×

মুক্তচিন্তা

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন : কতটা প্রস্তুত আওয়ামী লীগ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:২৭ পিএম

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সব দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ শেষ হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নির্দেশনামূলক বক্তব্য, পরামর্শ, প্রত্যাশা এবং শঙ্কা আশঙ্কার কথা এই সংলাপে ব্যক্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তাদের প্রত্যাশা এবং করণীয় সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টার ফাঁকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার একটি রাজনৈতিক বিতর্ককে উসকে দিয়েছিলেন। বিএনপির সঙ্গে সংলাপকালে অতি-আবেগবশত তিনি জিয়াউর রহমানকে ‘এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা’ বলে উল্লেখ করায় শুরু হয় এই বিতর্ক। এজন্য কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টির নেতা কাদের সিদ্দিকী নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ বয়কট করেছেন বলে জানা যায়। তবে এ-ও জানা যায় যে, তিনি নাকি সিইসির সঙ্গে প্রায় দুঘণ্টা আলোচনা করেছেন। অনেকের ধারণা, কাদের সিদ্দিকীর এই ‘বয়কট’ পুনরায় আওয়ামী লীগে প্রবেশের ‘প্রোলোগ’ মাত্র। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ তাদের সংলাপকালে এ বিষয়ে ‘ব্যাখ্যা’ চাওয়া হবে বললেও পর্দার আড়ালে কী হয়েছে তা গণমাধ্যমে আসেনি। সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী এবং দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংলাপ শেষে ব্যাখ্যা ‘পেয়েছেন’ জানালেও কী ব্যাখ্যা পেয়েছেন তা আমরা জানি না। সাংবিধানিক পদে থেকে এ রকম রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান না করাই শ্রেয়। এর আগেও আমরা দেখেছি প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন স্থানে ‘পাবলিকলি’ নানা ধরনের বক্তব্য প্রদান করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো প্রধান বিচারপতিকে জনসমক্ষে এতটা প্রকট হতে আমরা দেখিনি। এসব হলো বেশি কথা বলার বা ‘অতিকথন’ প্রবণতা। বেশি বেশি কথা বলা রাজনৈতিক নেতাদের অভ্যাস তাদেরই মানায়। এটি সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে সংক্রমিত না হওয়াই ভালো। সিইসির সঙ্গে সংলাপ শেষে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য আর বেশি চর্চিত হয়নি। আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিপ্রেক্ষিতে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে সিইসির এই বক্তব্য নিয়ে চারদিকে যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে তিনি সতর্কতা অবলম্বন করবেন জাতি এটাই আশা করে। এ ধরনের বক্তব্য প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নির্বাচন কমিশনকে যেকোনো প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হোক এটা সবারই প্রত্যাশা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও চায় এ নির্বাচন সব দিক থেকে নিষ্কণ্টক হোক। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি যে ভুল করেছিল আগামী নির্বাচনে সেরূপ আর করবে না- এ রকম চাওয়া তাদের অভ্যন্তরে আছে। আর বাইরে আছে ‘সহায়ক সরকার’-এর চাপ। জোরেশোরে যত্রতত্র এই চাওয়াকে প্রতিষ্ঠা করতেই এখন তারা সোচ্চার। জনসমর্থনপুষ্ট একটি দল কীভাবে ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করল তার ঘোর এখনো অনেক নেতাকর্মীদের কাটেনি। সুতরাং বিগত প্রায় ১০ বছর ক্ষমতা বলয়ের বাইরে থেকে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি তারা নিয়ে চলেছে এতে সন্দেহ নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিরূপ প্রস্তুতি নিচ্ছে তাও একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির নিরিখে জনসমর্থন হারিয়ে কিছুটা পেছনে পড়বে সন্দেহ নেই। বলা যায় পেছনে পড়েই আছে। এই পেছনে পড়ার কারণগুলো শনাক্ত করে মাঠ পর্যায়ের চাহিদা মতো প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাধারণ বিবেচনায় ক্ষমতাসীন দল হিসেবে বিগত ১০ বছরে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ কিছুটা অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে পড়েছে। যে কারণে এসব অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নেতাকর্মীদের পদায়ন বা ক্ষমতায়ন। দেখা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ থেকে শুরু করে দলগত বিভিন্ন পর্যায়ে ‘ব্যক্তির’ দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান। আওয়ামী লীগ বড় একটি রাজনৈতিক দল। কেবল ক্ষমতার জন্য নয়Ñ ঐতিহ্যগতভাবেই দলটির মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন মানের নেতাকর্মীর সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু বর্তমান সরকার টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা করলেও আমরা দুটি মেয়াদেই মাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া একই মন্ত্রিপরিষদ দেখলাম। এর ফলে যোগ্য অন্যরা বঞ্চিত হয়েছেন। একটি দল টানা দশ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করলেও এবং যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও অনেক নেতাকর্মী ক্ষমতা বলয়ের আশপাশেই যেতে পারেননি। বিপরীতক্রমে যারা একবার ক্ষমতায় গিয়েছেন তারা একই জায়গায় আছেন বছরের পর বছর। এতে করে বিরাট এই দলটির সব পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে আশাবাদ জাগিয়ে রাখা কঠিন। মন্ত্রিপরিষদের বাইরে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠন নিয়েও প্রায় একই অভিজ্ঞতা আমাদের ভাÐারে সঞ্চিত। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর সমাগম লক্ষ করেছি। জাতীয় নির্বাচনের আগেই এসব প্রশ্ন মীমাংসা করে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

