×

মুক্তচিন্তা

শিশুরাই পথ দেখাচ্ছে

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০১৭, ০৫:৪৯ পিএম

আমাদের দেশে এখন বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়া করে। আমরা যারা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানুষ তারা প্রত্যাশা করি যে ওরা প্রোগ্রামার হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীদের শতকরা মাত্র ৮ ভাগ প্রোগ্রামিং শেখে।

একদিন প্রতিদিন

বরাবর আমরা পথ দেখানোর জন্য বড় বড় নেতা, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও আদর্শ মানুষ খুঁজি। নানা জন আমাদের আইডল হয়। এই খোঁজাখুঁজি মানব ইতিহাসের সূচনা থেকেই আছে। এটা থাকবেই। কেউ কেউ আমাদের সুমহান আইডল হবেনই। তবে প্রায় সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে আমার বারবারই মনে হচ্ছে যে, এই পথ দেখানোর কাজটা সাধারণভাবে শিশুরাই অনেক ভালোভাবে করে থাকে। ওদের সরলতা, মেধা, সৃজনশীলতায়ই আমরা সামনে পা ফেলার সাহস অর্জন করি। এমনকি শিশুরা অতি সহজেই কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

আমি আমার নিজের শৈশবের দৃষ্টান্ত থেকে স্মরণ করতে পারি। একটি সময় এসেছিল আমার জীবনে যখন আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, আমি মায়ের কোলে থেকে গরুর রাখাল হব, নাকি মাকে ছেড়ে ৪০ কিলোমিটার পথ হেঁটে স্কুলে যাব। আমি ৪০ কিলোমিটার পথ হাঁটার সিদ্ধান্ত নেই। সেদিন আমি সিদ্ধান্তটি ভুল নেইনি বলে লাঙ্গল জোয়াল আমার পেশা না হয়ে তথ্যপ্রযুক্তি পেশা হয়েছে। এই সময়ে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমার সামনে আছে যখন শিশুরা আমাকে পথ দেখিয়েছে।

গত তিরিশ বছর ধরে যখন তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করছি তখন আমার কাজের ক্ষেত্র বাছাই করতে সবার আগে পথ দেখিয়েছে শিশুরা। আমার সামনে দিনের পর দিন তথ্যপ্রযুক্তির নানা শাখা-প্রশাখায় নিজেকে নিয়োজিত করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমি সেখান থেকে শিশুদের শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে কাজ করার পথটা বেছে নেই। কোনো সন্দেহ নেই যে, এই পথটা কঠিনতম এবং এই পথে হাঁটতে আমাকে স্বাভাবিক পথ চলা তো দূরের কথা ঋণগ্রস্ততার মাঝে ডুবতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও যখন দেখি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি শিশু কেবল পড়ানোর পদ্ধতিটা বদলে দেয়ার ফলে পুরো এক বছরের পাঠক্রম এক মাসে শেষ করে তখন নিশ্চিতভাবেই আমি বলতে পারি যে, ওরাই আমাদের পথ দেখাতে পারে। নেত্রকোনার পূর্বধলার আরবান একাডেমির শিশুরা আমাকে সেই পথ দেখিয়েছে। ২০১৬ সালে ওদের ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে লেখাপড়া শুরু করাই। এক মাস পরে খোঁজ নিয়ে জানি যে, ওরা পুরো বছরের সিলেবাস এক মাসে শেষ করে ফেলেছে। এ জন্য আমি নিজের ভবিষ্যৎকে বাজি রেখে ঋণগ্রস্ত হয়ে ওদের লেখাপড়ার পদ্ধতিটা বদলাতে লড়াই করছি।

আরো একটি লড়াই শুরু করার উৎস ছিল আমার কিশোর ছেলে বিজয়। সে ইন্টারনেট থেকে স্ক্র্যাচ সফটওয়্যার ডাউনলোড করে নিজে নিজে শিখে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রোগ্রামার হওয়ার জন্য স্নাতক পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই। সেই লক্ষ্যেই আমি স্থির করি যে, শিশুদের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতার বড় সমস্যা হলো প্রতিযোগী পাওয়া। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তো প্রোগ্রামিং দূরের কথা তথ্যপ্রযুক্তিও শেখানো হয় না। তাই আগে ওদের প্রোগ্রামিং শেখাতে হবে এবং তারপর প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। ধন্যবাদ বেসিস বোর্ডকে যে তারা শিশু প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে সম্মত হলো। সেই ধারণাটি বাস্তবায়ন করার জন্য আমি বেসিসের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বিআইটিএমকে কাজে লাগাতে শুরু করি।

বেসিস তার অঙ্গ সংগঠন বেসিস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (বিআইটিএম) সহায়তায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিআইটিএমের ল্যাবে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ‘স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং পরিচিতি’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সর্বশেষটিসহ মোট ৭টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষিকা, শিশুসহ স্বেচ্ছাসেবকদের আগ্রহ বাড়ছে। অনেকেই আগ্রহী হয়ে বিআইটিএমের এই প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণ চলে। ইতোমধ্যেই ৭টি কর্মশালায় ২৩৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। মূলত শিশুদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং শেখানোর জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারা যাতে তাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে এই জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পারেন সে জন্য এই কর্মশালার আয়োজন করা। ইতোমধ্যেই এই প্রশিক্ষণের কথা জানতে পেরে অনেক শিশুই, এমনকি মা ও তার সন্তান একই সঙ্গে এই প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার উদাহরণ রয়েছে। প্রশিক্ষণ নেয়ার পাশাপাশি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং শেখানোর কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দল অঞ্চলভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শুরু করেছেন।

