×

পুরনো খবর

নির্বাচন : সরকার ও বিরোধী দলের ভাবনা

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:৫৯ পিএম

ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আ.লীগ, বিশেষ করে দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি সবার অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচন করতে চান। আর সে নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। তিনি তার কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনের কথা চিন্তা-ভাবনা যেন কর্মীদের ভেতর কাজ না করে।

সময়ের প্রয়োজনে

সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি একটা মহাসমাবেশ করে প্রমাণ করেছে যে, ওই দলটি সম্পর্কে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের যে ধারণা তা সঠিক নয়। এখনো তাদের যথেষ্ট জনসমর্থন আছে। প্রায় আঠারো মাস পরে বিএনপির নেতৃত্বে একটা জনসভা তাও রাজধানী শহর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বিগত ১৮ মাসে বিএনপি কোনো সফল জনসভার আয়োজন করতে পারেনি। খণ্ড খণ্ড মিছিল করেছে। কোথাও কোথাও জনসমাবেশ করার অনুমতি পেয়েও লোক সমবেত ঘটাতে পারেনি। বিএনপির সমর্থন শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গিয়েছিল, তা নয়, তবে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার মতো পরিস্থিতি বিএনপি করতে পারেনি। মামলা-মোকর্দ্দমা, হামলা এসব তো আছেই। ওটা তো বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে মোদ্দা কথা হলো- সমাবেশ হলেই বিএনপি যে সহিংসতার আশ্রয় নেয়, ভাঙচুর করে, জ্বালাও-পোড়াও করে জনগণের মনে ভীতির সৃষ্টি করে সে কারণেই হয়তো লোকজন এর আগে বেশি মাত্রায় বিএনপির জনসভায় হাজির হয়নি। তাছাড়া খালেদা জিয়া-নির্ভর বিএনপির মূল নেতৃত্ব অনেক দিন প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকায় এবং খালেদা জিয়া প্রায় ৩ মাস লন্ডনে অবস্থান করায় দলটির ভেতর বেশ কিছুটা স্থবিরতার সৃষ্টি হয়। হঠাৎ করে খালেদা জিয়া দেশে ফিরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ বিতরণ উপলক্ষে সড়কপথে কক্সবাজার যাওয়া, সেখানে প্রায় জনসভার মতো করে ত্রাণ বিতরণ ও নাটকীয়ভাবে ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে এবং সে সম্পর্কে বিএনপি থেকে যা বলা হয়েছে তা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। যাওয়ার পথে আক্রমণ হয়েছে সাংবাদিকদের ওপর। যে জায়গাটায় হামলা হয়েছে সে জায়গার বিএনপির নেতা বলতে যাকে বোঝা যায় তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার কারণে যার অবস্থান চট্টগ্রামে ও যিনি বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন তার কারণে ওই স্থানীয় বিএনপি কর্মীরা ওই হামলা চালিয়েছে ও বিক্ষোভ করেছে বলে শোনা যায়। কী কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের দলকে বিতর্কের সম্মুখীন করতে যাবে? ফেরার পথের ঘটনা তো আরো রহস্যজনক। গাড়িবহরে আক্রমণ নয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দুটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে ত্রাসের সৃষ্টি করাই হয়তো আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল। কারা, কী কারণে আক্রমণ করেছে তা অবশ্যই তদন্তে জানা যাবে। তবে যারা ধরা পড়েছে তাদের অধিকাংশই বিএনপির সমর্থক। অনেকেই মনে করেন অনেক দিন নীরব থাকার পরে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় হওয়ার উদ্যোগ প্রসারিত করে দেখাবার প্রয়োজনে ওই ধরনের হামলা হয়তো তারা নিজেই করতে পারেন।

