×

পুরনো খবর

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ : আর্থ-সামাজিক অবক্ষয়ের নিদারুণ হুমকি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৭, ০২:৫৪ পিএম

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে অসহায়, নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসবার পালা সহসাই শেষ হচ্ছে না। বাংলাদেশের বুকে রোহিঙ্গাদের এই আনাগোনা দীর্ঘ দশক ধরে। এর যেন শেষ নেই, বিরাম নেই, নেই কোনো পরিত্রাণ। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিনের যে যন্ত্রণা, সে বিষয় নিয়ে কার্যত কোনো বিশেষ পদক্ষেপ কোনো সরকারের আমলেই দেখা যায়নি। আর সে কারণে নিরন্তর এক অপরিচিতের অনুপ্রবেশের দহন বাংলাদেশকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে। যখন থেকে এই বাংলায় রোহিঙ্গাদের অযাচিত অনুপ্রবেশ, তখনই এদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার অথবা কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ এলে চলে আসে মানবিকতার প্রসঙ্গ। মানবিকতার বিস্ময়কর সংজ্ঞাও দিতে জানে এই চির মানবতাবাদী বাংলাদেশ! কেন মিয়ানমার, তাদের কি কোনো মানবতা নেই, দীর্ঘদিন ধরে তারা একটি স্বাধীন দেশের ওপর একটি জাতিগোষ্ঠীর অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে চলেছে, তাদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আপন ভুবন ত্যাগ করতে বাধ্য করছে, ধর্ষণ করছে অবলীলায় অসহায় নারীদের, এর কোনো কিছুই কি মিয়ানমারের জান্তাদের হৃদয়কে কাঁপায় না, জাগ্রত করে না বিশ্ব বিবেককে? শুধু এসব নির্যাতিত সময়কে বুকের গহিনে ধারণ করে বাংলাদেশ, অপরদিকে রোহিঙ্গাদের সব যন্ত্রণা মাথা পেতে নিতে হবে এদেশের মানুষকে। মানবিকতা ভালো, অধিকতর মানবিকতা কখনো কখনো অর্ন্তজ্বালায় পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার যে তথাকথিত গান, আসলে তা এক চরম ধোঁয়াশা ও কুয়াশাচ্ছন্ন পদ্ধতি। এত সহজেই রোহিঙ্গারা এই বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে বলে যারা মনে করছেন, তারা আসলে মানবিকতার জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করার দরকার নেই, এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে। বর্তমান রোহিঙ্গাদের আগমন ও অব্যাহতভাবে আগমনের ধারায় নানাবিধ বিষয় আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। আজকে যাদের একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে রেখে তাঁবুতে আটকে রাখার সাময়িক ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে, আদৌ কি এই পালিয়ে আসা নানা সম্প্রদায়ের মানুষকে আটকে রাখা সম্ভব হবে? মানুষকে কি খাঁচায় পুরে রাখা যায়? দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে এদের জীবন পরিচালিত। জীবনের শুরুটাই হয়েছিল এদের নানা দমন-পীড়নের ভেতর দিয়ে, সেখানে একটুকু সুখের আশায় বহু পথ মাড়িয়ে, জীবনটাকে হাতের মুঠোয় পুরে ছুটে এসেছে তারা ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায়। আর সেই ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য, জীবন ধারণের প্রয়োজনে, সংসারটাকে চালিয়ে নেয়ার, জঠরজ্বালা  নিবারণের আশায় তাদের ছুটতে হবে নানা কর্মযজ্ঞে। তাদের কর্ম কোথায় বা তাদের কর্মটাই কী? এই কর্মের আশায় তারা ধীরে ধীরে খুপড়ি ছেড়ে বের হয়ে পড়বে, কাজের অন্বেষণে ছুটতে থাকবে যেখানে কর্ম আছে বা যারা কর্মের সন্ধান দেয় তাদের পানে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাবে একশ্রেণির মধ্যস্বত্ত্ব ভোগী দালাল শ্রেণি। এদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তারা