×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক শিথিলতা ও অসামাজিক প্রবণতা

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০১৭, ১০:৫০ পিএম

যাদের টাকা আছে, যাদের পেশিশক্তি আছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ আছে তারাই তো ক্ষমতার অধিকারী। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কোনো চেষ্টা, কোনো আগ্রহ বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে নেই, সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও নেই। প্রচার মাধ্যম Status quo রক্ষা করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে কাজ করছে।

বাস্তবে ব্যক্তিতন্ত্র (individualism) ও সমাজতন্ত্র (socialism) একটি অন্যটির বিরোধী। ব্যক্তিতন্ত্রীরা আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক যে ব্যবস্থার অনুরাগী, তাকে বলা হয় পুঁজিবাদ। কার্ল মার্কস ও তার অনুসারীরা পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত, শ্রেণি, শ্রেণিসংগ্রাম, বুর্জোয়া একনায়কত্ব, শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তাদের ধারণারাজিকে এত সুদৃঢ়, গভীর ও ব্যাপক রূপে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যে, সেগুলো নিয়ে উন্নত টেকনোলজির এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় এগোনো যাচ্ছে না। মার্কস ও মার্কসবাদীরা আর্থ-সামাজিক দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন বটে, তবে মনের দিকটাতে গুরুত্ব খুব কম দিয়েছেন। আমার মনে হয়, নতুন বাস্তবতায় সভ্যতা ও প্রগতির ধারায় উত্তীর্ণ হতে গেলে সব ধারার চিন্তারই মৌলিক পুনর্বিবেচনা দরকার এবং দরকার সর্বজনীন কল্যাণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন চিন্তাধারা ও নতুন কর্মধারা। The philosophers have only interpreted the world in various ways; the point, however, is to change it. কার্ল মার্কসের এই কথাটা মনে হয় অপরিবর্তনীয় ও অবশ্য পালনীয়। বাংলাদেশে philosophers এর অবস্থানে দাঁড়িয়ে বহুজন টক শোতে এবং উপসম্পাদকীয় লেখায় নানাভাবে নিরন্তর বাস্তব অবস্থাকে interpret করে চলছেন। দরকার interpretation-এর সঙ্গে change-এর জন্য কাজ। আমার মনে হয় ‘পুঁজিবাদ’ কথাটার পরিবর্তে ‘ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক ধনতন্ত্র’ কথাটা গ্রহণ করলে এবং পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দগুলোকেও পরিবর্তন করে নিলে বাস্তবকে বুঝতে এবং অভিপ্রেত সম্ভাব্য ভবিষ্যতকে অনুমান করতে সুবিধা হবে। এখানে আমি বিষয়টির প্রতি পাঠকদের কেবল দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। এ সম্পর্কে চিন্তাশীল সবার চিন্তা করার ও পারস্পরিক মতবিনিময়ের দরকার আছে। সাধারণ পাঠকদেরও স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে হবে।

সমাজতন্ত্রে ব্যক্তির চেয়ে সমাজকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় এবং সামাজিক কর্তৃপক্ষ ব্যক্তির নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করে। সমাজতন্ত্রীরা, মার্কসবাদীরা তো বটেই, উৎপাদনযন্ত্রের ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চান। কার্যক্ষেত্রে সামাজিক মালিকানা তো সরকারি মালিকানা ও সরকারি ব্যবস্থাপনাই। সরকারি ব্যবস্থাপনাকে তারা জনসম্পৃক্ত রাখতে চান এবং তার নানা উপায় উদ্ভাবন করেন।

নতুন প্রযুক্তি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর পৃথিবীতে এখন যাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা ব্যক্তিতন্ত্রের ধারক-বাহক-সমর্থক এবং সমাজতন্ত্রের বিরোধী। ব্যক্তিতন্ত্রকে তারা liberalism বলে অভিহিত করেন। আসলে individualism বা liberalism অবলম্বন করে যে ব্যবস্থা কার্যকর রাখা হচ্ছে, তাকে বলা হয় ‘জোর যার মুল্লুক তার’। বিশ্বব্যবস্থায় আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা, যুদ্ধবিগ্রহ, ক‚টনীতি, ঋণনীতি, বাণিজ্যনীতি, প্রচারনীতি ইত্যাদির দিকে তাকালে একদিকে দেখা যায় শক্তিমান, অপরদিকে দেখা যায় দুর্বল; একদিকে জালেম, অপরদিকে মজলুম। ‘জোর যার মুল্লক তার’ নয়তো কী?

