×

মুক্তচিন্তা

এবার আন্তর্জাতিক সংবাদ টিটু রায়

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:১৩ পিএম

সব জেনেবুঝে তাই সংখ্যালঘুদের এ কথা ভুললে চলবে না, আপন শক্তিতেই প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে বুকে সাহস নিয়ে। জঘন্য অপশক্তির বিরুদ্ধে একসঙ্গে প্রতিবাদী হতে হবে সবাইকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যেও যারা বিবেকবান, হৃদয়বান হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে সর্বদাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তাদেরও সম্মিলিত শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।

রামুর বৌদ্ধ তরুণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিরক্ষর হিন্দু রসরাজ দাসের পরে এবার রংপুরের টিটু চন্দ্র রায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের বেদনাদায়ক খবর হয়েছেন। সংবাদের শিরোনাম- ‘ম্যাসিভ অ্যাটরোসিটিস আর বিইং ইমপ্লিমেন্টেড এগেইনস্ট দ্য হিন্দু মাইনোরিটিস ইন বাংলাদেশ’ (র‌্যাচেল আব্রাহাম)। ঠাকুরপাড়া গ্রামের টিটু রায় এখন হাতে হাতকড়া পরে টেনশনে আধমরা হয়ে চারদিনের পুলিশ রিমান্ড শেষ করে আবারো চারদিনের জন্য জিজ্ঞাসাবাদে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- ফেসবুকে অবমাননাকর ছবি পোস্ট করে, নবী সম্পর্কে কটূক্তি লিখে তিনি নাকি ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের প্রাণে ভয়ঙ্কর বিদ্বেষের দাবানল জ্বালিয়েছেন। ২০১২ সালে এভাবেই কুরআন অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছিল রামুর বৌদ্ধ তরুণের বিরুদ্ধে। ২০১৬-এর ৩০ অক্টোবর কাবার বিকৃত ছবি পোস্ট করে অভিযোগের তীরে বিদ্ধ করা হয়েছিল নাসিরনগরের রসরাজ দাসকে। ধর্মরক্ষার প্যালাদার, আহলে সুন্নত আল জামাত আর হেফাজতিরা সে দিন তাকে বিধ্বস্ত করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছিল। রামুতে পুড়ে ছাই হয়েছিল এক ডজনের বেশি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আশ্রয়। বিধ্বস্ত হয়েছিল পবিত্র বৌদ্ধ মন্দির। রসরাজের বাড়িসহ ৫৮টি হিন্দু বাড়ি, ১৭টি মন্দির জ্বালিয়ে লুটপাট করেছিল মুসল্লিরা। টিটুর গ্রামেও ৩০টি বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দস্যুর মতো লুটপাট করা হয়েছে এবার। এখন দফায় দফায় চলছে রিমান্ডের পালা। এরপরে আরো কত সংখ্যালঘুর জীবনে পালাক্রমে এমন অভিযোগের মালমসলা তৈরি করে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ করা হবে, কে বলতে পারে।

যাই হোক, যেহেতু মুসল্লিদের প্রাণে আগুন জ্বালানোর এটাই নাকি সংখ্যালঘুদের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা (ফেসবুকে ধর্ম সম্বন্ধে বাজে মন্তব্যসহ আপত্তিকর ছবি পোস্ট করা), তাই আধুনিক মুসল্লিরাও ব্লাসফেমি আইন বাস্তবায়নে এই বিশেষ পদ্ধতিটি ধরেছে। মাইনোরিটি গ্রুপ নিশ্চিহ্ন করতে প্রযুক্তিবিদ্যার হাতিয়ার দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে বিদ্রোহের বীজ বুনছে। যাতে বহু মানুষের বিদ্বেষ দিয়ে একবারের আক্রমণেই গোটা সংখ্যালঘু পাড়াকে খতম করা যায়। এমন পুণ্য কর্মে ধার করা মুসল্লিদের অভাব কখনো ঘটে না। কারণ এদের মতে ধর্ম রক্ষা মানে ছলেবলে কৌশলে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ শানিয়ে অন্য বিশ্বাসীদের খতম করা। চরমপন্থী ধর্মরক্ষকরা তাই এই পন্থা অবলম্বন করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অসামরিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। রসরাজের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছিলেন- রসরাজ নিরপরাধ। টিটু রায়ের পরিজনরাও বলেছেন- যে ঘটনা টিটু ঘটিয়েছেন বলে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে, সম্পূর্ণ মিথ্যা সেটা। কারণ অভিযুক্ত টিটু রায় অক্ষরজ্ঞানহীন। লিখতে-পড়তে অসমর্থ। জাতিধর্ম নির্বিশেষে গ্রামবাসীও জানিয়েছেন- রায় পরিবারের বক্তব্য সম্পূর্ণ সত্য। এছাড়াও ফেসবুক আইডিতে টিটু রায়ের নয়, নাম রয়েছে এম ডি টিটুর। ১১ নভেম্বরের ঢাকা ট্রিবিউনের সংবাদ অনুযায়ী- ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে ‘এম ডি টিটুর’ নামে।