যা হোক একটা ভালো লক্ষণ- যে ভাষায় খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে গালিগালাজ করে থাকেন এবং শেখ হাসিনা সম্পর্কে বক্তব্য পেশের ক্ষেত্রে যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে থাকেন, যে কারণেই হোক না কেন তার মাত্রাটা এবার কম ছিল। জনসভার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ঘরে বসে থাকা বিএনপির কর্মীরা মাঠে নেমেছেন। তবে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে খালেদা জিয়া যা বলেছেন অর্থাৎ তিনি তার অবস্থানে অটল থাকবেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় নির্বাচনে যাবেন না। তার এই উক্তি দেশকে আবার সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে বলে মনে হয়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তো জানিয়ে দিয়েছে সাংবিধানিক ধারায় অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর খালেদা জিয়া ও তার দলের পক্ষে সংবিধান সংশোধন করা অসম্ভব। আর এটা করতে হলে খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপিকে রাজপথে সহিংসতায় ফিরে যেতে হবে, যা এদেশের মানুষের কাছে কোনো প্রকারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েই বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে আসতে হবে। হয়তো দেনদরবার করে তারা ওই সরকারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। আসলেই ওই সরকার তো বিএনপির দাবি অনুযায়ী সহযোগী সরকার হিসেবে কাজ করবে। দৈনন্দিন রুটিন কার্যকলাপ ছাড়া ওই সরকার নীতি নির্ধারণী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে না। মূলত প্রশাসনের নির্বাচনকালীন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তদারকি করবেন নির্বাচন কমিশন। আর সরকার তাকে সহযোগিতা করবে মাত্র। সেনা কর্মকর্তাদের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন সম্পর্কে বিএনপি যা বলেছে, আওয়ামী লীগ তো তার থেকে খুব বেশি দূরে নয়। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব তো নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রয়োজন, তাহলে সে সিদ্ধান্ত তারাই কার্যকর করতে পারে। সাংবিধানিক সে ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে।

তবে সরকার সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমপর্যায়ে এনে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে দিতে সরকার নারাজ। আর বিচারিক ক্ষমতা সেনাবাহিনীর ওপর অর্পণ করা বাঞ্ছনীয় নয়। প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের সঙ্গে আপস করে আলাপ-আলোচনা করে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি বিএনপি নেবে কিনা। না ষড়যন্ত্রের পথে অতীতের মতো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নির্বাচন প্রতিহত করতে চাইবে। মনে হয় এই ব্যাপারে বিএনপির নেতারা একমত নন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, যেকোনো অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা। অনেকেই মনে করেন আগের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে এবার তাদের অবস্থান দাঁড়াবে মুসলিম লীগের মতো। এবারের জনসভায় আরেকটা সুলক্ষণ হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি। তাহলে কি বিএনপি জামায়াত-শিবির থেকে আলাদা হয়ে নির্বাচন করতে চায়? বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। জামায়াত নিজেরা দলীয় প্রার্থী হয়ে তো নির্বাচন করতে পারবে না। তাই তাদের বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে অথবা স্বতন্ত্র হিসেবে নিবাচন করতে হবে। তাই রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে জামায়াত-শিবিরকে দৃশ্যমানভাবে জনসভায় অনুপস্থিত রেখে বিএনপি প্রমাণ করতে চায় যে, জামায়াত তাদের সঙ্গে নেই; তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির দাবি পূরণে আগ্রহী। অর্থাৎ জামায়াতের সঙ্গে তারা তাদের সংশ্লিষ্টতা কমিয়ে আনতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। আসলে বাস্তবতা তা নয়। কিছুদিন আগে রংপুরে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের সম্মিলিতভাবে চালিত সংখ্যালঘুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট প্রমাণ করে জামায়াত-শিবির বাইরে থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আগের মতো বিএনপিকে আবার ক্ষমতায় আনতে চায়। দল হিসেবে জামায়াতের নির্বাচন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবার কারণে তারা বিএনপির পরোক্ষ সমর্থনে হয়তো নির্বাচনে অংশ নেবে। আর তা সম্ভব না হলে নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে আগের মতো সহিংসতা চালিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়বে না। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় যদি কোনো অবস্থাতেই বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে রাজপথে আবার সহিংস আন্দোলন সৃষ্টি হবে। দেশে আবার সহিংসতা সৃষ্টি হলে জনগণ তা রুখে দাঁড়াবে। ২০১৪ সালে যা ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে আর ঘটবে না। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আ.লীগ, বিশেষ করে দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি সবার অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচন করতে চান। আর সে নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। তিনি তার কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনের কথা চিন্তা-ভাবনা যেন কর্মীদের ভেতর কাজ না করে। এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই বিজয়ী হতে হবে। আর সঠিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে প্রার্থীদের যোগ্য, সৎ ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। বিএনপির কথা চিন্তায় নিয়েই তিনি এই ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন তার কর্মীদের। নির্বাচন কমিশনকে যতদূর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করা যায়, সরকার সে ব্যাপারে সচেতন রয়েছে। তাই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হলেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না, বিএনপির এরূপ ধারণা সঠিক নয়। বিএনপিকে অবশ্যই দেশের সংবিধান, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন করতে হবে।

ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App