×

মুক্তচিন্তা

বাসযোগ্য নগর : সমস্যা ও করণীয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ০৬:৫৬ পিএম

ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান করতে হলে দুটি বিষয়কে সামনে রেখে বিকল্প তৈরি করতে হবে। নিরাপত্তা এবং সামাজিক সম্মান অক্ষুণ্ন রেখে একটি বিকল্প ও গ্রহণযোগ্য গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রবর্তন দরকার। দক্ষিণ আমেরিকার একটি অপরাধপ্রবণ ও শ্রেণিবিভক্ত শহর হচ্ছে বোগোটা। নব্বই দশকের শেষ দিকে তার নগর পরিবেশের আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে ‘ট্রান্সমিলেনিও’ নামে একটি শহরব্যাপী টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে।

প্রথমে যদি প্রশ্ন করা হয়, শহর বলতে আমরা কী বুঝি? এর সহজ উত্তর হতে পারে অনেক মানুষ শহর বলতে বুঝে থাকেন উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আকাশছোঁয়া দালানকোঠা, পিচঢালা রাস্তা, কর্মক্ষেত্র, চিকিৎসার সুব্যবস্থা, শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত, সহজ যাতায়াত, নাট্যকলা ইত্যাদির সহজ প্রাপ্তি এবং বিকাশের ক্ষেত্র। সহজ কথায় আধুনিক জীবনযাপনের সব উপাদান সমৃদ্ধ একটি আদর্শ স্থান যেখানে নাগরিকরা তাদের চাহিদা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটাতে পারবে। একটি আদর্শ শহর হওয়া উচিত- মনোরম, উৎসবমুখর, প্রাণবন্ত। তাই বলা যায়, উন্নত জীবনযাপন এবং সামাজিক সুবিধার আকর্ষণেই মানুষ আজ নগরমুখী।

কিন্তু ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের নানান রং ও ঢঙের কষ্টের মধ্যে পড়তে হয় প্রতিনিয়ত। যানজট, ময়লা-আবর্জনা, জলাবদ্ধতা, বৃষ্টি হলেই স্যুয়ারেজ পানির লাইন একাকার, চলাচলে অযোগ্য খানাখন্দ রাস্তা, মশার কামড়, সুপেয় খাবার পানির অভাব, অপর্যাপ্ত গণপরিবহন, ফুটপাতে যত্রতত্র দোকান বসিয়ে পথ রোধ করা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-ব্যবহারিক পানি নিরবচ্ছিন্ন না থাকা, কলকারখানার কালো ধোঁয়ায় বায়ুদূষণ, উন্নয়নের নামে প্রতি বছর ফুটপাত ভাঙা, রাস্তার মাঝখানে যেখানে সেখানে গর্তের কষ্টসহ বিভিন্ন রকমের কষ্ট হলো ঢাকায় বসবাসরত নগরবাসীর নিত্য সঙ্গী। সমস্যার ভারে জর্জরিত ঢাকা শহরের একটি সহনীয় এবং বাস্তবসম্মত ভবিষ্যৎ চিন্তা করা কি সম্ভব?

মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক জরিপে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা শহরের মধ্যে দ্বিতীয় বলা হয়েছে ঢাকাকে। বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা ক্রমেই বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। শহরের পরিবেশ মানুষের জীবনযাত্রাকে এমনভাবে ব্যাহত করছে যার ফলে এই শহরের বাসিন্দাদের মাঝে আর প্রাণের উচ্ছ¡াস খুঁজে পাওয়া যায় না। যে কারণে শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেটি আর এই শহরে খুঁজে পাওয়া যায় না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ন’। নগরবাসীর প্রথমে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা হলো যাতায়াত সমস্যা। এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এই সমস্যার জন্য বিরক্ত নয়! আমরা প্রতিদিনের কর্মঘণ্টা হতে একটা বড় অংশ ব্যয় করি ঢাকার রাজপথে। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টাগুলো নষ্ট করার জন্য রাস্তা যেন ওতপেতে রয়েছে। মাঝে মাঝে অবস্থা এমন প্রকট আকার ধারণ করে যে, ৩০ মিনিট হাঁটলে যেখানে পৌঁছানো সম্ভব, সেখানে গাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। যানজটে বসে থেকে শুধু কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে তা নয়, বরং জ্বালানির অপচয় হচ্ছে সঙ্গে পরিবেশ দূষণ। এর অর্থনৈতিক মূল্য অনেক।

এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে হলে সবার আগে আমাদের যে বিষয়টি ভাবতে হবে তা হলো ‘ঢাকার যানজট’। যানজট সমস্যার সমাধানের জন্য দেখতে হবে ৩৬০ ডিগ্রিতে। ঢাকা মূলত মধ্যবিত্তের নগর। এই মধ্যবিত্তের পরিবেশ নিয়ে ভাবনাগুলো কী, তা বুঝা প্রয়োজন। মধ্যবিত্তের গতানুগতিক ধারণায় ঘর বা অফিসের বাইরে যাওয়া মানেই বিভিন্ন ধরনের বাস্তব ও কল্পিত যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করা, দুর্ঘটনা যেখানে নিত্য সঙ্গী। যার ফলে এই শ্রেণির কাছে বাইরের জগৎটা প্রায় পুরোপুরি নেতিবাচক। নেতিবাচক এতটাই যে, সেটা যতটা সম্ভব এড়ানো যায়। এর ফলে নগরবাসীর মধ্যে যেটা হয় তা হলো, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া। আর এ কারণে নগর মানব আজ এক নিঃসঙ্গ। নিজের পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। শহরে মানুষ অপরাধ এবং দুর্ঘটনার ভয়ে সংকুচিত থাকে। মানুষ যখন অন্য মানুষ বা প্রতিবেশীর সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ কম পায়, শহরের রাস্তাগুলো যখন খালি থাকে, মানুষ যখন আত্মকেন্দ্রিক হয়, একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখা যায়, তখন অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগর বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে গণপরিসরে নাগরিক চত্বর এবং রাস্তা হলো একটি বাসযোগ্য ও স্বাস্থ্যকর শহরের অন্যতম মৌলিক উপাদান। যা নগরবাসীর জন্য সামাজিকীকরণের অন্যতম উপাদান।

আর আমরা নগরবাসী বাইরে বের হওয়ার অনীহার কারণেই এক ধরনের নগরবিরোধী মানসিকতা পোষণ করি। যেহেতু আমরা এই শহরকে নিজের মনে করি না সেহেতু, শহরের মালিকানাবোধও আমাদের মধ্যে থাকে না। এর কারণে যেটা হয়, আমরা রাস্তায় যত্রতত্র থুতু ফেলি, রাস্তায় ঘরের আবর্জনা ছুড়ে ফেলি, ঘরের ময়লা জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলি, সর্বোপরি নিজের বাসার বাইরে পরিবেশের কী হচ্ছে তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করি না! এই প্রয়োজন বোধ না করার কারণে যে সমস্যা তৈরি হয় তা হলো, রাজনৈতিক সরকার যখন একপাক্ষিকভাবে গবেষণা ছাড়াই চিন্তা করে, তখন তা হয় নগর সমস্যার সামাজিক অবস্থা না বোঝারই ফসল।

ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান করতে হলে দুটি বিষয়কে সামনে রেখে বিকল্প তৈরি করতে হবে। নিরাপত্তা এবং সামাজিক সম্মান অক্ষুণœ রেখে একটি বিকল্প ও গ্রহণযোগ্য গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রবর্তন দরকার। এখানে উদাহরণ হিসেবে কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার কথা বলা যেতে পারে। দক্ষিণ আমেরিকার একটি অপরাধপ্রবণ ও শ্রেণিবিভক্ত শহর হচ্ছে বোগোটা। নব্বই দশকের শেষ দিকে তার নগর পরিবেশের আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে ‘ট্রান্সমিলেনিও’ নামে একটি শহরব্যাপী টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। লাল রঙের বাসগুলো শুধু শহরের যাতায়াত ব্যবস্থাকেই সহজেই করেনি বরং শ্রেণিবিভক্ত শহরকে একত্র করে রক্ষা করেছে সামাজিক ভারসাম্য এবং কমিয়েছে অপরাধ প্রবণতা। যে কোনো নগরবিদের দৃষ্টিতে একটি চলমান শহরের পরিচিতি নির্ভর করে তার মানসম্পন্ন ফুটপাতের ওপর। অর্থাৎ শহরে পথচারীবান্ধব চলাচল ব্যবস্থা আছে কি না তার ওপর। কারণ স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতে মানুষ হাঁটতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। হাঁটা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এর মাধ্যমে অর্থেরও সাশ্রয় হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর শতকরা ২৭.৩ ভাগ হয় ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের অসুখ ও ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক ব্যাধির কারণে। এর অন্যতম কারণ আমাদের শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া। আবার হাঁটার পরিবেশ না থাকায় আমরা হেঁটে চলাচলে উৎসাহ বোধ করি না। নিরাপত্তাও এখানে একটা অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।