গ্রামবাসী আরো বলেছিলেন, হিন্দুপাড়ায় চড়াও হওয়ার ক’দিন আগে স্থানীয় মার্কেটে কয়েকজন মানুষ যে বিতর্কিত ছবি এবং লেখাগুলো তাদের দেখিয়েছিল তাতে টিটু রায় নয়, ছিল এম ডি টিটুর নাম। মসজিদ, মাদ্রাসা থেকেও প্রতিদিন মাইকিং করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রশ্ন উঠে আসে- কোনো ইমেজ আপলোড করে স্টেপ বাই স্টেপ পরিবর্তন করার জন্য (বিকৃতভাবে) যে কম্পিউটার অ্যানিমেশন টেকনিক ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে, একজন নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষে সেটা অপারেট করা সম্ভব কি? যে ব্যক্তির অক্ষর পরিচয়ই নেই, তার পক্ষে মন্তব্য লেখা কোন অলৌকিক উপায়ে সিদ্ধ হয়? যখন দিনের পরে দিন মাইকিং করে সমাজের বীভৎস আগাছাগুলো উত্তেজনাকর খবর ছড়াচ্ছিল, তখন স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এর বিরুদ্ধে কেন পদক্ষেপ নেননি? একজন বৌদ্ধ কিংবা হিন্দু যুবকের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে পুরো হিন্দু পাড়াকে, বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র কতখানি ক্ষমার যোগ্য? যারা এমন ষড়ন্ত্রের জন্মদাতা, সেসব অপরাধী কী করে জামিনযোগ্য হয়? বারবার দুর্বৃত্তদের ষড়যন্ত্র প্রমাণ হওয়ার পরেও, কাদের খুশি করতে নিরপরাধ সংখ্যালঘুদের বারবার রিমান্ডে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে? আর তাদের বিরুদ্ধে মামলাই বা কী করে সাজানো হয়?

অথচ ২০০৩ সালে স্থানীয় বিএনপি নেতার ক্যাডাররা বাঁশখালীর শীল পরিবারের মানুষগুলোকে পুড়িয়ে মারার পরেও আসামির বিরুদ্ধে পুলিশরা সাক্ষ্য দিতে চায় না। সাক্ষী আনতেও অনিচ্ছুক। ২০০১ সালে দেশব্যাপী যে অমানুষগুলো বিপর্যয় ঘনিয়ে তুলেছিল তাদের বিরুদ্ধে বিচারপর্ব চলে না। সাঁওতালপল্লীতে আগুন লাগিয়ে, নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামলবাবুকে অমর্যাদা করে সাজা হয় না। এমনকি রামুর বৌদ্ধ তরুণ, রসরাজ আর টিটুর বিরুদ্ধে মূল ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা হয় না। কিন্তু মাইনোরিটি গ্রুপকে বিনা দোষেই নিষ্পেষণ করা চলে। অপমান করা চলে। তাদের সম্পত্তি দখল করায় অপরাধ হয় না। হত্যায় হয় না। উচ্ছেদে হয় না। এ কথা ঠিক, যে কোনো নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সিগন্যাল পেয়ে সারাদেশে হত্যাকাণ্ড, অপহরণসহ অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জোয়ার আসে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিঃশেষ করার প্রক্রিয়া পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই চলছে। বর্তমানে সাম্প্রদায়িক মানুষ, মোট জনসংখ্যার বিরাট একটি অনুপাত। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সবখানেই যাদের শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব।

 

ভাগ্যিস উৎপীড়িত সংখ্যালঘুরা বারবার একতরফের দাঙ্গায় ধনেপ্রাণে মরে গিয়েও প্রতিহিংসার আগুন জ্বালাতে পারেন না, তাই রক্ষা। ভাগ্যিস পাকিস্তনের মতো বাংলাদেশেও ১৯৪৭ সালের পর থেকে তাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে জনপরিসংখ্যানের তলানিতে এসে ঠেকেছে, তাই বাঁচোয়া। ভাগ্যিস এদের অবিচার নিয়ে, নির্যাতন নিয়ে, হত্যাপর্ব নিয়ে দু’চারজন বিবেকবান ছাড়া সিংহভাগ মানবদরদীরাই স্বদেশের আকাশ-বাতাস মথিত করে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে উসকে দিতে চান না, তাই স্বস্তি। এমনকি দেশের ক্ষুদ্রতম বিচ্যুতিও যারা দেখতে পান বলে বড়াই করেন, সেই চক্ষুষ্মানরাও অন্ধত্বের ঠুলি পরে এদিকে নজর দিতে চান না বলেই, ষড়যন্ত্রকারীদের শান্তি।

সব জেনেবুঝে তাই সংখ্যালঘুদের এ কথা ভুললে চলবে না, আপন শক্তিতেই প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে বুকে সাহস নিয়ে। জঘন্য অপশক্তির বিরুদ্ধে একসঙ্গে প্রতিবাদী হতে হবে সবাইকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যেও যারা বিবেকবান, হৃদয়বান হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে সর্বদাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তাদেরও সম্মিলিত শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ অন্যসব ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মতো আপনারাও মাতৃভ‚মিতে মাইনোরিটি সম্প্রদায়। একই জন্মভ‚মিতে জন্ম নেয়ায়, একই সংস্কৃতিতে লালিত হওয়ায়, একই মানবিকতা অন্তরে ধারণ করায়, জননীসম মাতৃভ‚মিকে একইভাবে ভালোবাসায় হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান আপনাদেরই ভ্রাতা-ভগ্নি। মনে রাখতে হবে, যে অপশক্তি জাতির পিতা হত্যাকারী, নিজের ভ্রাতা-ভগ্নির হত্যাকারী রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিতে উৎসাহী হয়, তারা আর যাই হোক মানবিকতার অপমান করায় কারো বন্ধু হতে পারে না। আপনাদের সংস্কৃতিকে, মানসিকতাকে অনুভব করতে ব্যর্থ এরা। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এসব ভূতপ্রেতের তাণ্ডবলীলা কঠোর হাতে বন্ধ করতে না পারলে একদিন অনুশোচনার জ্বালায় জ্বলে সবাইকেই পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হবে।

দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App