×

মুক্তচিন্তা

মেমোরি অব দি ওয়ার্ল্ড

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:৩১ পিএম

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব পরিমণ্ডলে আরো একবার বাংলাদেশের জন্য অবিস্মরণীয় মর্যাদা এনে দিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। বাংলাভাষা, বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতিকে সীমাহীন ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, মৃত্যুর পরেও সেই দেশের উন্নতি ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে তিনি অবদান রাখছেন।

গত সোমবার (৩০ অক্টোবর) ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এক ঘোষণায় এ কথা জানান। এই তালিকায় ঠাঁই পায় বিশ্বের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকার মাধ্যমে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে। বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটি আন্তর্জাতিক তালিকাই মূলত ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেস্কো। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিকভাবে প্রভাব থাকতে হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘এখন সারাবিশ্ব আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জানতে পারবে। এই ভাষণ বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রেরণা। এই ভাষণেই জেগে উঠেছিল পুরো জাতি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই ভাষণে স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায় বাঙালিরা। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যায়।’ আন্তর্জাতিক এডভাইজরি কমিটি এই তালিকার প্রস্তাব দিয়ে থাকে। তারাই যাচাই-বাছাই করে থাকে পুরো প্রক্রিয়া। চলতি বছর ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর এ নিয়ে বৈঠকে বসে কমিটি। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় ৭ মার্চের ভাষণকে অন্তর্ভুক্ত করার। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বের মোট ৪২৭টি নথি মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে যুক্ত হয়েছে।

৪৬ বছর আগে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (সে সময়ের রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতাকামী ৭ কোটি মানুষকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহŸান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার ওই ভাষণের ১৮ দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

ইউনেস্কো জানিয়েছে, তাদের মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির ইন্টারন্যাশনাল এডভাইজরি কমিটি গত ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর প্যারিসে দ্বিবার্ষিক বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে এবার ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করার সুপারিশ দেয়। এরপর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ওই সুপারিশে সম্মতি দিয়ে বিষয়টি ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদে পাঠিয়ে দেন এবং সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তথ্য প্রকাশ করেন। নিয়ম অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল এডভাইজরি কমিটির সুপারিশে মহাপরিচালকের সম্মতি পেলেই কোনো দলিলকে ওই তালিকায় যুক্ত করে নেয়া হয় এবং পরে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হলো সেই সব নথি বা প্রামাণ্য দলিল. বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যার ঐতিহ্যগত গুরুত্ব আছে। আর সেসব ঐতিহ্যের তালিকা হলো ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’। এসব দলিল সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্বের মানুষ যাতে এ বিষয়ে জানতে পারে, সে জন্যই ১৯৯২ সালে এ কর্মসূচি শুরু করে ইউনেস্কো। এতদিন এই তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ৪২৭টি নথি ও প্রামাণ্য দলিল ছিল।

কোন দলিল বা নথি এই তালিকায় স্থান পাবে তা পরীক্ষা ও মূল্যায়নের দায়িত্ব রয়েছে ১৫ জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গঠিত এমডবিøউ কর্মসূচির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল রাইজি বর্তমানে এর চেয়ারম্যান। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আসা প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ৭৮টিকে এবার ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ যুক্ত করার সুপারিশে সমর্থন দেয়ার কথা জানিয়ে ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এসব স্মৃতি ও দলিল সংরক্ষণের এ কর্মসূচি এমনভাবে পরিচালিত হওয়া ইচিত, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোচনা, সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।’ আর ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার খবরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, ‘একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার অনুপ্রেরণার উৎস।...

আজো দেশে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ মাইকে বাজতে শোনা যায়। আজো সেই ভাষণ বাঙালির হৃদয়ে উদ্দীপনা জাগায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এখনো যেভাবে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে, আগামী প্রজন্মকেও একইভাবে অনুপ্রেরণা জোগাবে।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্ত পায়ে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশে। তারপর শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি বলে চলেন, ‘... আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...সৈন্যরা তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন এরপর বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন তার চ‚ড়ান্ত আদেশ- ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।

মাত্র ১৯ মিনিটের সেই অবিস্মরণীয় ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্য বাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি। রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের। প্রচার শুরুও হয়েছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার বন্ধ করে দিলে বেতারের বাঙালি কর্মচারী বেতার ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের সম্প্রচার কার্যক্রম। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গভীর রাতে অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় ইউনেস্কো মহাপরিচালক মিস ইরিনা বোকোভাকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই স্বীকৃতির ফলে এ ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেস্কোর মেমোরি অব দি ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) রেজিস্টারে নিবন্ধিত হলো। এমওডব্লিউতে এটাই প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল, যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে শিক্ষামন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নাহিদ ইউনেস্কো সদর দপ্তর প্যারিস থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন এবং তাকে অভিনন্দন জানান। মেমোরি অব দি ওয়ার্ল্ড-এ বর্তমানে ডকুমেন্ট ও সংগ্রহ দাঁড়াল ৪২৭টি।

বঙ্গবন্ধু পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেছিলেন এবং আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের প্রবল বিরোধী হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। বাঙালিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের চরম মুহূর্তে তিনি ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ঘোষণা করেন। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর বিচার করা হয়েছিল। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সরকার গঠনের জন্য তাঁকে আহ্বান জানানো হয়নি। এই প্রেক্ষাপটেই বঙ্গবন্ধু প্রথমে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। এ সময় থেকেই পাকিস্তান সরকারের কোনো আইন (পূর্ব) বাঙালিরা মানত না। এর পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নির্দেশ দ্বারা ১৯৭০ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হতো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনসাধারণকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে এক ঐতিহাসিক ক্যারিসমেটিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর যা কিছু অর্জন তার সব কিছু প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের অর্জন।

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App