×

মুক্তচিন্তা

রবার্ট মুগাবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০১৭, ০৬:৩৯ পিএম

দমবন্ধ শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে আফ্রিকান দেশ জিম্বাবুয়ে। সে দেশের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে মঙ্গলবার ২১ নভেম্বর পদত্যাগ করেছেন। পার্লামেন্টের স্পিকার জ্যাকব মুডেনডা জানিয়েছেন, পার্লামেন্ট তাকে ইমপিচ করার প্রক্রিয়া শুরু করলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তদুপরি সেনাবাহিনীর চাপ তো ছিলই। রবার্ট মুগাবে ছিলেন বিশ্বের বয়োবৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট। ৩৭ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি পদত্যাগ করলেন। তার শাসনামলে দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং তিনি খুন, গুম, ভয়ভীতি ও নির্বাচনী জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। গত সপ্তাহে মিলিটারি তাকে অন্তরীণ করে এবং তিনি তার নিজ দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান। তার ক্ষমতাচ্যুতিতে জিম্বাবুয়ের জনতা উল্লাসে রাস্তায় নেমে পড়ে।

অথচ এই দেশটির স্বাধীনতা লাভের পর তিনি ছিলেন জনপ্রিয় নেতা এবং স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। দীর্ঘকাল ক্ষমতা ধরে রাখার প্রবণতা যে একজন জনপ্রিয় নেতাকে স্বৈরাচারী করে তোলে রবার্ট মুগাবে এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি বা ইরানের শাহর কথা সবাই জানেন।

জিম্বাবুয়ে দেশটির পূর্বেকার নাম ছিল রোডেশিয়া। শ্বেতাঙ্গ সিসিল রোডস নাম থেকে রোডেশিয়া। ‘রোডেশিয়া’ নামের একটি বইতে পড়েছিলাম, সিসিল রোডস ছিলেন ব্রিটিশ ধনী পরিবারের ছেলে। যৌবনে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। তখন এই রোগের তেমন চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। ব্রিটেনে প্রচণ্ড শীত, যা য²ার জন্য খারাপ। তাই তাকে কোনো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার। তখন ওই দেশটির কী নাম ছিল তা জানা যায় না, রোডস সেখানে যান। শ্বেতাঙ্গ রোডস সেখানে গিয়ে শুধু যে সুস্থ হয়ে ওঠেন তা নয়, বরং তিনি সেখানে একটি শ্বেতাঙ্গরাজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশটির নাম দেন নিজের নামানুসারে, রোডস থেকে রোডেশিয়া। শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে মুক্তি লাভের পর কৃষ্ণাঙ্গরা দেশের নাম পাল্টে দেন। রোডেশিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে। রবার্ট মুগাবে ছিলেন এর নেতা। কিছুকাল আগে রবার্ট মুগাবে তার স্ত্রীকে ক্ষমতায় তার উত্তরাধিকারী করতে চেয়েছিলেন। তার সেই আশা পূর্ণ হয়নি। সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। প্রতিটি স্বৈরাচারই একই ভুল করেন, মুগাবেও ব্যতিক্রম নন? ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, মুগাবেও নেননি। তিনি আধুনিক জিম্বাবুয়ের প্রতিষ্ঠাতা। অথচ এখন তিনি ধিকৃত।

সিসিল রোডস, রোডেশিয়া বা জিম্বাবুয়ের ইতিহাস গুগল ও উইকিপিডিয়া ঘেঁটে পাওয়া যায়, কিন্তু সিসিল রোডসের টিবি হয়েছিল তা পাওয়া যায় না, কিন্তু ব্যক্তি সিসিল রোডসের অস্তিত্ব আছে। রোডেশিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল যা সম্ভবত আনুষ্ঠানিক সীমান্তে রূপ নেয় ১৮৯০ দশকে এবং ১৯৮০ পর্যন্ত তা বেশ কয়েকবার পরিবর্তিত হয়। ব্রিটিশ সাউথ আফ্রিকা কোম্পানি (বিএসএসি) ১৯২০ সাল পর্যন্ত ওই অঞ্চল শাসন করে। এরপর সেখানে বিবিধ প্রশাসন বিদ্যমান ছিল। রোডেশিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের নাম হয় ‘দক্ষিণ রোডেশিয়া’। এর উত্তরাঞ্চল প্রাকৃতিকভাবে বিভক্ত ছিল এবং বিএসএসি এর নাম দেয় ‘উত্তর রোডেশিয়া’। ১৯৬৪ সালে উত্তর রোডেশিয়ার নতুন নাম হয় জাম্বিয়া। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ রোডেশিয়া হয় জিম্বাবুয়ে। সিসিল রোডস ছিলেন বিএসএসির প্রতিষ্ঠিতা প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ১৮৯১-৯৫ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় এ তথ্য পাওয়া যায়। মূলত ১৮৯০ দশকে বিএসএসি কোম্পানি ওই অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে এবং শাসনকার্যের সুবিধার্থে সীমানা নির্ধারণ ও নামকরণ করে। কখনো সখনো দুই রোডেশিয়া অর্থাৎ দক্ষিণ ও উত্তর রোডেশিয়াকে একত্রে ‘দি রোডেশিয়াস’ নামে অভিহিত করা হয়।

