×

মুক্তচিন্তা

জেল হত্যাকান্ড ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০১৭, ১০:৪৩ পিএম

নতুন প্রজন্মের যারা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করে চলেছে তাদের কাছে আমার আবেদন শুধু স্লোগান সর্বস্ব হলে চলবে না, কাজ করতে হবে। আদর্শের ওপর ভর করে ও চরম আত্মত্যাগের বিনিময়েই রাজনীতি অর্জন করা সম্ভব। আবার যে ১৯৭৫-এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে। ১৯৭৫-এর ঘটনাপ্রবাহ থেকে শেখ হাসিনার পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগ শিক্ষা নিয়ে যেন আগামীতে সংকট মোকাবেলায় সদা প্রস্তুত থাকে- এই আহ্বান জানাচ্ছি।

১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ও নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল, তা ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে স্বগৃহে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। যে কারণে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, একই কারণে তারা বঙ্গবন্ধুর আজীবন সহচর মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় ৪ নেতাকেও কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় রাতের অন্ধকারে খুনিদের অনুমতি দিয়ে হত্যা করানো হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৮২ দিনে তৎকালীন নির্বাচিত জাতীয় সংসদ কার্যকর রাখা হয়েছিল। খুনিদের ধারণা ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড জাতীয় সংসদে অনুমোদন করিয়ে নেয়া যাবে। খুনিরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের যেসব সদস্য তখন ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন বেছে বেছে তাদের হত্যা করা হয়। নিরপরাধ, নিরীহ ও অবলা নারী এমন কি শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে তাদের হত্যা করা সম্ভব হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের যেসব সদস্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সক্রিয় রাজনীতি করতেন যেমন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ মনি ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তাদের বাড়িতেও একই সময় আক্রমণ করা হয়েছিল। শেখ মনি ও তার স্ত্রী শেখ আরজুমান মনি এবং ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ির বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের প্রকৃতি দেখে মনে হয় যে, খুনিরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্য জীবিত থাকলে যে লক্ষ্যে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তা সফল করা সম্ভব হবে না। তাই তারা দশ বছরের রাসেলকেও হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে ৮২ দিন জাতীয় সংসদ কার্যকর করা হয়েছিল সে সময় খন্দকার মোশতাক ও তারা সহযোগীরা অন্তত ২ বার পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে বসতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমবার প্রায় ৪১ জন সদস্যের সঙ্গে মোশতাক বসতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় বার ২৬২ জন সংসদ সদস্যকে বঙ্গভবনে সরকারি নির্দেশে হাজির করা হয়। সেখানে তৎকালীন নির্বাচিত সাংসদরা বিশেষ করে বর্তমান আইনমন্ত্রীর পিতা এড. সিরাজুল হক মোশতাককে প্রশ্ন করেন কেন তিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছেন। অন্যরা উত্তেজিত হয়ে মোশতাককে খুনি বলে অভিহিত করেন। ঠিক এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মোশতাক তার আন্তর্জাতিক প্রভুদের যে আশ্বাস দিয়েছিলেন শুধু বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অপসারিত করতে পারলে তিনি সাংসদদের ম্যানেজ করতে পারবেন। বঙ্গভবনের ঘটনাই প্রমাণ করে যে, ওটা করা মোশতাকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখনই অনুধাবন করা যায় পর্দার অন্তরালে খন্দকার মোশতাককে যিনি ক্ষমতায় বসিয়েছেন তাকে লাইম লাইটে নিয়ে আনা হয় এবং জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যই ৩ নভেম্বর যে জেলখানা হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মোশতাক তৎক্ষণাৎ বুঝে নিয়েছিল যে, জেলখানার ৪ নেতা জীবিত থাকলে তারা যেভাবে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে পরিচালনা করতে চান তা করা সম্ভব হবে না। তাই ৩ নভেম্বর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বস্তুত ৩ নভেম্বর হতে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত যা যা ঘটেছিল, তা ছিল একই ঘটনার বিভিন্ন পর্যায়। যে ৮২ দিন সংসদ কার্যকর তখন সাংবিধানিক বাস্তবতা ছিল স্পিকার প্রকৃত অর্থেই রাষ্ট্রপতি হয়ে গিয়েছিলেন। অবৈধ খুনি মোশতাক রাষ্ট্রপতি বনে গেলেও তার কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না। যেহেতু পার্লামেন্ট স্পিকার কর্মরত রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে সাংবিধানিকভাবে দায়িত্ব পালন করার কথা তাই সাংবিধানিক স্পিকার আব্দুল মালেকের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব যারা কার্যকর ছিলেন, তারা সংবিধানের সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য বিচক্ষণতা ও সাহসিকতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়নি। একটার পর একটা হত্যাকাÐ ও বর্বরতার মুখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ প্রায় আত্মসমর্পণের নীতি অনুসরণ করেছেন। তারা এখনো বলে থাকেন তাদের নাকি কিছু করার ছিল না। সেদিন মাঝারি গেছের কয়েকজন সাংসদ যে অবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন তৎকালীন স্পিকার তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার কারণে সেদিনের উদ্যোগ কার্যকর না হওয়ার পরবর্তীতে জেলখানার হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সেদিন স্পিকারের নেতৃত্বে সরকার গঠনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং যে কারণে ১১ জন সাংসদ দেশের বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে সাংসদদের যে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কথা ছিল, তা করতে পারায় যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কারণেই জেলখানার হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়।