আমি সর্বশেষ কর্মশালাটির উল্লেখ করতে পারি। বেসিস এই বিষয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে, তার অংশ বিশেষ নিম্ন রূপ- গত ৩ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে ৭ম বারের মতো স্ক্র্যাচ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেসিস সভাপতি জনাব মোস্তাফা জব্বার। তার সঙ্গে রিসোর্স পারসন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব মোস্তাফা জব্বারের ছেলে জনাব বিজয় জব্বার।

শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ শেষে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে সনদপত্র বিতরণ করা হয়। এতে অন্তত তিনজন শিশু (পূর্ণতা, মোশাইদ ও মারজান) অংশ নেয়। কর্মশালায় বাংলাদেশ ডিজিটাল এডুকেশন সোসাইটির চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া খান রিজন এবং শিশু সাহিত্যিক জসিমউদ্দীন জয় উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বেসিস সভাপতি জনাব মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে ও আগামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। আমরা  স্নাতক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং শেখানোর কথা ভাবি। কিন্তু ওরা বস্তুত শৈশব থেকেই প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা পেতে পারে। আমরা শিশুদের জন্য সেই ব্যবস্থাটিই করতে চাই। শিশুদের প্রোগ্রামিং শেখানোর মাধ্যমেই সেটি সূচনা করতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়ে ‘শিশু-কিশোরদের প্রোগ্রামিং শিক্ষা’ শীর্ষক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং শেখানো হচ্ছে। আমরা ২০১৮ সালের শুরুতে এসব শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি জাতীয় শিশু প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করব।’

জনাব মোস্তাফা জব্বার জানান যে, তার ছেলে বিজয় তার শৈশবে স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং ধারণা পায়। সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম দিককার স্ক্র্যাচ ব্যবহারকারীদের মাঝে বিজয় জব্বার একজন। সে এখন বাংলাদেশের শিশুদের জন্য স্ক্র্যাচের ওপর কোর্স ম্যাটেরিয়াল তৈরির কাজ করছে যেগুলো শিশু ও শিক্ষকদের কাছে পৌঁছানো হবে।

অনুষ্ঠানে জনাব বিজয় জব্বার স্ক্র্যাচ কেন শিশুদের শেখাতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ার সময় কেন স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং শেখানো শুরু করা হয়েছিল সেসব বিষয় তুলে ধরেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন যে, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের স্নাতক স্তরের শিক্ষার্থীদের স্ক্র্যাচ দিয়েই প্রাথমিক প্রোগ্রামিং ধারণা প্রদান করে। তিনি নিজেও স্নাতক স্তরে স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিংয়ের সূচনা করেন বলে জানান। তিনি বলেন যে, একে কোড লেখার বাইনারি অঙ্কের প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। এটি খেলতে খেলতে প্রোগ্রামার হওয়ার হাতিয়ার। কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন বিআইটিএমের প্রোগ্রামিং প্রশিক্ষক সিরাজুল মামুন এবং তাকে সহায়তা করেছেন মায়া শারমিন।

শেষ কর্মশালার তিনটি শিশু ছাড়াও এর আগের কর্মশালাগুলোতে আমি আরো কয়েকটি শিশুকে পেয়েছি। একটি কর্মশালায় জাইফ নামের অষ্টম শ্রেণির একটি ছাত্র অংশ নিয়েছিল। জাইফ জীবনে প্রথমবার স্ক্র্যাচ শেখে বেসিসের কর্মশালায়। সকাল থেকে শেখা শুরু। বিকেলে প্রথমে সে তার মাকে শেখায় এবং এরপর ৩০ জন অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের যারাই তাদের প্রকল্প ঠিকমতো করতে পারেনি তাদের দেখিয়ে দেয়। কর্মশালায় যারা অংশ নেন তারা নিজেরা ভাবতেই পারেনি যে, এই শিশুটি তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে স্ক্র্যাচে এমন দক্ষতা দেখাতে পারবে। এই কর্মশালাতেই অংশ নিয়েছিল মায়া শারমিন নামক একটি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ে। সে নিজে নিজে স্ক্র্যাচ শিখে এখন প্রশিক্ষক হয়েছে। তানজিবা নামের একটি মেয়ে পেশায় ডাক্তার। সেও এখন মিরপুরের স্কুলে স্কুলে শিশুদের স্ক্র্যাচ শেখায়। কেউ যদি স্ক্র্যাচের ওয়েবসাইটে যান তবে দেখতে পাবেন যে ওখানে কোটি কোটি স্ক্র্যাচ প্রকল্প জমে আছে যা সারা দুনিয়ার শিশুরা তৈরি করে চলেছে।

আমাদের দেশে এখন বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়া করে। আমরা যারা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানুষ তারা প্রত্যাশা করি যে ওরা প্রোগ্রামার হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীদের শতকরা মাত্র ৮ ভাগ প্রোগ্রামিং শেখে। এই নিম্ন সংখ্যার অন্যতম একটি কারণ হলো যে, স্নাতক পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীরা প্রোগ্রামিংকে শেখার মতো বিষয় বলে গ্রহণ করতে পারে না। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে শৈশবে প্রোগ্রামিং ধারণার সঙ্গে শিশুদের পরিচিত করান। আমরা যদি আমাদের নতুন প্রজন্মকে ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চাই তবে এই পথে হাঁটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প আমাদের নেই। আসুন শিশুদের প্রোগ্রামিং শেখাই। ওরাই আমাদের এই জাতিকে ডিজিটাল যুগের পথ দেখাক।

ঢাকা, ৯ নভেম্বর ১৭ মোস্তাফা জব্বার : লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App