×

মুক্তচিন্তা

বহুরূপী দৈত্য পুঁজিবাদকে কাজে লাগানো

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১১ পিএম

পুঁজিবাদকে তার পূর্ণাঙ্গ ও বিকাশমান রূপে দেখে যদি তার সঙ্গে বোঝাপড়া করা যায়, তাহলে আলিঙ্গন ও বিরোধিতা যাই হোক, তা যথাযথ হবে। ন্যায়ভিত্তিক কোনো সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে না পারা পর্যন্ত বিদ্যমান পুঁজিবাদের সব বিকশিত নতুন সম্ভাবনাময় দিকগুলো কাজে লাগাব না কেন?

বাংলাদেশে পুঁজিবাদ নিয়ে গালমন্দ অনেক, কারণ এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। তাই বলে আমরা পুঁজিবাদকে ছাড়িও না, আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে থাকি। বাঙালি মনে সাম্যবাদী চিন্তা প্রবাহমান। কিন্তু আধা সামন্তবাদী ও আধা পুঁজিবাদী থাবা এ মনের ওপর শক্ত করে চেপে বসে আছে। সাম্যবাদী চিন্তার একটা শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ধারা এখানে বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তব জীবনে মানুষকে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের মিশ্রিত পথেই চলতে হয়। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে সামন্তবাদের চেয়েও পুঁজিবাদের প্রতি বেশি বিদ্বেষ। জীবনযাপনে সবাই পুঁজিবাদী হলেও মুখে কেউ স্বীকার করতে চায় না। আমাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনে পুঁজিবাদ-বিদ্বেষ এমনই তীব্র। তবে পুঁজিবাদকে গালমন্দ করেই যেন আমরা দায় সারতে চাই। এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ সে তুলনায় কম।

পুঁজিবাদ নিয়ে আমাদের সচেতনতার প্রধান উৎস তিনটি- দেশের চলতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ব্রিটিশ-মার্কিন সাম্রাজ্যের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক পরিচয় এবং মার্কস-এঙ্গেলসের লেখালেখি। এই তিনটির মধ্যে দেশের বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অতিরিক্ত সামন্তবাদী ভেজালে মিশ্রিত। চরিত্রের দিক থেকে ব্যবস্থাটি খোলামেলা লুটেরা প্রকৃতির যা উন্নত দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে ও মার্কিন সাম্রাজ্যের সঙ্গেও জানাশোনা ভালোই। তবে এ দুই সাম্রাজ্যের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। ব্রিটিশদের মতো সরাসরি সৈন্যবাহিনী দিয়ে মার্কিনিরা পরদেশ দখল করে বসে থাকে না। ইরাক ও আফগানিস্তান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তবে সন্ত্রাসী, গণমাধ্যম ও মার্কিন কোম্পানি আমেরিকার সৈন্যবাহিনীর কাজটি আরো পোক্তভাবে করে থাকে। আর মার্কস-এঙ্গেলসের পুঁজিবাদ নিয়ে আলোচনা দেড়শ বছরের পুরনো যার মূলে এখনো সত্য থাকলেও পুঁজিবাদের ডালপালায় বা পোষকে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে তা পাওয়া যাবে না।

পুঁজিবাদ সম্পর্কে এই তিনটি উৎস থেকে আমাদের আহরিত ধারণায় কিছু বড় ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে পুঁজিবাদী বিকাশের চিত্র অনুপস্থিত। এই তিনটি উৎসই আমাদের মান্ধাতা আমলের পুঁজিবাদ সম্পর্কে ধারণা দেয়। আমাদের মাঝে যার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো বিদ্বেষ ও বিরোধিতা। এর ফলে আমাদের দেশীয় পুঁজিপতিদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। সংকীর্ণ ও বিচার-বিশ্লেষণ রহিত পুঁজিবাদ বিরোধিতায় লাভ হয়েছে বরং লুণ্ঠক পুঁজিপতিদের। এতে না দেশপ্রেমিক পুঁজিপতিদের সুবিধা হয়েছে, না সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটেছে। আধুনিক পুঁজিবাদের মাঝেও যে মানবিক উন্নয়নের ও বিকাশের সম্ভাবনা বিদ্যমান, তার রাজনৈতিক সদ্ব্যবহার সম্ভব হয়নি। একতরফা গালমন্দের তোড়ে মন্দের সঙ্গে কিছু ভালোও ভেসে গেছে।