৯৬ জন সাংসদকে নিয়ে ১৭৬, কলাবাগান-সফর উদ্দিনের বাসায় যে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই সভার সিদ্ধান্ত অর্থাৎ সরকার গঠন ছিল মাত্র সময়ের ব্যাপার। যেসব সাংসদ ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন তাদের অনেকেই এখনো জীবিত আছেন। তাদের কেউ কেউ সেদিন সরকার গঠন করে প্রচার মাধ্যমে তা প্রকাশ পেলে ৯৬-এর জায়গায় ১৫১ জন সাংসদ একত্রিত হওয়ায় ব্যাপারটা খুব কঠিন কাজ ছিল না। সেদিন মালেক উকিলের নেতৃত্বে সংবিধান সম্মত সরকার গঠন করা হলে জেলখানার ৪ নেতার গায়ে হাত দিতে মোশতাক ও তার সহযোগী খুনিরা সাহস পেত না।

জেলখানার ৪ নেতার হত্যার ব্যাপারে অনেকেই আবেগ প্রসূত অনেক কিছু জেলহত্যা দিবস পালনে বলে থাকেন কিন্তু সেদিন তাদের যে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল তা করতে তারা নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন এবং সে কারণেই জেলহত্যার মতো হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। যদিও ধরে নেই মোশতাকের মন্ত্রিসভায় তাদের অনেকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে যোগদান করেছিলেন, তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় বাকি ২৫০ জন সাংসদ কী করেছিলেন। কিছু কিছু সাংসদ তো মোশতাকের সঙ্গে স্বপ্রণোদিত হয়ে দেখা করেছিলেন। বেশ কয়েকজন তাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য তৎপরতা চালিয়েছেন। যে ঐতিহাসিক সাংবিধানিক সুযোগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৮২ দিন বিদ্যমান ছিল তা সেদিনের আওয়ামী লীগ নেতারা কাজে লাগাতে পারেননি বা চাননি।

এ কথা ঠিক নয় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দেশের জনগণ সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। বরং বাস্তবতা হচ্ছে মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাংসদরা আবার সরকার গঠন করায় ও তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিবাদ না হওয়ায় জনগণ বিভ্রান্ত হয়েছিল। এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে খুনি মোশতাক একেকজনকে একেক কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চাচা শেখ মোশাররফ হোসেনকে ডেকে এনে বলেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার ব্যাপারে তিনি নির্দোষ। হঠাৎ করে নাকি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সুযোগ পেলেই তার বিচার করা হবে। যারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রতিনিয়তই জীবন দেয়ার ঘোষণা রাজনৈতিক সভায় দিতেন তারা বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর একমাত্র কর্নেল জামিল ছাড়া আর কেউই একবিন্দু রক্ত দেয়নি। যে মহান নেতা নিজের জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করে গেলেন, তার সৃষ্ট দল আওয়ামী লীগের অনুগামীরা তার হত্যাকান্ডের পর শুধু ঘটনা প্রবাহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বারবার মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছেন তাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে স্বাক্ষাৎ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে তার মতো করে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করতে না পারলে আন্দোলনের মাধ্যমে দলকে ক্ষমতাসীন করতে না পারলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জেল হত্যার বিচার, ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা কি সম্ভব ছিল।

নতুন প্রজন্মের যারা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করে চলেছে তাদের কাছে আমার আবেদন শুধু স্লোগান সর্বস্ব হলে চলবে না, কাজ করতে হবে। আদর্শের ওপর ভর করে ও চরম আত্মত্যাগের বিনিময়েই রাজনীতি অর্জন করা সম্ভব। আবার যে ১৯৭৫-এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে। বঙ্গবন্ধু যেমন দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন, তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা একইভাবে আত্মবির্সজনের যে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, তা তার মুখের কথা নয়, এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস ও অঙ্গীকার। ১৯৭৫-এর ঘটনাপ্রবাহ থেকে শেখ হাসিনার পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগ শিক্ষা নিয়ে যেন আগামীতে সংকট মোকাবেলায় সদা প্রস্তুত থাকে- এই আহ্বান জানাচিছ।

ডা. এস এ মালেক : বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App