×

মুক্তচিন্তা

‘সীমান্তরেখা’ : জীবন ও ইতিহাসে অবগাহন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:০৯ পিএম

মানুষকে বাস্তুচ্যুত ও দেশচ্যুত করা মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর মধ্যে প্রধান বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা এর মধ্যেই থাকে সহায় সম্পদ মান মর্যাদা ও মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করে মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়। তদুপরি এক সংকীর্ণতা ও অপরাধ জন্ম দেয় আরো আরো সংকীর্ণতা ও অপরাধের। তানভীর এই সমস্যাটা সামনে এনে আমাদের জাতির মনোজগতে চর্চিত না হওয়া একটি পর্বতপ্রমাণ সমস্যাকে সমাজচিন্তক ও রাজনীতিকদের সামনে উত্থাপন করেছেন।

চেতনায় প্রত্যাশা

অনুজপ্রতিম সাথী তানভীর মোকাম্মেল রচিত ও পরিচালিত ‘সীমান্তরেখা’ প্রামাণ্য-চিত্রের প্রিমিয়ার শো গত ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় জাতীয় গ্রন্থাগারে গভীর মনোযোগ ও ভালোলাগার সঙ্গে দেখলাম। দেশ ও দশের আর সেইসঙ্গে আমার ও পরিবারের ভাগ্য দুই বাংলার মধ্যে সীমান্তরেখাটি আমার জন্মের প্রায় শুরু থেকেই নির্ধারণ করেছে। তাই ওই রেখাটি নিয়ে তানভীর চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে, এই কথাটি যখন প্রথম ওর মুখ থেকে শুনেছি, তখন হিমশীতল একটি প্রবাহ শরীর ও মনের ভেতর দিয়েই কেবল প্রবাহিত হয়নি; একটা প্রশান্তিও অনুভব করেছি। এর কারণ হচ্ছে এই সীমান্তরেখা বাঙালির সামষ্টিক পারিবারিক ও ব্যক্তির রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক জীবনকে সত্তর বছর যাবৎ গভীরভাবে প্রভাবিত করে রেখেছে এবং আরো কতকাল রাখবে তা ভাবা না গেলেও তা নিয়ে বাংলাদেশে খুব কমই বুদ্ধি ও চিন্তাভিত্তিক কাজ হয়েছে। প্রসঙ্গত বলি, তানভীর পরিচালিত ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’সহ ওর কয়েকটি চলচ্চিত্র যখন দেখি, তখনই মনে হয়েছে, তানভীর এ বিষয়ে ভাবছে। কিন্তু এই ভাবনার পরিণতিতে যে এমন একটি গবেষণানির্ভর মানবিক হৃদয়স্পর্শী ও তৃপ্তিদায়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হবে তা ভাবিনি। প্রামাণ্যচিত্রটি দেখে এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে মনে গভীর প্রশান্তি নিয়ে ভেবেছি, এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করার ভেতর দিয়ে ইতিহাসের দায় মোচনের ক্ষেত্রে তানভীর সত্যিকার অর্থেই একটা মাইলফলক রচনা করল।

প্রামাণ্যচিত্রে এই প্রশ্নটি সামনে আনা হয়েছে যে, আমাদের দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এই সীমান্তরেখার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে শিল্প-সাহিত্য সিনেমায় অনেক বেশি কাজ হয়েছে। মহান চিত্র পরিচালক ঢাকার জিন্দাবাজের ছেলে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ডাকা তারা’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির উল্লেখ করে এবং প্রয়াত পরিচালকের স্ত্রী সুরমা ঘটকের সাক্ষাৎকার যুক্ত করে তানভীর আসলেই প্রামাণ্যচিত্রটিকে অন্য উচ্চমাত্রায় তুলে নিয়ে গেছে। প্রসঙ্গত বলি প্রখ্যাত সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘হেডমাস্টার’ উপন্যাসটি পড়ে অগ্রগামী পরিচালিত ওই নামের ছবিটি যতটুকু মনে পড়ে পঞ্চাশের দশকের শেষ বর্ষে কলকাতায় গিয়ে দেখেছিলাম। পূর্ববঙ্গের গ্রামের স্কুলের হতভাগ্য এক হেডমাস্টার সপরিবারে সীমান্তরেখা অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে কতটা অসহায় হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছিলেন, তারই জীবনালেখ্য ওই সিনেমায় মহান অভিনেতা ছবি বিশ্বাস ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তখন বয়স আর কত! ১৩ হবে। সিনেমা হলে ছবিটি দেখতে দেখতে এতটাই কেঁদেছিলাম যে, তা ভাবলে এখনো নস্টালজিয়ায় চোখে বাষ্প জমে।