এটা বোঝা এখন জরুরি যে, পুঁজিবাদ একই জায়গায় বসে নেই। বিকাশের বিচিত্র সর্পিল গতিপথে সে এগিয়ে চলেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় সে ভুগছে জন্ম থেকেই। জন্ম কারো জন্যই বা মৃত্যুর সমন নয়? জন্ম থেকেই মৃত্যু যন্ত্রণার আজন্ম পাপ নিয়ে পুঁজিবাদ কিন্তু শুধু কোনো মতে বেঁচেই নেই, শক্তি-সামর্থ্যওে বিকশিত হয়ে উঠেছে। মার্কস-এঙ্গেলস যে রকম বলেছেন মূলে সে রকম থেকেও ব্যবস্থাটির চেহারা-সুরতে অনেক বদল হয়েছে। অনেক জায়গায়ই পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে আপস করেছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু মানবিক দিক আত্মস্থ করে। চীনে তো কমিউনিস্টরাই পুঁজিবাদকে আত্মস্থ করে বসে আছে। ফলে চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি আর কোনো ব্যতিক্রমী সমাজতান্ত্রিক রূপ হয়ে নেই, হয়েছে এক ব্যতিক্রমী পুঁজিবাদী রূপ। চীনাদের কাছে নামে কিছু আসে যায় না, দেং জিয়াও পিংয়ের পরামর্শ তারা অক্ষরে অক্ষরে মান্য করেছে। বিড়াল সাদা না কালো তাতে কী আসে যায়, আসল ব্যাপার সে ইঁদুর ধরতে পারে কিনা।

দেংয়ের উপদেশ আমরাও বিবেচনায় নিতে পারি। আমরা হয় সাদা না হয় কালো বিড়ালের পক্ষে যুদ্ধশিবিরে বিভক্ত। বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারছে কিনা, অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ করছে কিনা- এই বিবেচনাকে প্রাধান্য দিলে আমাদের শক্তির অপচয় কম হতো। পুঁজিবাদের বিরোধিতা করেও তার সবটুকু সুফল নিংড়ে নেয়ার প্রয়োজন আছে। পুঁজিবাদ বর্তমানে এক বিরাট সংকটের পর্যায় পার হচ্ছে। তারপরও অস্বীকারের উপায় নেই যে, বিশ্ব দারিদ্র্য হ্রাস করায় এই ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা আছে। দেখা যাবে, সব দেশ একইভাবে পুঁজিবাদকে কাজে লাগায়নি বা পারেনি। পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যেও কেউ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, আবার কেউ দালাল আছে। যারা সঠিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পেরেছে, তারা এগিয়েছে; আর যারা কেবল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বি-টিম হিসেবে খেলতে চেয়েছে, তারা অনেকেই ফতুর হয়েছে।

মার্কস-এঙ্গেলস পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেভাবে গরিবের আরো গরিব হওয়া ও শ্রমিকের সর্বহারায় পরিণত হওয়া নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ঘটনা অতটা সরল পথে আগায়নি। তবে দেশের অভ্যন্তরে ও ভিন্ন ভিন্ন দেশের মাঝে আয়-বৈষম্য বেড়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংকটের নিয়মিত পুনরাবৃত্তিও একইভাবে না হলেও ঘটছে। অনেক মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনলেও, ক্ষুধা, গৃহহীনতা, রোগবালাই, দারিদ্র্য এখনো তার নিত্যসঙ্গী। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সন্ত্রাস, ধর্মীয় উগ্রতা, জাতিবিদ্বেষ, দেশত্যাগ ইত্যাদি সমস্যা।

এই অপরিহার্য পুঁজিবাদী সংকটের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের ঝড় উঠেছিল ইউরোপের ঘরে। ‘পুঁজিবাদের সমাপ্তি শুরু হয়েছে’ শীর্ষক লেখায় পল মেসন লিখেছিলেন (দি গার্ডিয়ান, ১৭ জুলাই ২০১৫), ‘গ্রিক সংকটকালে সিরিজার হাতে লাল পতাকা ও কণ্ঠে মিছিলের গান আর সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর জাতীয়করণের সম্ভাবনা বিংশ শতাব্দীর স্বপ্নকে সাময়িকভাবে পুনর্জাগ্রত করেছিল- ওপর থেকে জোরপূর্বক বাজারের ধ্বংস সাধন। বিংশ শতাব্দীতে দীর্ঘকালব্যাপী এটাই ছিল পুঁজিবাদ-পরবর্তী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে বাম ধারণা।’

