×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা নির্যাতন ও রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:৫১ পিএম

১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত রোহাঙ্গা (অপভ্রংশ) স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর চরম বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। তবে এ সময়ের বৌদ্ধ রাজারা নিজেদের বাংলার সুলতানদের সঙ্গে তুলনা করত এবং মুঘলদের মতোই জীবনযাপন করত। এরা মুসলিমদেরও রাজদরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিত। এ সময় আরাকানের রাজদরবারে বাংলা, ফার্সি সাহিত্যচর্চা হতো এবং দরবারের হস্তলিপিকারদের মধ্যে অনেকেই বাঙালি ছিল।

দুই. ১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে এবং হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। ১৭৯৯ সালের দিকে বার্মিজদের গ্রেপ্তার ও হত্যা এড়াতে প্রায় ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষ চট্টগ্রাম চলে আসে। শাসকরা এ সময় আরাকানের একটি বড় অংশের মানুষ বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায়ও পাঠায়। ব্রিটিশরা এ রাজ্য যখন দখল করে তখন তা ছিল একটি মৃত্যুপুরী। তবে ব্রিটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। এ সময় (১৯ শতকে) আরাকান ও বাংলার মাঝে কোনো আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না। তখন হাজার হাজার বাঙালি যেমন কাজের সন্ধানে আরাকান গিয়ে বসতি গড়েছিল অপরদিকে হাজার হাজার রাখাইনও আরাকান থেকে বাংলায় চলে এসেছিল। এ ধারাবাহিকতায় এ সময় অভিবাসীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫ লাখের মতো এবং বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) বড় শহরগুলোতে মোট অভিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৩ কোটি। ব্রিটিশ শাসনে বার্মিজরা অসহায়ত্ব বোধ করত এবং তখনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে অভিবাসীদের ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত। তবে অভিবাসনের সংঘাত আরাকানেই ছিল সবচেয়ে প্রকট। ১৯৩৯ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম এবং রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসক জেমস ইস্টাব এবং তিনতুতের দ্বারা একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। কমিশন অনুসন্ধান শেষে সীমান্ত বন্ধ করার সুপারিশ করে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে চলে যায়। এ সময় রাখাইন, বৌদ্ধ ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিত্রশক্তির (ব্রিটিশ) পক্ষ অবলম্বন করলে জাপানিরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করে। এ সময় জাপানি ও বার্মিজদের বার বার গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসে। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে এবং সরকারি পদস্থ পদে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বও ছিল।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির সময় আরাকানের রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বড় ভুল করে বসে। তারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে পাকিস্তানে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। আর শুরু হয় রোহিঙ্গাদের কপাল পোড়া। তাদের এ মনোভাব আরাকানের অন্য গোষ্ঠীরাও মেনে নিতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের কপালে ‘বেঈমান’ তকমা লেগে যায়। এদিকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববাংলার প্রতি তার স্বভাব সুলভ অনীহা বশত কোনো ঝুঁকি না নিয়ে শেষমেশ পাকিস্তানে নিতে অস্বীকৃতি জানায় আর মুসলিম রোহিঙ্গাদের অকুল পাথারে ভাসিয়ে দেয়। এ অবস্থায় উপায়ন্তর না দেখে তারা নিজেরাই রোহিঙ্গা মুসলিম পার্টি গঠন করে আরাকান স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এভাবে তারা একদম ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যায় বার্মা সরকারের কাছে।

তিন. ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার জেনারেল নে উইন মিয়ানমারের ক্ষমতা পেলে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার নেমে আসে; জাতিগত দাঙ্গায় মুসলমানদের ব্যাপক অবনতি হতে থাকে এবং ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে সামরিক অভিযানের কারণে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ সময়ে সৌদি আরব, মালয়েশিয়াতেও রোহিঙ্গারা আশ্রয় পায়। এভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মদদে ১৯৯৭, ২০০১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৬ সালে রাখাইনসহ সমগ্র মিয়ানমারে খণ্ড খণ্ড ভাবে মুসলিম ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জাতিগত দাঙ্গা, খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, লুট একের পর এক চলতে থাকে। প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যায় মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান/মসজিদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ধ্বংস করা হয় কিংবা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ২০১৬ সালের শেষের দিকে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও চরমপন্থী বৌদ্ধ মগেরা মুসলিমদের ওপর বড় ধরনের অভিযান শুরু করে। প্রহার, বিচার বহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ড, শিরশ্ছেদ, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সম্পদ লুট, গণগ্রেপ্তার নানা নৃশংস ঘটনায় ব্যাপক হারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।