আসলে তখনকার মতো প্রাণখুলে কাঁদতেও পারি না! এতটা কেঁদেছিলাম কেন? আজ যখন এটা ভাবি তখন মনে হয়, আত্মীয়-স্বজন যারা সীমান্তের অপর পাড়ে তখন চলে গিয়েছিল, তাদের সবার জীবন ও জীবিকার করুণ অবস্থা মনে করেই এতটা কেঁদেছিলাম। আমার বড়দি মঞ্জু দত্ত ও অকাল প্রয়াত অবিবাহিত বড়ভাই শংকর দত্তকে (ভিলাই স্টিল প্লান্টের ইঞ্জিনিয়ার, সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন) সীমান্তরেখা টানার পর পরই দাঙ্গার ভয়াবহতা বিবেচনায় প্রথমে হবিগঞ্জ থেকে আসামের শিলচর পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তখন কমবেশি বড়দির বয়স ৯ বছর ও বড়দার বয়স ৫ বছর হবে। সীমান্তরেখা এ ধরনের বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছিল। পরে দাদা স্কুল থাকা অবস্থায়ই কলকাতায় মামাবাড়িতে উঠতে বাধ্য হয়। ঢাকার তাঁতিবাজারের বড় বড় বাড়ি ও ব্যবসা ছেড়ে পরিবারটির বড় অংশ ছোট তিনটা রুমে তখন থাকত। দাদা ওই বাসায় একটা রুমের খাটের অপ্রশস্ত পাশে, যেখানে আলো প্রবেশ করে কম, সেখানে মেঝেতে বসে পড়তেন। ঘুমানোর জায়গা ছিল না সুনির্দিষ্ট। অথচ হবিগঞ্জে ছিল আমার পড়ার বড় টেবিল। ছিল আরাম-আয়েশের ঘুমানোর জায়গা।

তাই প্রচণ্ড কষ্ট পেতাম। কিন্তু এত কষ্ট সত্তে¡ও তারা ছিলেন নিশ্চিন্ত, যেন পাকিস্তান থেকে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে গেছেন। আরো তৃপ্ত এই জন্য যে, তাদের তো আর রেললাইনের ধারে বস্তি, বনবাদাড় ও জলকাদায় ভরা কলোনি ইত্যাদিতে উঠতে বা কর্মহীনভাবে থাকতে হয়নি! এতদসত্তে¡ও ছেলের অবস্থা দেখে মা কখনোবা বিচ্ছিন্নতার বেদনায় নীরবে কাঁদতেন। পরে বিচ্ছিন্নতার কারণেই অকালে মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করতেন। তবে হেডমাস্টার ছবিটি দেখে আমার এত বেশি কান্নার আরো একটা বড় কারণ ছিল ব্যক্তি আমিকে জড়িয়ে। যদি আমারও ভারতে গিয়ে ওই অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়, তখন কী হবে! পড়াশোনা যদি লাটে ওঠে! কিন্তু সেই অবস্থায় পড়তে হয়নি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যখন রাজনীতি তথা দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার মধ্যে জড়িয়ে পড়ি, তখন আর কাঁদিনি। প্রতিজ্ঞা মানুষের মনকে নরম করতে দেয় না। এ দেশকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমিÑ এই স্বপ্নমাখা প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে তখন থেকেই শিখেছিলাম। কিন্তু দুই দেশের বর্তমান সাম্প্রদায়িক ভেদরেখার এক অভাবিত অনভিপ্রেত কঠিন বাস্তবতার মধ্যে আসলে তানভীর আমাকে কাঁদিয়ে দিয়েছে। হল থেকে সজল নয়নে বের হয়ে আসতে আসতে তাই মনে হয়েছে সেই ‘হেডমাস্টার’ ছবি দেখার সময় কান্নার কথা।