বাজারের কাছে ভাগ্য সঁপে দেয়ার বিরুদ্ধে গ্রিসে আশার আলো দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে বামপন্থী সিরিজা সরকার বিশ্ব পুঁজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে সে আশার শিখায় পানি ঢেলে দেয়। এতে করে স্পেনে বামপন্থী পরিবর্তনের সম্ভাবনা নষ্ট হয় ও অনেক দেশে পুঁজিবাদ-বিরোধী আন্দোলন মিইয়ে পড়ে। আশার আলো এখন কোথাও দেখা যাচ্ছে না- না পুঁজিবাদী শিবিরে, না সমাজতান্ত্রিক শিবিরে। তবে চীনা কমিউনিস্ট উদ্ভাবিত রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ এখন বিশ্ব-নেতৃত্ব হাতে নিয়ে নেয়ার পথে। কমিউনিস্ট চীনই যেন এখন পুঁজিবাদের অন্যতম ভরসা।

পুঁজিবাদ দ্বন্দ্বে ভরপুর- একটা-দুটো বা এমনকি শত নয়, সহস্র দ্বন্দ্ব। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যেন বৈচিত্র্যের শেষ নেই। এর রূপ এক নয়, বহু। যে মুনাফা অর্জন এই ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে, তাকেও সব সময় প্রাধান্য দেয়া হয়নি। আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম গুরু জন মেনার্ড কেইনস লিখেছিলেন, ‘ব্যবসায়ীকে মুনাফাখোরে পরিণত করা হচ্ছে পুঁজিবাদকে আহত করা, কেননা অসম পুরস্কার প্রাপ্তিকে স্থায়ীকরণের মাধ্যমে এটি সমাজে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে। ব্যবসায়ীকে সহ্য করা যায় ততক্ষণ যতক্ষণ তার লাভকে মোটামুটিভাবে ও কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত করা যায় তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যা সমাজের ক্ষেত্রে কোনো অবদান রেখেছে।’

পুঁজিবাদ সম্পর্কে এই কেইনসীয় দুশ্চিন্তায় একটি নৈতিক চেতনা বিদ্যমান। তিনি জানতেন, লাগামহীন মুনাফা অর্জনের নেশা পুঁজিবাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। লুণ্ঠনবৃত্তিক পুঁজিবাদের জঙ্গলে পরবর্তীতে বেড়ে ওঠা ‘নৈতিক পুঁজিবাদ’ নামের একটি ধারার বীজ এখানে নিহিত। উইলিয়াম গ্রেইডার তার ‘পুঁজিবাদের আত্মা’ বইতে ব্যবস্থাটির বিচিত্র রূপের আলোচনা করেছেন। আছে প্রাকৃতিক পুঁজিবাদ যা মানবসভ্যতার ভিত্তি হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দেয়, যে প্রাকৃতিক সম্পদের কোনো গুরুত্ব প্রচলিত পুঁজিবাদে নেই। আছে শ্রমিক-নিয়ন্ত্রিত কারখানা ব্যবস্থাপনা। আছে সমাজতন্ত্রের নিকটবর্তী ব্যবস্থা সমবায়। কল্যাণ রাষ্ট্র বিশ্ব পুঁজিবাদে একটি সফল নিরীক্ষা, যা অনুসরণ করেছেন তারা যারা সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী উভয় ব্যবস্থার মাঝামাঝি থাকা নিরাপদ মনে করেছে।

পুঁজিবাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা একরৈখিক, অথচ বাস্তবে তা সর্পিল। আমরা জানি কেবল চৌর্য ও লুণ্ঠনবৃত্তিমূলক পুঁজিবাদের কথা। মূল চরিত্রে সব রকম পুঁজিবাদই চৌর্যবৃত্তিমূলক হলেও মাত্রায় পার্থক্য আছে। কোথাও চুরিটা রাতে ও নিয়মকানুন মেনে হয়, কোথাও তা দিনদুপুরে ও মগের মুল্লুকময়। পুঁজিবাদ সম্পর্কে আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে বিস্তৃত করার প্রয়োজন আছে। পুঁজিবাদকে তার পূর্ণাঙ্গ ও বিকাশমান রূপে দেখে যদি তার সঙ্গে বোঝাপড়া করা যায়, তাহলে আলিঙ্গন ও বিরোধিতা যাই হোক, তা যথাযথ হবে। ন্যায়ভিত্তিক কোনো সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে না পারা পর্যন্ত বিদ্যমান পুঁজিবাদের সব বিকশিত নতুন সম্ভাবনাময় দিকগুলো কাজে লাগাব না কেন?

আলমগীর খান : লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App