×

মুক্তচিন্তা

খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা, বিএনপির রাজনীতিতে ফেরা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০১৭, ০৬:১৫ পিএম

গত ১৮ অক্টোবর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ৩ মাস ৩ দিন লন্ডনে ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে অনেকটা অবকাশ কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন। বিমানবন্দরে বিএনপির নেতাকর্মীরা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। ঢাকা শহরের মানুষজন আর একবার দীর্ঘ যানজটের ধকল সহ্য করেছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের অধিবেশন শেষে দেশে ফেরা উপলক্ষে আওয়ামী লীগ সংবর্ধনার আয়োজন করে। এরও আগে জাতীয় পার্টির সভাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভারত সফর শেষে দেশে ফিরলে নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরে তাকে সংবর্ধনা প্রদান করলে ঢাকা শহর যানজটে আটকে থাকে। বিমানবন্দরে দলীয়প্রধান বা সরকারপ্রধানদের সংবর্ধনা প্রদানের বিষয়টি দলীয় নেতাকর্মীরা আন্তঃদলীয় প্রতিযোগিতার বিষয় হিসেবে নিয়েছে, কিন্তু জনগণের তাতে অবর্ণনীয় কষ্ট হয়, ক্ষতি হয়, রোগীর মৃত্যু ঘটে, বিদেশ যাত্রীদের সমস্যা হয়- এসব কিছু বোঝা সত্তে¡ও কোনো দলই ছাড় দিতে রাজি নয়। গণমাধ্যমে এ নিয়ে দলীয় নেতাদের প্রশ্ন করা হলে নেতারা অন্য দলের দিকে আঙুল তুলেন। ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতি এবং বিমানবন্দরের মতো স্থানে এ ধরনের সংবর্ধনার বিষয়টি ঠিক নয়, স্বীকার করেও বলেন, দলের নেতাকর্মীদের চাপের কাছে নাকি তারা অসহায়! এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে সবাই নিজেদের কমিটিকে জায়েজ করতে সচেষ্ট। অতীতের উদাহরণ টেনে সংবর্ধনার বিষয়টিকে এখনো তারা যার যার মতো করে সমর্থন করে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে রাজনৈতিকভাবে দলগুলোর কী লাভ হচ্ছে তারাই ভালো বোঝেন। আমি একজন নাগরিক এবং রাজনীতি সম্পর্কে কমবেশি বুঝ রাখা মানুষ সব সময়ই মনে করি সংবর্ধনাটি বিমানবন্দরে না দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা অন্য কোথাও দেয়া হলে সবকুলই রক্ষা পেত। কিন্তু আমাদের কথা শোনে কে? রাখে কে? প্রসঙ্গে ফিরে আসি। খালেদা জিয়া লন্ডনে যাওয়ার আগে বলা হয়েছিল যে, তিনি সেখানে চোখ ও পায়ের চিকিৎসা নেবেন। ফেরার পর বিএনপি থেকে বলা হলো লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষে তিনি ফিরেছেন। প্রশ্ন জাগে তিনি কি লন্ডনে তিন মাস চিকিৎসা নিয়েছেন? লন্ডনের মতো জায়গায় তিন মাস চিকিৎসা নেয়া মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। তবে লন্ডনে তাকে কোনো হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে কিনা- লন্ডনে বসবাসকারী বাংলাদেশের কোনো সাংবাদিক গণমাধ্যমে জানিয়েছেন বলে চোখে পড়েনি। তারপরও বিএনপির নেতারা লন্ডনে তাদের দলীয় প্রধানের অবস্থানকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বলে দাবি ও প্রচার করে থাকেন। কেন তারা তা করেন তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে তিনি লন্ডন যাওয়ার আগে বলা হয়েছিল দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন, সহায়ক সরকারের রূপরেখা, আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং নির্বাচন নিয়ে কৌশল নির্ধারণ করতে তিনি লন্ডন যাচ্ছেন। তখন ধারণা দেয়া হয়েছিল লন্ডনে তিনি বেশিদিন অবস্থান করবেন না, ঈদের আগেই ফিরে আসবেন এবং দলীয় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন, ঈদের পর যেন বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারে- সেই বিবেচনা করেই তিনি যথাসম্ভব দ্রুত ফিরে আসবেন। কিন্তু তিনি তিন মাস থাকলেনÑ পুত্র-পরিবারের সঙ্গে দলীয় কর্মসূচি ও কৌশল নির্ধারণে নিশ্চয়ই এত বেশিদিন কোনো সংগঠনের প্রয়োজন পড়ে না, বিএনপিরও পড়ার কথা নয়। তাহলে দেরি করার কারণ কী? কেউ কেউ মনে করেন যে, লন্ডনে থেকে খালেদা জিয়া বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, পত্রপত্রিকায় ভারতীয় বিজেপির একজন নেতার সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা দু’একটি পত্রিকা সংবাদ আকারে প্রকাশ করেছে। আর কোনো দেশের কোনো নেতার সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতার সঙ্গে খালেদা জিয়ার যদি আলাপ-আলোচনা হয়ে থাকে তাহলে তাতে বিএনপি-বিজেপির সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেয়া হলে তাতে দোষের কিছু দেখি না। তবে বিজেপির নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের অন্য কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য বা সাফল্য আমি অন্তত দেখি না।