প্রসঙ্গত বলি যতটুকু মনে হয় ১৯৬০ সাল তথা সুদীর্ঘ প্রায় ৫৫ বছর পর আমার বড়দি ঢাকা এসেছিলেন। তার কাছে শুনেছি, আমার জন্য মায়ের যখন গর্ভযাতনা শুরু হয়, তখন বিকেলে বড়দি বাসার উঠানে খেলছিলেন। মা তখন বাসার একটু দূর থেকে দাইমাকে ডাকতে দিদিকে পাঠাবেন কিনা তা নিয়ে দোটানায় ছিলেন। কারণ তখন পরাধীন ভারতের ছোট্ট মহকুমা শহর হবিগঞ্জে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি স্লোগান দিয়ে মুসলিম লীগের মিছিল হচ্ছিল। ওই তারিখটা ছিল ১৯৪৬ সালের ১৪ এপ্রিল, বাংলা সংক্রান্তির দিন। ধারণা করি ওই মিছিল ছিল আগস্ট মাসের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ সামনে রেখে। এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি, ‘শিশু পাকিস্তান’ বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি শিশুও বেড়ে উঠেছি। বুঝ হওয়ার পর থেকে তাই বর্ডার শব্দটি অহরহ শুনে এসেছি।

বর্ডার বিষয়টা ছিল ছেলেবেলায় আমাদের জন্য এক রহস্যের বিষয়। আমাদের বাসায় বিনয়দা নামে রান্নার একজন বাবুর্চি ছিলেন। তাদের গ্রামে থাকার ঘর পড়েছিল পাকিস্তানে আর রান্নাঘর ও পায়খানা পড়েছিল হিন্দুস্থানে। মা-বাবা ঘুমায় এক দেশে আর ছেলে মেয়ে ঘুমায় অন্য দেশে এই ধরনের বর্ডারও আছে বলে তখন শুনেছিলাম। আর ভেবেছিলাম, ভাগ্য আমার ভালো বর্ডার মা-বাবা থেকে আমাকে পৃথক করেনি। সব মিলিয়ে তাই বর্ডার দেখার প্রচণ্ড একটা আগ্রহ আমাদের ভাইবোনের ছিল। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বছরে একবার কলকাতা যাওয়ার পথে দর্শনা থেকে ট্রেনটা ছাড়ার সময় বর্ডার দেখার জন্য আমরা পাগল হয়ে যেতাম। প্লেনে যখন যেতাম তখন জানলা দিয়ে তাকিয়ে সেই রহস্যময় বর্ডার খুঁজতাম। কিন্তু পেতাম না। দেশে দেশে মানুষ্যসৃষ্ট বর্ডার যা আছে, তার মধ্যে রেডলিফ সাহেব অঙ্কিত আমাদের বর্ডার বিস্ময়করগুলোর অন্যতম। আগে ছিল পিলার আর এখন হয়েছে কাঁটাতার! ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন ভারত বিভক্তি চ‚ড়ান্ত করে তখন এমন এক ইংরেজ খুঁজছিলেন, যার ভারত সম্পর্কে কিছু জানা নেই এবং পরিচিত কেউ সেখানে নেই। এই বর্ডার বিস্ময়কর হবে না তো কী হবে! তানভীরের ‘সীমান্তরেখা’ যখন শুরু হয়েছে, তখন ছোটবেলার সেই বর্ডার, যাতে থাকার ঘর ও পায়খানা পড়েছে দুই দেশে, তা দেখার জন্য ঔৎসুক্যের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু রেডলিফ সাহেবের কাণ্ডকারখানা বা নদীর মধ্যে বর্ডার বা কাঁটাতারের বেড়া সেখানে দেখালেও উল্লিখিত বাড়ি ভাগ হওয়ার চিত্রটা খুঁজে পাইনি। ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের ক্যানভাসে কত আর দেখাবে তানভীর!

