি। নির্মূল কমিটি আরো জানিয়েছে, ২০১৪ সালে নির্বাচনের সময় যশোরের মালোপাড়ার দুই ধর্ষিতা নারী আসামিদের হুমকির কারণে মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। নির্মূল কমিটি তাদের মামলার সব দায়িত্ব গ্রহণের কথা জানানোর পরও তারা সাহস করে এগোতে পারেননি।

কত উদাহরণ দিতে হবে? বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রতি মাসে সাম্প্রদায়িক হামলার পরিসংখ্যান তৈরি করে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের সাত সপ্তাহের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৯ জন, সহিংস হামলা ও শারীরিক নির্যাতনে আহত হয়েছেন ৪২ জন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শ্মশানের সম্পত্তি দখলের ঘটনা ঘটেছে ৯টি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৮ নারী ধর্ষিত হয়েছেন, যার মধ্যে তিনটি ক্ষেত্রে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে মানিকগঞ্জ, খুলনার পাইকগাছা, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, মাগুরা, গাজীপুর, বরগুনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, চুয়াডাঙ্গা ও নেত্রকোনায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্বৃত্ত গ্রেপ্তারের খবর দেয়া হলেও শাস্তি হয়েছে এমন খবর দেখিনি।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতারা প্রতিটি সভা বা সমাবেশে দাবি জানান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের। বর্তমান সরকারের আমলে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত শাহাবুদ্দিন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক হামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রায় ১০ হাজার ঘটনা ঘটেছে। এই দশ হাজার ঘটনার ক্ষেত্রে শতকরা এক ভাগ অপরাধীরও বিচার হয়নি, শাস্তি হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের সরকারের আমলে পরিচালিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার কেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হচ্ছে না এর কোনো হিসাব মেলাতে পারি না। দুই মন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হচ্ছি, ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের কথাটা তারা উল্লেখ করেছেন, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনার তত্ত¡’ এখানে আসেনি।

বাসুদেব ধর : সাংবাদিক, লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App