রোহিঙ্গাদের নানাবিধ কর্মের প্রলোভনে, মানবতাবাদী-দরদি মানুষের ভেক ধরে রাতের আঁধারে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবে নানাবিধ কর্মক্ষেত্রে। এভাবে তারা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে দেশের অভ্যন্তরে। দারিদ্র্য যখন নিয়ত দরজায় কড়া নাড়বে তখন বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই তারা মানুষ নামক কতিপয় জন্তুর হাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে। যার ফলশ্রুতিতে যুবতী নারীরাও হবে দিকভ্রান্ত, অসভ্য কিছু মানুষ এসব অসহায় নারীদের নানা চাকরির প্রলোভন দিয়ে তুলে নেবে গোপন কুঠুরিতে। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় এখন গৃহকর্মীর বড় অভাব। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে এসব দরিদ্র-অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে বাঁচাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে একশ্রেণির নারী ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে উঠবে এবং এটি কখনো কখনো অস্বাভাবিক মাত্রায় উঠে গিয়ে পতিতালয় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটবে, যে ঘটনাকে কাল্পনিক মনে করার কোনো কারণ নেই। পার্বত্য অঞ্চল ও কক্সবাজারের নানা জায়গায়সহ অস্থায়ী তাঁবু খাটিয়ে আজকে লাখ লাখ মানুষের দিনরাত্রি যাপনের একটা সাময়িক ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এরা নিজেরাই একদিন নিজেদের শত্রুতে পরিণত করবে, দারিদ্র্যের ঘরেও তো রাত্রি নামে, আসে অন্ধকার, সে রাতে অনাকাঙ্খীত এক তাঁবু থেকে অন্য তাঁবুতে নারী-পুরুষের গমনাগমন ঘটবে না তা কী করে বলা যায়। এভাবে প্রতিনিয়ত অঘটন ঘটতে থাকবে একে অপরের ভেতরে, দেখা দেবে অসন্তুষ্টি, সৃষ্টি হবে মনোমালিন্য আর দলাদলি। একদিকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এক ভঙ্গুর জাতিগোষ্ঠীর ভাগ্যের নির্মম নিয়তি, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে বসবাসের চরম অনুপযোগী অধ্যায়, সব মিলিয়ে এক চরম বিনষ্টি। যার ফলে তারা আরো ভালো কোনো জায়গার আশায় ছুটতে থাকবে ক্রমাগত বেঁচে থাকার স্বপ্নে। এভাবেই সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী একদিন এই নিপীড়িত গোষ্ঠী আমাদেরই হাত ধরে ছড়িয়ে পড়বে নানাভাবে। তখন এই দেশটির হুমকির প্রসঙ্গ আজকের মানবতাবাদীদের জাগিয়ে তুলবে অন্যভাবে, ভিন্ন চেহারায়। সামান্য খুপড়িতে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে মানবেতর জীবন, তার ওপর রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস তো রয়েছেই। পাহাড়ে পাহাড়ে বাড়ছে রোহিঙ্গাদের প্রবল চাপ, প্রতিদিন পাহাড় কেটে ধ্বংস করে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে। এখানকার বৃক্ষরাজি প্রতিদিন উজাড় হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিষয়গুলো এ অঞ্চলসহ বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এক সময় মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। ভাষা নিয়েও রয়েছে নানা জটিলতা, রোহিঙ্গাদের ভাষা তো পরিষ্কার বাংলা নয়, এরা এখন টিকে থাকার মরণপণ লড়াইয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাংলা ভাষা শেখার দিকে ঝুঁকে পড়বে, ভাষার ভেতর দিয়ে এরা বাংলাভাষীদের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যেতে চাইবে। মনে পড়ছে পার্বত্য অঞ্চলের নৃগোষ্ঠী তারা তাদের ভাষাকে সব সময় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে, প্রতিনিয়ত আন্দোলন করছে কিন্তু এ বিষয়ে আমরা থেকে গেছি