প্রকাশ থাকে যে, ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইনের ফলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জাতি নিধনের বীজ বপন করে বার্মার সামরিক জান্তা সরকার। রোহিঙ্গারা কিছু মৌলিক ইসলামি শিক্ষা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। চাকরিচ্যুতসহ চাকরির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। রোহিঙ্গাদের সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ রোহিত করা হয়। জমির মালিক হতে পাববে না, বিয়েতে অনুমতি এবং দুটির বেশি সন্তান জন্ম দিতে পারবে না এরূপ অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়, অসুখে মরলেও সন্ধ্যার পরে বাড়ির বের হতে পারবে না, বাধ্যতামূলক নির্মাণকাজ করতে হবে, কোনো আইনি সহায়তার প্রশ্নই ওঠে না। অর্থাৎ নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে একেবারে জীবন-মৃত অবস্থায় অসহায় ও খুবই নিকৃষ্টভাবেই তাদের দিনাতিপাত চলতে থাকে! তার ওপরে পান থেকে চুন খসলেই সামরিক বাহিনীর পেটোয়া বাহিনী হিসেবে মগেরা খুন, ধর্ষণ, লুট, জ্বালিয়ে দেয়াসহ এমন কোনো রোমহর্ষক নির্যাতন নেই যে তারা করে না। এর একটাই লক্ষ্য রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা জাতি সম্পূর্ণরূপে নিধন করা। যদিও জোরপূর্বক নিজের জন্মস্থান থেকে বিতাড়িত করা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

গত ২৫ আগস্ট সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে আনান কমিশন রিপোর্ট মিয়ানমারে জাতিগত স্বীকৃতি, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করে পুনর্বাসন ও নাগরিকত্ব প্রদান এসব সুপারিশের মাহেন্দ্রক্ষণে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো বর্মী পুলিশ ফাঁড়িতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার ঘটনা ঘটে। বলা হচ্ছে, আরসা যোদ্ধারা রাখাইনের পুলিশ পোস্টে প্রাণঘাতী হামলা চালানোর অভিযোগে এ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। যা প্রকৃতভাবেই নৃশংস জাতিগত নিধন এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, নোবেল বিজয়ী রাষ্ট্রপ্রধান (রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর) অং সান সু কি প্রতিটি ক্ষেত্রেই আশ্চর্যরকম নিষ্ঠুর নীরবতা পালন করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে সু কির দল এনএলডি ক্ষমতায় এসে সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের সঙ্গে একজোট হয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিরাট বড় হুমকি- এ অজুহাত দাঁড় করিয়েছে এবং এ জন্য তাদের নির্মূল করার শতাব্দীর জঘন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের খেলায় তারা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। মুসলিম রোহিঙ্গা নির্যাতনের রোমহর্ষক ঘটনাবলি বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে জ্বলজ্বল করে উঠলেও সূচি একেবারেই তা মানতে নারাজ। তিনি বলছেন, আরাকানে মুসলিম নির্যাতনের মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। কার্যত সেখানে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিরাপত্তা প্রদান করা হচ্ছে। ‘অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ হবে না।’ বালির মধ্যে মুখ লুকালেও সু কির রোহিঙ্গা নিধনতন্ত্রে সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে। তবে মিয়ানমার সংসদে শতকরা ২৫ ভাগ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য রিজার্ভ- সেই জংলি পার্লামেন্টের নেত্রী মূলত একটি পুতুল সরকারপ্রধান। মিয়ানমারে প্রধান ক্ষমতা রয়ে গেছে সেদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং’র হাতে, যার বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ জাতিসংঘে তদন্তাধীন রয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, ওআইসি, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা, নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশ ইতোমধ্যে এই নৃশংস রোহিঙ্গা জাতি নিধনকে ধিক্কার জানিয়ে অনতিবিলম্বে তা বন্ধ করার আহ্বান জানালেও মূক-বধিরের মতো পাত্তাই দিচ্ছে না মিন অং হ্লাইং। উপরন্তু, তনি বারবার বলার চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা রাখাইনে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি।