যা দেখিয়েছে তার সবটা জানতাম না। কতটা গবেষণার চোখ নিয়ে অনুসন্ধান ও পরিশ্রম করে, কত জায়গায় গিয়ে আর কতটা মানবিক মন নিয়ে যে তানভীর এই প্রামাণ্যচিত্রটা নির্মাণ করেছে, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। প্রসঙ্গত বলি, কিছুদিন আগে আমেরিকা গিয়েছিলাম। আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আভা ও আমি বৈকালিক ভ্রমণ করছি। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। নির্জনতার ভয়ে যেন গা ছমছম করছিল। অপ্রশস্ত দুই রাস্তার একটা ক্রসিং পার হচ্ছি, এমন সময় পেছন থেকে সামনে এসে এক যুবক হিন্দি-বাংলায় আমাদের প্রশ্ন করল, আপনারা বাংলাদেশের? ভাষা শুনে বুঝে নিয়েছে আমরা বাংলাদেশি। ১৯৬৫-এর দাঙ্গার পর ওদের পরিবারটি সর্বহারা হয়ে চলে যায় পশ্চিমবঙ্গে, তারপর দণ্ডকারণ্যে। ওর জন্ম হয়েছে এবং বড় হয়েছে সেখানে। এখানে এমএস করছে। তবে ওই যে শিকড়ের টান! আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আলো অন্ধাকারে ছেলেটির চোখে যেন জল দেখেছিলাম। তানভীর ওই প্রামাণ্যচিত্রে দণ্ডকারণ্যে পূর্ববাংলার লোকদের দেখাতে গিয়ে ছেলেটির বাড়িও যেন আমাদের দেখিয়ে দিল। কেবল কি তাই! ভারতের যে যে জায়গায় পূর্ববাংলা থেকে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বলি উদ্বাস্তুরা গিয়েছেন, সব জায়গার খণ্ডচিত্র তানভীর দেখিয়ে ও জানিয়ে আমাদের জাতিকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছে।

তানভীরের প্রামাণ্যচিত্রের শক্তির দিকের প্রথমটি হচ্ছে, কেন এত বিরাটসংখ্যক মানুষ দেশত্যাগ করল তা তুলে ধরা। আমি আমার আত্মীয়-পরিজনের দেশত্যাগের সঙ্গে প্রামাণ্যচিত্রটি মিলিয়ে দেখছিলাম। ছেলেবেলায় ঘুড়ি ওড়াতে, ডাঙগুলি খেলতে, সাঁতার কাটতে বা কোনো কাজে যখন বাসার বাইরে যেতাম, তখন মুসলিম লীগ সমর্থক বয়স্করা ‘হিন্দুস্থান’ শব্দটি সামনে এনে আমাদের ব্যঙ্গ করতেন। তবে রাজনীতিবহিভর্‚ত অংশের ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার। প্রথম অংশটি আমাদের বলত, পাকিস্তান হচ্ছে পাক অর্থাৎ পবিত্র ভ‚মি আর হিন্দুস্থান হিন্দুদের, তাই নাপাক। কবে যাব আমরা পাকভ‚মি ছেড়ে সেই নাপাক ভ‚মিতে সেটাই ছিল তাদের প্রশ্ন! এমন প্রশ্ন ছিল স্বাভাবিক। কারণ হিন্দুরাও বিভেদরেখার কারণে মনে করত হিন্দুস্থান হচ্ছে আমাদের এবং হঠাৎ করেই শহরের হিন্দু পরিবারগুলো হিন্দুস্থানে চলে যাচ্ছিল। দাঙ্গার ভয়ের সঙ্গে সবচেয়ে বড় ভয় ছিল ঘরের মহিলাদের সম্ভ্রম। আমার বোনরা বড় হচ্ছিল আর অসাম্প্রদায়িক মনোভাপন্ন মা-বাবাকে ভারতে প্রবাসী হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিল। আমার বাবা গান ও খেলা ভালোবাসতেন। ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, তবে রাজনীতি করতেন না। ব্যবসায়ী হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসকে সাহায্য করতেন। আমার মেঝ দিদি পুষ্প দত্তকে গান শেখাতে না পেরে কষ্টে ছিলেন। তাই তিন নম্বর বোন বাণীকে (বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত, সাবেক ছাত্রনেত্রী) গান শেখানোর জন্য বাসায় ওস্তাদ রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু রেওয়াজের সময় বাসায় ইট পড়ত। তখন থেকে মা চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তানভীরের ছবিটি যখন দেখছিলাম, তখন উল্লিখিত সব স্মৃতির সঙ্গে ছবিটি মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিলাম।