বেকার সমস্যার এই রাষ্ট্রে মেয়েরা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মের সন্ধানে গিয়ে, চাকরি করতে গিয়ে, অনেকেই দেহদানে বাধ্য হয়। জীবন থেকে প্রেম উবে যায়, থাকে শুধু কাম। নারীবাদী আন্দোলনের কালে নারী নির্যাতন যে কমেছে, তা দেখা যায় না, বাস্তবে নানা কারণে নারী নির্যাতন অনেক বেড়ে যাওয়ার খবরই পাওয়া যায়। পরিবার ক্ষয়িষ্ণু, সাময়িক লিভ টুগেদার, পরকীয় পরকীয়া, সোস্যাল গার্ল, ফ্রি সেক্স রিলেশন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের পর হত্যা, স্বামী স্ত্রী সন্তানের সম্পর্কের মধ্যে নিদারুণ টেনশন এবং হত্যা ও আত্মহত্যা, ফেসবুকের অপব্যবহার, ড্রাগ নেশা ইত্যাদির প্রসার- সমাজের জীবনের প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছে। প্রসটিটিউশন কমে গেছে। ভোগবাদীরা যে জীবনযাপন করেছেন তাতে ‘প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই’। অনেক নারী ও পুরুষের চলন-বলন দেখে লোকে তাদের বলে ‘যৌন চেতনার পিন্ড’ ওয়াশিংটন থেকে ঢাকা পর্যন্ত, লন্ডন থেকে মেলবোর্ন পর্যন্ত, টোকিও থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত সর্বত্রই মানুষ যেন মনুষ্য বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে জন্তু-জানোয়ারের বৈশিষ্ট্য অর্জন করছে! ব্যতিক্রম আছে, বিপুল অধিকাংশ মানুষই ব্যতিক্রম। তবে তারা ঘুমন্ত- তাদের মধ্যে চেতনা জাগ্রত নয়। তারা অবস্থার দাস, প্রবৃত্তিরও দাস। যারা জন্তু-জানোয়ারের স্বভাব অর্জন করছে তারা অবস্থার প্রভু বটে, কিন্তু প্রবৃত্তির দাস। এই যে অবস্থা চলছে, এনিয়ে ভাসাভাসা কথাবার্তা হয় বটে, তবে সবাই এই অবস্থাকে মেনে নিয়েই চলছে, পরিবর্তন চাইছে না, আশাও করছে না। প্রশ্ন হলো, গরু-ছাগল, শিয়াল-কুকুর, বাঘ-সিংহ, হাঙ্গর-কুমির প্রভৃতি প্রাণীর জীবন যেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বাভাবিক, সেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে মানুষের জীবন কি স্বাভাবিক? মানুষের জীবনে অপরাধবোধ আছে, অনুশোচনা আছে, রাগ-দ্বেষ আছে, হিংসা-প্রতিহিংসা আছে, খুন-খারাবি আছে...। জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে এসব কতখানি আছে?

অদূর ভবিষ্যতে পরিবার কি বিলুপ্ত হবে? দুই হাজার বছর আগে সমাজে কাম-ব্যবস্থাপনার সমস্যা বিচার করতে গিয়ে বাৎসায়ন ‘কামসূত্র’ নামে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। নানা রকম বিবাহ এবং কিছু বিবাহ-বহিভূত ‘সম্পর্কও’ তিনি লক্ষ করেছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ছিল পরিবার-ব্যবস্থার সমর্থনে। সোয়া দুই হাজার বছর আগে প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় সমাজের উচ্চশ্রেণিতে (masters) বিবাহ প্রথা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন (communism of wife and children)। ওয়েস্টারমার্ক, মর্গান, এঙ্গেলস মানুষের সমাজে পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, রাষ্ট্র ও morals-এর উৎপত্তি, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন এবং কিছু সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেছিলেন? জন্তু-জানোয়ার থেকে মানুষের ভিন্নতা তারা নির্দেশ করেছিলেন। সেই ধারায় নতুনভাবে চিন্তা করার- ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারণের প্রয়োজন কি নেই? মানুষ জন্তু-জানোয়ারের আচরণ নিয়ে চলবে?