কোনো কোনো মহল অবশ্য মনে করছেন যে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেহেতু দেশে বেশ ক’টি মামলার শুনানি শেষ পর্যায়ে, এগুলোর রায় নিয়ে তিনি বা তার দল কিছুটা সন্দিহান রয়েছেন, তাই সময় অতিবাহিত করার জন্যও লন্ডন থাকার মেয়াদ প্রলম্বিত করার কৌশল থাকতে পারে। তার বিরুদ্ধে যখন ৩টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে তাই দেশে ফেরা নিয়ে তার বিলম্ব করার সুযোগ কমে যাওয়ায় তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। অন্যান্য মহল অবশ্য মনে করছেন যে, ২০১৫ সালের আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি বেশ ভেঙে পড়েছেন, দলের অভ্যন্তরেও আগের মতো প্রাণশক্তি ফিরে না আসায় তিনি হতাশায় ভুগছিলেন, চারপাশের নেতাদের নিয়ে তার মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের সন্দেহ। ফলে একটা দীর্ঘ সময় নিয়ে লন্ডনে দুই ছেলের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একান্ত পারিবারিকভাবে কাটিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা থেকেই তার এই লন্ডন থাকা। অন্য সমস্যাগুলো প্রধান বা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না- যতটা তার পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে লন্ডনে একান্তভাবে সময় কাটানো ছিল। তাতে একাধিক উদ্দেশ্য সাধনও তার জন্য সমস্যা ছিল না, বরং সেভাবেই প্রচার দেয়া সম্ভব ছিল। কার্যত তাই করা হয়েছিল। সে কারণেই বিমানবন্দরে দল এমনভাবে পূর্বঘোষণা না দিয়ে, ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়ে বিপুল সংখ্যক কর্মী-নেতাকে উপস্থিত করে একটা শোডাউন করে ছাড়লো। বিষয়টি বিএনপি গোপন রেখেছিল। কিন্তু বিএনপির প্রস্তুতিতো পরে দেখাই গেল। বিএনপির ভয় ছিল খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই বিমানবন্দরে এভাবে শোডাউন করা। প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনার একটা বড় কারণ অস্বীকার করার উপায় নেই। এরশাদ সাহেব ভারত সফর করে এসেছেনÑ সংবর্ধনার জন্য এটি তেমন উল্লেখ করার মতো কারণ হতে পারে না। কিন্তু খালেদা জিয়াকে সংবর্ধনা দেয়ার মতো এবার কোনো কারণই মাইক্রোল্যাব থেকে বের করে দেখানো সম্ভব নয়। তারপরও সংবর্ধনা হয়েছে। তা আশা করি বুঝতে কারো বাকি থাকল না।

