×

মুক্তচিন্তা

সুবিধাবাদীদের বিশ্বায়ন বিরোধিতা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০১৭, ০৬:২৫ পিএম

বিশ্বায়ন নিয়ে কথাবার্তা বেশিদিনের পুরনো নয়, কিন্তু বিশ্বায়ন নিজে অনেক পুরনো। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই বিশ্বায়নও চলছে। তখন ব্যাপারটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না, তাই আলোচনারও দরকার হয়নি। আজ কথায় কথায় বিশ্বায়ন। কারণ ত্বরিত গতিতে ঘটছে এটি। প্রভাবিত করছে ব্যাপক মানুষের জীবনকে। জন্ম দিচ্ছে আনন্দ ও হতাশার। বিশ্বায়ন নিয়ে তাই মানুষ সচেতন। কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে আর কেউ দোদুল্যমান। তবে ক’দিন আগেও বিশ্বায়নের দলে লোক ছিল বেশি। মার্কিন সাংবাদিক জর্জ প্যাকার বলেছিলেন, ‘বিশ্বায়নকে প্রত্যাখ্যান করা আর সূর্যোদয়কে প্রত্যাখ্যান করা একই।’ (বিশ্বায়ন : বিশ্ব কাঁপানো ধারণার উত্থান-পতন, নিকিল সাভলা, দি গার্ডিয়ান, ১৪ জুলাই ২০১৭)।

কিন্তু হাওয়া বদলে যাচ্ছে। এখন বিশ্বায়ন বিরোধীদের গলা চড়া। বিশ্বায়ন শিবির থেকে লোক দলে দলে বিশ্বায়ন বিরোধী শিবিরে যোগ দিচ্ছে। এর কারণ এই নয় যে, বিশ্বায়নের দিন শেষ। বরং উল্টো, যারা বিশ্বায়ন শিবির থেকে বিরোধী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে, তারা আতঙ্কিত যে, বিশ্বায়ন ঠেকানো যাচ্ছে না। এ আতঙ্ক ভিত্তিহীন নয়। শেষ চেষ্টা করছে তারা। এদের দল পরিবর্তনের কারণ, বিশ্বায়ন থেকে কেবল নিজের লাভের হিসাবটাই তারা করেছিল; এখন দেখছে ক্ষতিও কম নয়।

বিশ্বায়নে লাভ-ক্ষতি দুই-ই আছে, সবার জন্য। এর ফলে একদিকে যেমন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বহু দরিদ্র মানুষের জীবনমানে উন্নতি হয়েছে, অন্যদিকে অনেক সুবিধাভোগী নতুন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠেছে, সত্যি। আবার ‘বিশ্বায়নের ফলে বলতে গেলে সর্বত্র দেশের ভেতর আয়বৈষম্য বেড়েছে। আর বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত ৫০ বছরে উত্তর বিশ্বে ও দক্ষিণ বিশ্বে মাথাপিছু আয়ের পার্থক্য বেড়ে হয়েছে তিন গুণ।’ (বিশ্ব বৈষম্য-যন্ত্র কীভাবে থামাতে হবে, জ্যাসোন হিকেল, দি গার্ডিয়ান, ১৮ মে ২০১৭)।

নিকিল সালভার মতে, ‘অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়ন নিয়ে সম্মতির দেয়ালে ফাটল ধরল আর তা এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, আজ কোনো ঐকমত্যের চিহ্ন নেই। যেসব অর্থনীতিবিদ এক সময় বিশ্বায়নের ঘোর সমর্থক ছিলেন তারা এর ঘোর সমালোচকে পরিণত হয়েছেন। আগের ঘোর সমর্থকরা এখন আংশিকভাবে হলেও স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, এর ফলে বৈষম্য, বেকারত্ব ও মজুরির ওপর নিম্নমুখী চাপ তৈরি হয়েছে। এসব কানাঘুষা ও সমালোচনা যা এক সময় তাদের ড্রইংরুমে হতো, তা এখন খোলা মাঠে চলছে।’ (বিশ্বায়ন : বিশ্ব কাঁপানো ধারণার উত্থান-পতন)।

সাম্প্রতিককালে তাই বিশ্বায়ন বিরোধিতা জেগে উঠেছে। এক সময়কার গোঁড়া বিশ্বায়নবাদীরাও আজকাল বিরোধী শিবিরে যোগ দিচ্ছেন। তবে এই বিরোধীরা আবার সবাই এক পক্ষের না, পরস্পরবিরোধী পক্ষের। তাদের শ্রেণি ও শক্তিতে পার্থক্য আছে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের নারীশিশুসহ যে দরিদ্র মানুষ বিশ্বায়নের প্রেসক্রিপশনে জমিজিরাত হারিয়ে শ্রমঘন কারখানার কাজে যোগ দিয়েছে এবং শ্রমদাস হিসেবে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, তাদের বিরোধিতা নিম্নকণ্ঠ। চার বা পাঁচ বছরে একবার ভোট বা ভোটের প্রহসন ছাড়া নিজেদের মত প্রকাশের ও জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করার ভালো সুযোগ তাদের হাতে নেই। তারপরও বিশ্বায়নের ফলে ফতুর হয়ে অনেক দেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এদের বিশ্বায়ন বিরোধিতা বৈশ্বিক নয়, স্থানিক। বিশ্বায়ন-দৈত্যের বাহুতে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে তাদের বিরোধিতা করতে হয়।