চার. মগ-বর্মী শাহীদের রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ যদি চলতে থাকে তবে বাংলাদেশে করুণ, বিপন্ন, নৃশংসভাবে নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে দশ লক্ষাধিক। ক্ষুদ্র পরিসরে বৃষ্টির প্রকোপে সহায় সম্বলহীন নির্যাতিত মানুষের স্যানিটেশন, মাথা গোঁজার ঠাঁই, আহারের সংস্থান, পানির অভাব, পোকামাকড়, রোগ-বালাই সব মিলে এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয় সেখানে সৃষ্টি হয়েছে- যা ভাবলে/প্রত্যক্ষ করলে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সরজমিন ত্রাণ দিতে গিয়ে কথাগুলো বলেছেন এ দেশেরই এক অতিমানবীয় দয়াবান ব্যক্তি। শতাব্দীর অন্যতম সেরা মানবিক আচরণ করতে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে এত অল্প সময় নেবেন তা আমরা হয়তোবা বুঝে উঠতে পারিনি। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গা সংহতি প্রসঙ্গে সংসদে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যদি এক বেলা খাই, রোহিঙ্গারাও এক বেলা খাবে।’ বিপন্ন, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা তার জন্মজয়ন্তী উদযাপন বাতিল করেছেন। এখানেই থেমে যাননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ওআইসির কনট্যাক্ট গ্রুপের সভায় ৬ দফা প্রস্তাব (১. রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কফি আনান কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে; ২. রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সব নিপীড়ন এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে; ৩. রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের ভেতরে ‘সেভ জোন’ তৈরি করতে হবে যেখানে তাদের সুরক্ষা দেয়া হবে; ৪. বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত সব রোহিঙ্গাকে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে; ৫. রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা মিয়ানমারকে বন্ধ করতে হবে; ৬. রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরা না পর্যন্ত তাদের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তাদান করতে শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা কক্সবাজারে এসে দেখে যেতে তিনি ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। এক পর্যায়ে তিনি ওআইসির নেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে জানতে চান পৃথিবীতে মুসলিমরাই কেন শুধু শরণার্থী হবে।) এবং সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় দেয়া ভাষণে ৫ দফা (১. অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা; ২. অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা; ৩. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে সুরক্ষা বলয় ‘সেফ জোন’ গড়ে তোলা; ৪. রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; ৫. কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।) প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি সাধারণ পরিষদে এ প্রস্তাবের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের সভা, জাতিসংঘ মহাসচিবের উচ্চ পর্যায়ের সভা, ILO এবং OEDC ’র যৌথ উদ্যোগে উচ্চ পর্যায়ের সভা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের সভা করেন। অধিবেশন চলাকালে তিনি সাইড লাইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন যার মধ্যে নেদারল্যান্ডের রানী, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মহাপরিচালক, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক, IBMA ’র প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক উল্লেখযোগ্য।