বিএনপির চেয়ারপারসন দেশে ফিরেছেন। বিএনপির নেতাকর্মীরা কিছুটা সতেজ হয়েছে এটি মনে হচ্ছে। দলের প্রধান দেশে তিন মাস নেইÑ এটি তাদের কিছুটা অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। যতই বলা হচ্ছিল তিনি লন্ডনে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত আছেন- এটি শিশুদের প্রবোধ দেয়ার জন্য উপযুক্ত হলেও এটা বলে দলের এত নেতাকর্মীকে বুঝ দেয়া সম্ভব নয়। তাদের মধ্যে হতাশা ছিল। এ সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে হাতে নিয়ে নিয়েছেন, তাতে বিএনপির পক্ষে তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে সমালোচনা করার তেমন কিছু থাকল না। চেয়ারপারসন থাকলে উত্তেজনা ছড়ানোর মতো কিছু একটা হয়তো করা যেতো। সেটি করা গেল না। বিএনপির নেতারা প্রতিদিন মিডিয়ার সম্মুখে কিছু গরম গরম কথা বলা ছাড়া তেমন কিছু করতে পারছেন না। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের শুরুতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা নড়েচড়ে উঠেছিলেন, ভেবেছিলেন- কিছু একটা বোধহয় করে ফেলতে তারা পারবেন। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। শেখ হাসিনা এ বিষয়ে উদারতা দেখিয়ে দেশে-বিদেশে যেভাবে সমর্থন পেয়ে গেছেন এরপর বিএনপির পক্ষে বেশিকিছু বলার সুযোগ নেই। বস্তুত রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করার মতো রাজনীতি করার সুযোগ বিএনপির হাতছাড়া হয়ে গেছে।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসার সময়ও নেত্রী দেশে ছিলেন না। কমিশন বিএনপিকে খুশি করার মতো কিছু কথা বলেছে, বিএনপি খুশি মনেই বের হয়ে এসেছে। অথচ বিএনপি এই কমিশনের বিরোধিতা করে এসেছে। সরকারের আজ্ঞাবহ বলেও গালমন্দ করেছে মনে আছে। বিএনপি নির্বাচন কমিশন ইস্যুতেও মাঠ গরম করার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি। চেষ্টা করা হয়েছিল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়েও পরিস্থিতি ঘোলাটে করার। কিন্তু সিনহা বাবুর আমলনামা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হওয়ার পর অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিএনপি তিনটি ইস্যুর কোনোটি নিয়েই দেশে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নানা প্রাথমিক সমালোচনা শেষে জনমতকে শান্ত করার মতো অবস্থান স্পষ্ট করতে পারার কারণেও বিএনপির সরকারবিরোধী কোনো উদ্যোগই সফল হচ্ছে না। শেখ হাসিনা খুবই শান্তভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সময়মতো সিদ্ধান্ত নেন বা দেন। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আদর্শ, সৎ অবস্থান এবং স্পষ্টবাদিতার যে উদাহরণ দিচ্ছেন তা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে জনগণ। ফলে প্রথম প্রথম কিছু সমালোচনা ও উত্তেজনার ভাব দেখা দিলেও দিনশেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

এমন একটি অবস্থায় খালেদা জিয়ার রাজনীতি এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি আগের মতো উত্তেজনা সৃষ্টি করে কিছু একটা করে ফেলতে পারবেন কিনা বলা মুশকিল। শেখ হাসিনার পরিপক্বতার সঙ্গে টেক্কা দিতে হলে খালেদা জিয়াকেও আগের কৌশল হয়তো বদলাতে হবে। তিনি সহায়ক সরকার, নির্বাচন ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে কী ধরনের রূপকল্প জাতিকে উপহার দেবেন, লন্ডন থেকে তিনি কী বহন করে এনেছেন- তা আগে দেখা ও শোনার অপেক্ষায় তার দলের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। দেশবাসীও অপেক্ষা করছেন। নির্বাচন কমিশনে বিএনপি যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তার মধ্যে কতটা ইস্যু নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত, কতটা সরকারের তা নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক উঠেছে। এখন সহায়ক সরকারের রূপরেখার প্রস্তাব ছাড়া বিএনপির নেতাকর্মী ও দেশবাসীর কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করার কিছু অপেক্ষায় নেই।

 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App