×

মুক্তচিন্তা

পুঁজিবাজার উন্নয়নে সেমিনার : কিছু কথা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:০৩ পিএম

স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বহুবার সরকার তথা এসইসির কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে যে, বহুজাতিক কোম্পানি যেন আইপিওতে আসে। এখানে যে কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে তাদের শেয়ারের চাহিদা কেমন, তা বলার প্রয়োজন হয় না। এর সব কটি ব্লুচিপ। বাংলাদেশের আইপিও মার্কেট খুব শক্তিশালী। আইপিওতে একেবারে অখ্যাত কোম্পানি ছাড়া এভারেজ কোম্পানি ওভার সাবস্ক্রিপশন হয়ে থাকে। আর বহুজাতিক কোম্পানি হলে তো কথাই নেই।

গত ৮ নভেম্বর স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংগঠন বিএপিএলসির উদ্যোগে পুঁজিবাজার উন্নয়নের ওপর একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত তাতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে স্বাভাবিকভাবে কিছু মুখস্থ বুলি যথা- করবান্ধব নীতি, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাদের সমন্বয়, কঠোর রীতিনীতি মেনে চলা- এ ধরনের কথাবার্তা আওড়ানো হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন যে, ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের যথাযথভাবে কাজকর্ম শুরু করা প্রয়োজন। এর ফলে কোম্পানি তাদের সুবিধা মতো আর্থিক বিবৃতি তৈরি করা বন্ধ করতে বাধ্য হবে। এখানেই বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) সংসদে পাস হয়। এর একটু পটভ‚মি বলা প্রয়োজন। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিচরণের সময় অডিট রিপোর্ট সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের ক্ষমতা ছিল স্বদেশের সম্ভ্রান্ত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সংগঠনের। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন কর্পোরেট বিপর্যয় শুরু হয় পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম কোম্পানি এনরনের পতন হয়। পরে অবশ্য আটলান্টিকের উভয় পাশে আরো কয়েকটি কোম্পানির লালবাতি জ্বলে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ পাবলিক কোম্পানির অডিট অ্যাকাউন্টসের দেখভালের জন্য Public Company Accounting Oversight Board গঠন করেন। এর ফলে ক্রমে বিশ্বব্যাপী সরকারি উদ্যোগে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, অবশ্য ভিন্ন নামে ভারতে এফআরসি কোম্পানি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২০১৩ সালে। আমাদের এখানে কিছু সময় লাগে। আরো বিলম্ব হয় আইসিএবি এবং আইসিএমএবির কলহের কারণে। বর্তমানে একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ওনার প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেনি। উনি বিভিন্ন সেমিনারে জনসংযোগ এবং সমন্বয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু মূল কাজ বিলম্বিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং এফআরসির কাঠামো এবং কর্মপদ্ধতিতে পার্থক্য রয়েছে। বিএসইসির চেয়ারম্যান এবং সদস্য সমন্বয়ে গঠিত কমিশন সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ১২ জন সদস্য নিয়ে এফআরসি গঠিত। সেখানে বিএসইসির চেয়ারম্যানের মনোনীত একজন প্রতিনিধি থাকবেন। এই কাউন্সিলে ব্যাপক প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। যেমন অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি; সিএজি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠন থেকে প্রতিনিধি থাকবেন। আইসিএবি এবং আইসিএমএনবিও রয়েছে। এফআরসির চেয়ারম্যান কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকবে সেটা ভালো কথা কিন্তু এফআরসির সাফল্য নির্ভর করবে কাউন্সিল কতটা ঐক্য রক্ষা করে বৃহত্তর আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে তুলে ধরবে তার ওপর। প্রত্যেক প্রতিনিধি স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের কথা বলবেন, তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির দিকে দৃষ্টি রাখবেন।

এটাই প্রত্যাশিত। চেয়ারম্যান সাহেবের দক্ষতা, ক্ষমতা, সাফল্য সব কিছু নির্ভর করবে তিনি কাউন্সিলকে কতটা আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। তার জন্য প্রয়োজন অধিক অভ্যন্তরীণ তৎপরতা। তবে এ কথা আবারো জোর দিয়ে বলতে হয় যে অবিলম্বে এফআরসির কার্যক্রম শুরু করা দরকার।