মূলত ঢাকার ফুটপাত সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাণিজ্যিক চিন্তার কবলে। পথিকবান্ধব নাগরিক সংস্কৃতি তৈরি করতে হলে ফুটপাতের কোনো বিকল্প নেই। দোকান মালিকদের যদি বোঝানো যায় যে, পরিষ্কার ফুটপাত মানে আরো ক্রেতা। এ জন্য দোকানদারকেই ফুটপাতের রক্ষক হিসেবে কাজ করা উচিত। লাইসেন্সধারী হকারদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শহরের কিছু স্থানে স্বল্পমূল্যের বাজার তৈরির মাধ্যমে পুনর্বাসিত করা সম্ভব। অবমুক্ত ফুটপাত শুধু হাঁটার সংস্কৃতিকেই উৎসাহিত করবে না, একটি নগরে সবুজ অর্থনীতি তৈরিতেও সাহায্য করবে। কারণ, কম গাড়ি মানে কার্বনমুক্ত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া।

নব্বই দশকের শেষ দিকে বোগোটার মেয়র এনরিকে পেনিয়ালোসা তার শহরের রাস্তাগুলোকে রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক মাফিয়া এবং তাদের পরিবহন ব্যবসার দখল থেকে অবমুক্ত করে গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং একটি গণচত্বর নীতিমালার আওতায় এনেছিলেন। এ কারণে রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা তাকে মেয়রের অফিস থেকে বহিষ্কারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু পেনিয়াসোলার গণমুখী নগরনীতি শুধু তাকে রাজনৈতিকভাবেই টিকিয়ে রাখেনি, তাকে করেছে বোগোটার ইতিহাসের অন্যতম সফল মেয়র।

ঢাকায় সমস্যা অনেক। কিন্তু পৃথিবীর অনেক শহরের (মেক্সিকো সিটি, বোগাটা, ব্যাংকক, ব্রাজিলের কুরিতিবা) উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ঢাকাকেও গতিশীল ও বাসযোগ্য একটি পরিবেশবান্ধব আদর্শ শহরে পরিণত করা সম্ভব। যেখানে সব উপাদান থাকবে পরিকল্পিত ও প্রয়োজন অনুসারে। বাসস্থানের পাশাপশি প্রচুর গাছপালা থাকবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকবে সুরক্ষিত, শিশুরা পাবে নিরাপদে খেলাধুলার পরিবেশ, সব বয়সী মানুষের জন্য থাকবে সুস্থ চিত্তবিনোদনের জন্য উন্মুক্ত স্থান, গণপরিসর যা মানুষের সামাজিকীকরণের মাধ্যমে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগানের জন্য শুধু গ্রামনির্ভর না থেকে বাসস্থানের কাছাকাছি কিংবা আধুনিক চিন্তা যেমন ছাদ বাগানের মাধ্যমে খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। এক কথায়, যে নগরে মানুষ গতানুগতিক যান্ত্রিকতা এড়িয়ে আন্তরিকতাপূর্ণ সুন্দর জীবন উপভোগ করতে পারবে। যে নগর বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য ‘আদর্শ নগর’ হয়ে থাকবে। নগর তত্ত¡াবধায়কদের এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল এবং সুবিবেচনার প্রমাণ রাখতে হবে।

সামিউল হাসান সজীব : উন্নয়ন গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App