১৯২৩ সাল থেকে ব্রিটেন দক্ষিণ রোডেশিয়াকে কব্জায় রাখলেও ১৯৬৪-১৯৭৯ সালে শুধুই ‘রোডেশিয়া’ নামে অভিহিত করে। ১৯৬৫ সালে আয়ান স্মিথ একতরফাভাবে ব্রিটেন থেকে রোডেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭৯ সালে এর নতুন নাম হয় ‘জিম্বাবুয়ে রোডেশিয়া’। সেটা স্বল্পক্ষণের জন্য; জুন ১৯৭৯ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭৯। তারপর রোডেশিয়া খসে পড়ে, শুধুই জিম্বাবুয়ে। এপ্রিল ১৯৮০ তে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। একই বছরে নির্বাচনে রবার্ট মুগাবে বিশাল বিজয় পান এবং ক্ষমতায় বসেন। শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসান ঘটে, কৃষ্ণাঙ্গ শাসনের শুরু। রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবে ১৯৮০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত নেতা ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তারপর প্রেসিডেন্ট। তার বয়স ৯৩ বছর (জন্মদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯২৪), বিশ্বের বয়োবৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট। তার পত্নী গ্রেস নোটোম্বিজদা মুগাবে ১৯৯৬ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত জিম্বাবুয়ের ফার্স্টলেডি ছিলেন। গ্রেস ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুগাবের দ্বিতীয় পত্নী , বিয়ে করেন ১৯৯৬ সালে। দুজনের বয়সের ব্যবধান মাত্র ৪১ বছর (জন্ম ২৩ জুলাই ১৯৬৫)। মুগাবের প্রথম পত্নী ছিলেন স্যালি হেফরন (১৯৬১-১৯৯২)।

মুগাবের বিদায়ের পর কী? আফ্রিকাজুড়ে এখন এই প্রশ্ন। ২০১৮ তে জিম্বাবুয়েতে সাধারণ নির্বাচন। সেই পর্যন্ত সম্ভবত একটি অন্তর্বর্তী সরকার দেশটি পরিচালনা করবে। তবে মুগাবের দল আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (জানু-পিএফ) এখনো ক্ষমতাসীন, সুতরাং শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এই দল থেকেই হয়তো পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। এই তালিকায় শীর্ষে আছেন সদ্য বহিষ্কৃত মুগাবের দীর্ঘদিনের সহকর্মী এমারসন নাঙ্গাগোয়া। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বরখাস্ত হন এবং পালিয়ে যান। মুগাবের উত্তরসূরি নির্বাচন দ্বন্দ্বে এমারসন মুগাবের স্ত্রী ফার্স্ট লেডি গ্রেস নোটোম্বিজদা’র কাছে পরাজিত হন। এমারসন যদিও এখন অগ্রণী ভূমিকায় আছেন, কিন্তু তার হাতও রক্তে রঞ্জিত। বলা হয়, গুরুকাহুন্দি হত্যাকাণ্ডে তিনি জড়িত; সেখানে ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। শুক্রবার এমারসন নাঙ্গাগোয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার কথা। এখন ভাগ্যদেবী ইমারসনের পক্ষে। ইতোমধ্যে তিনি সেনাবাহিনীর ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন।

বিরোধীরা বলছে, এমারসন হবেন মুগাবের মতো স্বৈরাচারী, তিনি স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা দেবেন এবং শক্ত হাতে বিরোধীদের দমন করবেন। তাদের বক্তব্য, জনগণের উচিত হবে না এমারসনের অতীত ভুলে যাওয়া। আর একদল আছেন, যারা ক্ষমতার আমূল পরিবর্তন চান, তারা বলেছেন, ‘আমরা এক স্বৈরাচারের বদলে আর এক স্বৈরাচার চাই না। কিন্তু আপাতত এভাবেই চলবে, নির্বাচনের পর যা হওয়ার তাই হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, পদত্যাগের পর মুগাবে এখন কী করবেন বা কোথায় যাবেন? ধারণা করা হচ্ছে, তাকে জিম্বাবুয়ে ছাড়তে হবে, যাতে তিনি নয়া সরকারে কোনো ঘাপলা সৃষ্টি করতে না পারেন! সে ক্ষেত্রে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ সেখানে তার বিশাল রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এবং সহায়-সম্পত্তি আছে। মুগাবে যখন ক্ষমতা ছাড়লেন তখন জিম্বাবুয়ের বিশাল ঋণ, অর্থনীতিতে মন্দা, ব্যাংক লুটপাট, শেয়ারবাজারে ধস নেমে এসেছে। সামরিক অভ্যুত্থানের প্রথম দিনে সেখানে শেয়ার মার্কেট ইনডেস্ক একদিনে ১৮% নিচে নেমে যায়। এখন দেখা যাক, নতুন সরকার কীভাবে সবকিছু সামাল দেন?

নিউইয়র্ক, ২৩ নভেম্বর ২০১৭ শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App