কলকাতার অত্যন্ত জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল তারা মিউজিক খাজা গোল্ড নামক একটি যৌন-উত্তেজনক ওষুধের যে বিজ্ঞাপন রাত-দিন প্রচার করে, তার সুফল বাংলাদেশের সমাজে, পশ্চিম বাংলার জনজীবনে কী ঘটছে? প্রশ্ন আমার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে, শেখ হাসিনার কাছেও। যারা প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেন, তারা খাজা গোল্ডের এই বিজ্ঞাপন প্রচারের স্বাধীনতা সম্পর্কে কী বলবেন? বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের, যুবক-যুবতীদের, জনসাধারণের কী উপকার হচ্ছে এর দ্বারা? নীরদ চৌধুরীর একটি লেখায় ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’- এই উক্তির জন্য এরশাদ আমলে ‘দেশ’ পত্রিকার প্রচার বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং সে জন্য ‘দেশ’ পত্রিকা বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। খাজা গোল্ডের বিজ্ঞাপনের জন্য তারা চ্যানেল (মিউজিক) বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয়া হলে ওই চ্যানেল ও বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সন্দেহ নেই। খাজা গোল্ডের মতো আরো নানা ওষুধ ঢাকার ওষুধের দোকানগুলোতে নিয়মিত বিক্রি হয়। সমাজে এর সুফল কী হচ্ছে? পুরাতন সংস্কার বিশ্বাসের ও ধর্মের পুনরুজ্জীবনে এখনো সহায়ক হচ্ছে। যারা সব সময় ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা ইত্যাদির কথা প্রচার করেন, মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন করেন, তারা এ নিয়ে কখনো কিছু বলেন না। লোকে মনে করে, এর প্রতি তাদের সমর্থন আছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের লোকে মনে করে ভোগবাদী, স্বেচ্ছাচারী।

একজন কবি, সাবেক সচিব একটি দৈনিক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘এখন সমাজের অবক্ষয় এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, আমরা অনেক কিছুই দেখেও দেখি না। অনেক কিছু এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। সমাজে অন্যায়-অবিচার-অনাচার এত বেড়ে গেছে যে, মানুষ প্রতিবাদ করারও আর প্রয়োজন বোধ করে না। আমাদের চারপাশে রোজ যে খুন-জখম-রাহাজানি, ধর্ষণ-অপহরণ-লুণ্ঠন চলছে, যার রগরগে বিবরণ রোজ খবরের কাগজে আমরা পাঠ করছি, তা আমাদের অনুভ‚তিগুলোকে ক্রমেই ভোঁতা করে ফেলছে। আগে সামান্য অশালীন আচরণের জন্য, একশ টাকা ঘুষ খাওয়ার জন্য, কেউ কাউকে জনসম্মুখে কটু-কাটব্য করার জন্য, যে কোনো মহিলার প্রতি অশোভন আচরণ করলে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যেত। আর এখন গড়ে উঠেছে দেখেও না দেখার সংস্কৃতি। এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- থাক বাবা, ওদের যা খুশি করুক, আমি ওতে নাক গলাতে গিয়ে আবার কোন বিপদে পড়ি! ফলে সমাজে অন্যায়, অশোভন আচরণ ও সেইসঙ্গে নানাবিধ অপরাধ বেড়ে চলছে অবাধে। সেইসঙ্গে চলছে বিচারহীনতার ও প্রতিকারহীনতার এক অভ‚তপূর্ব সংস্কৃতি। ...

আসলে বাংলাদেশের মানুষ এখন অন্যায়-অবিচারের প্রতি পরম সহিষ্ণু, বর্তমান নিয়ে শান্ত, সম্পূর্ণ পরিবর্তন-বিমুখ। মানুষ পরিবর্তন-উন্মুখ ছিল, আন্দোলন করে বারবার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কিন্তু পরিবর্তনের ফলে ভালো কিছু হয়নি- এক খারাপ থেকে আর এক খারাপের মধ্যে পড়েছে। এই অভিজ্ঞতার ফলে মানুষ এখন পরিবর্তন-বিমুখ। আগে হুজুগ তৈরি করে, মানুষকে উত্তেজিত করে, হুজুগে মাতিয়ে হীন-স্বার্থান্বেষীরা স্বার্থ হাসিল করে নিত। এখন লোকে এসব হুজুগে মাততে চাইছে না। হুজুগকে বলা হতো গণজাগরণ। এখন মানুষ এসব কিছু হলেও বুঝতে পারে। যাদের টাকা আছে, যাদের পেশিশক্তি আছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ আছে তারাই তো ক্ষমতার অধিকারী।

এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কোনো চেষ্টা, কোনো আগ্রহ বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে নেই, সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও নেই। প্রচার মাধ্যম ঝঃধঃঁং য়ঁড় রক্ষা করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে কাজ করছে। সুতরাং এসব নিয়েই চলতে হবে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক : সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App