প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টার সাফল্যে রোহিঙ্গাদের পক্ষে মনে হয় তিনি সারা বিশ্বকে সঙ্গে পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনতিবিলম্বে মিয়ানমারের প্রতি অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্য সু কির সব সম্মাননা পুরস্কার স্থগিত করে মিয়ানমারকে দেয়া সামরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাতিল করেছে। কানাডা সু কির নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর নতুন করে অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছে। ২৫ আগস্টের পর কয়েক হাজার নিরপরাধ রোহিঙ্গাকে হত্যা করার আশঙ্কা প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রা’দ এ ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বলিষ্ঠ কণ্ঠে এ ঘটনাকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বারবার এ নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণআদালতে অং সান সু কি ও মিয়ানমারের সেনাপ্রধান হ্লাইংকে গণহত্যায় দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচার দাবি করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোপীয় কমিশন, কমনওয়েলথ রোহিঙ্গা জাতি নিধনের অভিযোগ তুলে মিয়ানমারকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বয়কট করেছে। ঘটনার পর পরই বাংলাদেশে অবস্থিত ৪২টি দূতাবাসপ্রধান একযোগে শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করে রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় নিজ নিজ দেশে তুলে ধরেছেন। তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, নরওয়ে, সৌদি আরব, ইরান, চীনসহ বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশ এ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কামনা করেছে এবং অনেক দেশ ইতোমধ্যে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

পাঁচ. মিয়ানমার হয়তো কল্পনা করেনি, বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এত তাড়াতাড়ি তাদের মাথা নোয়াতে হবে। গত ২১ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং টুনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর বৈঠকে মিয়ানমার এ প্রস্তাব দেয়। তবে নতুন করে কোনো ষড়যন্ত্র কিনা সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই খুব সতর্কভাবে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে বসতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যে ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন তারই আলোকে সমাধান খুঁজবে বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়েও দিয়েছে বাংলাদেশ।

আমাদের দেশ খুবই ক্ষুদ্র, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ, জায়গা নেই, অর্থনৈতিক অবস্থাও প্রাক-উন্নয়নশীল। এহেন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংহতি প্রশ্নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কের পৃথিবীর করুণ, বিপন্ন, নির্যাতিত শরণার্থীদের সুরক্ষার আশ্বাস সমগ্র বাঙালি জাতির আশ্বাস, সমগ্র বাঙালি জাতির হৃদয়ের কথাই অনুরণন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। রোহিঙ্গা শরণার্থী সুব্যবস্থাপনায় দেশের নির্ভরযোগ্য সেনাবাহিনীকেও তিনি নিয়োজিত করেছেন। পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের মাঝে মানবিক আচরণে, মানবাধিকার সংরক্ষণে তিনি এখন সেরাদেরও সেরা। সময়ই বলে দেবে আগামীর কথা। তবে বিপন্ন মানবাধিকার সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্ব দরবারে অর্জিত সম্মান যেন ষোলো কোটি বাঙালির ছিঁড়ে যাওয়া হৃদয়ের পরম স্বস্তি।

আগেও বলেছি, জাতিসংঘের UNHCR রিপোর্ট মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন, নির্যাতিত, নিপীড়িত শরণার্থী হলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। সব কিছু থেকেও তাদের এখন কিছুই নেই; দেশ-নাগরিকত্ব নেই, ঘরবাড়ি নেই, বেঁচে থাকার কোনোই উপায়-উপকরণ নেই। লোহা হজম করার খিদে, মাথার ওপরে চালা নেই। বৃষ্টি-কাদায় ভিজছে, রুগ্ণ-ক্লান্ত-অবসন্ন, স্যানিটেশন- সে এক অসীম দুরাশা! জীবন বাঁচানোর তাগিদে, জীবনের মায়ায় শুধুই হাত-পা নিয়ে বন-জঙ্গলে হেঁটে, নদী-সমুদ্রে ভেসে পালিয়ে এসেছেন তারা; নিজ জন্মভ‚মি থেকে ভয়ঙ্কর, নিষ্ঠুর নৃশংসভাবে বিতাড়িত হয়েছেন তারা। সবই ছিল। হঠাৎই নিঃস্ব, কাঙাল, শরণার্থী। দুঃখের কাহিনী, বিপন্ন জীবনের বিভীষিকাময় ইতিহাস, করুণ আর্তি সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই একদিন শুনবেন। তা হতে পারে কোনো জন্মে শাশ^ত, চিরন্তন, চিরশান্তির।

ধর্ষক, খুনি, নিকৃষ্ট অপরাধীর ধ্বংস অনিবার্য; কোনোই সুযোগ নেই তার পাপ মোচনের, কঠিন শাস্তি থেকে পরিত্রাণের। জি এম আবুল কালাম আজাদ : মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App