উদাসীন। আর এখন রোহিঙ্গারা বাংলা ভাষা শিখবে যতদ্রুত সম্ভব তাদের সব ভাষা ভুলে। একদিকে এ দেশের নৃগোষ্ঠীকে জোর করে ভাষা শেখানোর চেষ্টা অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের এখন জোর করে বাংলা ভাষা শেখার অবিরাম চেষ্টা। সবকিছুই টিকে থাকার স্বার্থে। কিন্তু এসব নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ কী? একটি উন্নয়নশীল জাতিতে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে এখন এক নিদারুণ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী। সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মানবিকতা দেখাতে দেখাতে এ দেশে রোহিঙ্গাদের বয়স কম তো হলো না। তারা এখান থেকে চলে যাবে বলে আসেনি, তারা টিকে থাকার লড়াই করে যাবে ভেতরে ভেতরে যে কোনো পদ্ধতিতে। এমনি করে কতকাল তারা রবে নিশ্চুপ এই বাংলাদেশে। সবাই সুখের সন্ধান করে, এরাও বাঙালিদের মতো সুখে থাকতে চেষ্টা করবে। যেটা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষেরা প্রত্যাশা করে এবং প্রায়ই নানাবিধ অধিকারের প্রসঙ্গ উঠে আসে। রোহিঙ্গাদের অনাকাঙ্খীত আগমনে নানাবিধ সামাজিক অবক্ষয় যেমনি আসন্ন তেমনি অর্থনৈতিক হুমকিও কম নয়। একদিকে জনবহুল বাংলাদেশ তার ওপর ক্রমাগত রোহিঙ্গাদের চাপ। এখান থেকে সহজ উত্তরণের পথ ছিল রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে নিরাপদে ফিরিয়ে দেয়া। কিন্তু সেই দিন ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। যারা অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে, বহু কষ্টে ঢুকেছে এই নিরাপদ বাংলায়, তারা কি সহসাই ফিরে যেতে চাইবে এখান থেকে, আর তাদের কি গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারবে বাংলাদেশ? সীমান্ত খুলে দিয়ে যাদের নিয়ে আসা হলো অতিথির বেশে, তাদের কীভাবে ফেরাবেন অনাদরে? মিয়ানমারের তথাকথিত গণতান্ত্রিক জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের যেখান থেকে উচ্ছেদ করেছে, সেখানে তারা এখন বড় বড় ধাতব যন্ত্র আর বুলডোজার দিয়ে সমান করছে। এক নতুন দেশ বিনির্মাণের স্বপ্নে মিয়ানমার এখন রোহিঙ্গাদের ভিটায় ঘুঘু চরায়। পার্থক্য সেখানেই, মিয়ানমার বুলডোজার চালিয়ে জায়গা থেকে মানুষকে বিতাড়িত করছে, আর বাংলাদেশ তাদের পাহাড় বন উজার করছে সেইসব অসহায় জাতিকে বসবাসের স্থান করে দেয়ার জন্য। বাংলাদেশের মানবিকতা আজ বিশ্ব স্বীকৃত, আশ্বাস আছে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার বিষয়ে কিন্তু এই আশ্বাসবাণীর প্রতিফলন কত দিনের জন্য। সহযোগিতার চেয়ে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে স্থায়ী সমাধানের আশ্বাসটা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি এখন। সেদিকে বিশ্ববাসীর নজর কম। জাতিসংঘের মহাসচিব গত অধিবেশনে যথেষ্ট আন্তরিক থাকলেও মোড়লবিশ্বের রাজনীতির কাছে তিনি খুব বেশি মাথা উঁচু করতে পারেননি। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মানবতাবাদের অন্যতম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে মানবতাবাদী দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, সেটা বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য। আবার এ দেশের বড় একটা অর্জনও বটে। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে আন্তরিকভাবে রোহিঙ্গাদের জায়গা করে দেয়া মানবিকতার দিক দিয়ে এক অত্যুজ্জ্বল উদাহরণের পাশাপাশি মানবিকতার ফলাফল, দেশ এবং জনগণকে ক্রমান্বয়ে বিষিয়ে তুলবে কিনা সেটিও এখন দেখার বিষয়।    

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App