আরিফ খান আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। এজন্য তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে হয়। কেননা ব্যবসায়িক সম্প্রদায় থেকে এ ধরনের কথা সরাসরি ওঠা বিস্ময়কর বৈকি। সেটি হলো নিরপেক্ষ পরিচালকের প্রসঙ্গ। নিরপেক্ষ পরিচালক থাকার পটভ‚মিও ওই এনরনের কেলেঙ্কারি থেকে এসেছে। বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক বোর্ডে নিরপেক্ষ পরিচালক থাকবেন যার কোনো রকম আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক থাকবে না, সেটা শেয়ার হোক বা অন্য রকম লেনদেন হোক না কেন। কিছু কথা অলিখিত থাকে। নিশ্চয়ই নিরপেক্ষ পরিচালক পুতুলের মতো বসে থাকবেন না। তিনি যে প্রতিষ্ঠানে যাবেন, তার কাজকর্ম সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে তিনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখবেন। সেটি সম্ভব হবে না যদি বোর্ডের পরিচালকদের কারো সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব থাকে, কিংবা অতীতে কোনো আর্থিক লেনদেনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ কোনো ভ‚মিকা থাকে। বাংলাদেশে অনেক কোম্পানিতে নিরপেক্ষ পরিচালক হিসেবে বন্ধুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এ কথা মূল প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বিএসইসির। কিন্তু বিএসইসি যে এ ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

সেমিনারে অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যে, ভবিষ্যতে সুযোগ এলে কর্পোরেট ট্যাক্সের পুনর্বিন্যাস করা হবে। অবশ্য এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্সের পার্থক্য শতকরা ১০ ভাগ। অর্থাৎ তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে শতকরা ১০ ভাগ কম ট্যাক্স দিতে হয়। পুঁজিবাজারের বৃহত্তম স্বার্থে এই পার্থক্য আরো বাড়ানো যেতে পারে।

পিডব্লিউসি বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ যথাযথই বলেছেন যে, যারা সাফল্য দেখান তাদের পুরস্কৃত করা এবং যারা অন্যায় করেন তাদের শাস্তি দেয়া উচিত। আমাদের দেশে অপরাধীদের শাস্তি না দেয়ার কালচারটা প্রবল। তিনি আরো বলেছেন যে বৈরী মনোভাব নিয়ে কোনো ব্যাংকে পরিচালনা বোর্ডের অধিগ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় নয়। তিনি একে ‘হাইজ্যাক’ বলেছেন। কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়া এ কাজ কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, বোর্ডের গঠন বা পুনর্গঠন করতে হবে দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে এবং বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তির অর্থনীতি, ব্যাংক এসব সম্পর্কে ধারণা রয়েছে তাকেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

মামুন রশিদের একটা কথা বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি বলেছেন, যে সব বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি, চাহিদা তৈরি হলে তারা তালিকাভুক্ত হবে। এখানে চাহিদা কথাটা পরিষ্কার হচ্ছে না। জানি না পত্রিকার রিপোর্ট করার সময় কোনো রকম গ্যাপ তৈরি হয়েছে কিনা। স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বহুবার সরকার তথা এসইসির কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে যে, বহুজাতিক কোম্পানি যেন আইপিওতে আসে। এখানে যে কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে তাদের শেয়ারের চাহিদা কেমন, তা বলার প্রয়োজন হয় না। এর সব কটি ব্লুচিপ। বাংলাদেশের আইপিও মার্কেট খুব শক্তিশালী। আইপিওতে একেবারে অখ্যাত কোম্পানি ছাড়া এভারেজ কোম্পানি ওভার সাবস্ক্রিপশন হয়ে থাকে। আর বহুজাতিক কোম্পানি হলে তো কথাই নেই। যা হোক এই চাহিদা কী এবং কে সৃষ্টি করবে, তা আর একটু খোলাসা করে বললে ভালো হয়। এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা চলে যে, মামুন রশিদ যে কোম্পানিতে রয়েছেন সেটি প্রাইভেট কোম্পানি। সেটিকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হলে আইপিওতে যাওয়া যায় কিনা।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস, কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App