রাজনৈতিক প্রকট অঙ্গনের বাইরে যেখানে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি চলে সেখানেও আমরা দেখেছি কোনোভাবে কোনো ব্যক্তি কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধান হতে পারলে তিনিও ওই প্রধানের পদ ছাড়তে চান না। কেন্দ্রীয়ভাবেও তাকে সরানোর উদ্যোগ নেয়া হয় না। এ বিষয়ে প্রথমে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বলা যেতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে গণতান্ত্রিক পন্থা সুনির্দিষ্ট থাকলেও বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও পরিবর্তিত হন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের বিশেষ অ্যাক্ট কার্যকর আছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের রীতিসিদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর ৩ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে কোনো একজনকে প্রাথমিকভাবে ২ বছর এবং তাদের এই ২ বছরের কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে পরে আরো ২ বছরের জন্য নিয়োগ দেন। এই রেওয়াজই আইনগত ও বৈধভাবে সক্রিয় আছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন উপাচার্যদের সরাসরি ৪ বছরের জন্য ‘বিশেষভাবে’ একবারেই নিয়োগ দেয়া হয়। তারপর নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যরা আরো ৪ বছর বা তারও অধিক স্বীয় ক্ষমতায় থাকার জন্য নানা প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেন। সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রায় সেরূপ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। একই ব্যক্তির এরূপ পদে দীর্ঘ মেয়াদে বহাল থাকার ফলে গণতান্ত্রিক চর্চা, অন্যান্যের সৃজনশীলতা এবং নেতৃত্বের বিকাশ যে ব্যাহত হয় সেদিকে দলের কেন্দ্রীয় কমান্ড উদাসীন থাকে অথবা অসতর্ক থাকে। আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক দলের কাছে এমন আচরণ কেউ আশা করে না।

এ বছরের প্রায় শুরুর দিকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের একটি বক্তব্য অনেকেরই চোখে পড়েছিল। দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রায় চল্লিশোর্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই এরূপ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনের প্রাক্কালে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন দেশে যোগ্য অধ্যাপকের অভাব! তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। তার বক্তব্যে তিনি এও প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন যে, সে জন্যই একই ব্যক্তিকে একাধিক মেয়াদে স্বপদে রাখতে হয়! দুঃখজনকভাবে সাংবাদিক সাহেব প্রশ্ন করেননি যে, অধ্যাপকদের কি কি যোগ্যতা থাকতে হয়? এরূপ প্রশ্ন করলে না জানি আমরা কী উত্তর শুনতে পেতাম তার কাছ থেকে! আমাদের শিক্ষায়তনিক আড্ডায় তখন এ খবর পাঠ করে অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন তিনি কি কি যোগ্যতা নিয়ে একদা উপাচার্য হয়েছিলেন? আসলে সবাই বুঝে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে স্ব-স্ব গোষ্ঠীগত ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখা একপ্রকার কৌশল ছাড়া কিছু নয়। আমাদের ধারণা এ রকম বুদ্ধিজীবী পরিবেষ্টিতদের কারণে মন্ত্রিপরিষদ, দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মনোনয়নের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা সঠিক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে ক্ষমতার পুনরাবর্তনে একপ্রকার বাধ্য হন। এতে করে ব্যক্তি লাভবান হলেও দলের ব্যাপক সংখ্যক নেতাকর্মীর মধ্যে হতাশাবোধ জাগ্রত হয়। কোনো নির্বাচন সামনে এলে তখন এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমরা চিন্তিত হই। আমরা বেশি চিন্তিত হই বিভিন্ন পর্যায়ে বিগত প্রায় ১০ বছর যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা সাধারণের উন্নতির বিষয়ে কতটা নিবেদিত ছিলেন তা ভেবেও। মাঠপর্যায় থেকে অনেকের নামে কত বিচিত্র রকমের অভিযোগ-অনুযোগ বিগত বছরগুলোতে শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই।

সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্নকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হোক। কিন্তু আমাদের চাওয়ার সঙ্গে জনসাধারণের ভোট প্রদানের মধ্যে একটি ঐক্য প্রয়োজন। সেই ঐক্যের মধ্যে আবার দলীয় নেতাকর্মীদেরও সম্মিলন প্রয়োজন। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তায় দলগত ঐক্যে যদি বিভেদ সৃষ্টি হয় তাহলে ভোটের রাজনীতিতে তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া আন্তর্জাতিক ও ভ‚-রাজনীতির বিষয় তো আছেই। আছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের চাওয়া-পাওয়ার প্রসঙ্গ। সব হিসাব-নিকাশ ও নানারূপ মেরুকরণের পর্যায়ক্রমিক উত্তরণের দিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রস্তুতির বিষয়টিও সামনে এনে সাংগঠনিকভাবে সব সংকটের উত্তরণের পথ অনুসন্ধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সাংগঠনিক পর্যায়ে যেসব স্থানে সমস্যা আছে দ্রুত তা চিহ্নিত করতে হবে। অনতিবিলম্বে সেসব সমস্যার রাজনৈতিক সুরাহা নিশ্চিত করতে হবে। এর ব্যত্যয় মানে পিছিয়ে পড়াÑ এর ব্যত্যয় মানে হেরে যাওয়া। আমরা হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগকে দেখতে চাই না দেখতে চাই বিজয়ী আওয়ামী লীগকে। আমরা চাই ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে সাংগঠনিকভাবে কতটা প্রস্তুতি নিয়েছে, কতটাইবা প্রস্তুত?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App