প্রামাণ্যচিত্রটির আরো একটি শক্তির দিক হচ্ছে, এতে প্রমাণ দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, যারা ভারত থেকে পাকিস্তানে এসেছেন, তাদের চাইতে যারা ভারতে গিয়েছেন, তারা বহুগুণে বিভীষিকা অসহায়ত্ব ও দুঃখকষ্টের মধ্যে পড়েছেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর এখনো নানাবিধ কারণে সংখ্যালঘুরা অনবরত যাচ্ছে ভারতে। পূর্ববাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা যে এক দুর্ভাগ্যপীড়িত জনগোষ্ঠী, তা তানভীর অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছে। সমাধান কী? এটা কি সমাধানযোগ্য? প্রশ্নগুলো তানভীর সাহসের সঙ্গে জাতির সামনে উত্থাপন করেছে। তানভীর আসলে বাস্তবের সীমান্তরেখা দেখাতে গিয়ে চলে গেছে দুই সম্প্রদায়ের মনোগত বিভেদ ও পার্থক্যের সীমারেখা অনুসন্ধানে। মানুষকে বাস্তুচ্যুত ও দেশচ্যুত করা মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর মধ্যে প্রধান বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা এর মধ্যেই থাকে সহায় সম্পদ মান মর্যাদা ও মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করে মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়। তদুপরি এক সংকীর্ণতা ও অপরাধ জন্ম দেয় আরো আরো সংকীর্ণতা ও অপরাধের। তানভীর এই সমস্যাটা সামনে এনে আমাদের জাতির মনোজগতে চর্চিত না হওয়া একটি পর্বতপ্রমাণ সমস্যাকে সমাজচিন্তক ও রাজনীতিকদের সামনে উত্থাপন করেছেন। যদি তাতে জাতির মেধা ও মনন আর সেইসঙ্গে রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের টনক নড়ে, তবেই তানভীরের পরিশ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন হবে।

প্রকৃত বিচারে মনোগত যে দেয়াল, যে দেয়াল রক্তাক্ত সীমান্তরেখার জন্ম দিয়েছে, তা হঠাৎ করে ১৯৪৭ সালেই তৈরি হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি প্রথম থেকে প্রয়োগ করার কারণেই কেবল মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত¡ ও জাতীয় কংগ্রেসের সীমাবদ্ধতার জন্ম দিয়েছে এমনটাও মনে করার কোনো কারণ নেই। তানভীর তা প্রমাণ করতেও যায়নি। মনোগত দেয়াল তৈরি হওয়ার দিকটা ছবিতে নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। তবে প্রশ্ন হলো এই দেয়াল তৈরির উৎস সন্ধান করার কি প্রয়োজন আছে? এই প্রশ্ন সামনে রেখে বলতে হয়, বাংলা ভেঙে দ্বিখণ্ডিত  হওয়া আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমরা আর বাংলাদেশে হিন্দুরা যখন সংখ্যালঘু হয়ে আছে এবং সমস্যার মানবিক সমাধান হচ্ছে না, তখন তা সমাধানের জন্য এই দেয়াল সৃষ্টির উৎস নিয়ে বুদ্ধিভিত্তিক গবেষণা ও আলোচনার প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়। রাজনৈতিক ও মানবিক সমস্যা যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎস অনুসন্ধান আসলেই প্রয়োজনীয় বিষয়।

[বাকি অংশ পড়ুন আগামীকাল]

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App