কিন্তু উন্নত দেশের সুবিধাভোগী শ্রমিক যারা বিশ্বায়নের ফলে ভিনদেশের মজুরের কাছে চাকরি হারিয়েছে, তারা সহজে হারবার নয়। আবার ভিনদেশি পণ্য আমদানির ফলে উন্নত দেশের যে পুঁজিপতিদের লাভ কমেছে, তারাও দুর্বল নয়। এরা উচ্চকণ্ঠ এবং দরিদ্র দেশের মানুষের চেয়ে এদের একতাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ ও ক্ষমতা অনেক বেশি। দক্ষিণ বিশ্বে যে বিরোধিতা চিঁচিঁ আওয়াজের মতো শোনায়, উত্তর বিশ্বে তাই মহাগর্জন।

উন্নত বিশ্বের বিশ্বায়ন বিরোধীরা নানা ছুতোনাতায় এক হতে পারে। সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে তারা তাদের সব দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করে। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি পতাকা খাড়া করে তারা তার নিচে জড়ো হয়। তারা ভোটের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মিথ্যা ও পয়সা ছড়িয়ে তারা জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, বর্ণবাদী দল ও ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসায়। ক্ষমতাসীন হয়ে এরা বিদেশি মজুর খেদানো, বাণিজ্য অবরোধ তৈরি ও সীমান্তে বড় বড় দেয়াল খাড়া করার কাজে নেমে পড়ে। এক সময়কার মুক্ত বাণিজ্যের প্রবক্তারা মুক্ত বাণিজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

এই বিশ্বায়ন রাজনীতির হাতেনাতে ফল পাওয়া যায় ব্রিটেনে ও আমেরিকায় ব্রেক্সিটে ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানে। ব্রেক্সিটপন্থী থেরেসা মে বলেন, ‘আরো বিশ্বায়ন নিয়ে কথা... মানে চাকরি বিদেশে পাচার ও মজুরি কর্তন’। আর রিপাবলিকানদের জাতীয় সম্মেলনে ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের মতবাদ হবে আমেরিকানায়ন, বিশ্বায়ন নয়’। শশী থারুরের মতে, ‘আমেরিকাকে আবার বিরাট করো’ স্লোগান আসলে ‘আমেরিকাকে আবার শ্বেতাঙ্গ করো’- যে গুপ্তসংকেত বেকার, ক্ষুব্ধ, স্বদেশিবাদী, শ্বেতাঙ্গ সুবিধাভোগীদের আকর্ষণ করে ট্রাম্প সমর্থনের মূল ভিত্তি তৈরি করেছে। (বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে দুটি অভিঘাত, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অক্টোবর ১২, ২০১৭)।

বিশ্বব্যাপী বিশ্বায়ন বিরোধীদের পূর্বসূরি, অনুসারী ও উত্তরসূরি আছে। ভারতে আছেন বর্ণান্ধ হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নায়ক নরেন্দ্র মোদি, মিয়ানমারে আছেন মুসলিম নিধনের পৃষ্ঠপোষক সু কি এবং ছোট-বড় আরো অনেকে সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। এরা সবাই স্বদেশিবাদী, বর্ণবাদী, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী, পরদেশ-বিদ্বেষী, পরজাতি-বিদ্বেষী এক পরিচয়ে বিশ্বায়ন বিরোধী। আশ্চর্য হলো, গতকালও এরা সবাই ছিল বিশ্বায়নের পক্ষে বিশ্বস্ত যোদ্ধা। এরা উল্টাল কী করে?

বছর কয় আগে এদের পূর্বসূরিরাই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র নাগরিকদের কাছে বিশ্বায়নের নামে কাঠামো সমন্বয়, জনসম্পত্তিকে ব্যক্তিগত খাতে বেচা ইত্যাদি দাওয়াই দিয়েছে এবং এসব দেশের অগণতান্ত্রিক নেতাদের আলিঙ্গন করেছে। এর ফলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জীবনে এরা অশেষ দুঃখ-দুর্দশা ডেকে এনেছে। তারা লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে আফগানিস্তান ও ইরাককে আক্রমণ ও দখল করেছে। তারা চায় তাদের উৎপাদিত পণ্যের বিশ্বায়ন। তারা মানুষ চায় না, তাই চায় সীমান্তে বিরাট বিরাট দেয়াল যার ফোকর দিয়ে তাদের সৈন্যরা অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। এজন্যই তারা সুবিধা হলে বিশ্বায়নের পক্ষে, অসুবিধা হলে বিশ্বায়নের বিপক্ষে। তাদের কথা ঘড়ির কাঁটার মতো প্রতিদিন পাল্টায় না, পাল্টায় সুবিধামতো।

 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App