×

মুক্তচিন্তা

পাঠ্যপুস্তকে যখন যৌন নিপীড়ন স্বীকৃত

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৭, ০৮:২৫ পিএম

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এই সত্য জেনে এসেছি, শিখে এসেছি, বিশ্বাসও করেছি। যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত উন্নত। তোতা পাখির মতন বুলি আউড়িয়ে এই সত্যকে যেমন নিজের ভেতর পুষেছি, তেমন অন্যের মাঝে প্রচারও করেছি। কিন্তু এই জানা, এই শেখা, এই বিশ্বাসের রূপ বদলে যাচ্ছে, বদলেছে। হতাশায়, বিষাদে রূপ বদলেছে। এই রূপ বদলাতে বাধ্য করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কী শেখানো হচ্ছে আমাদের শিশু-কিশোরদের, তা বুঝার, উপলব্ধি করার যেন কেউ নেই। এমন কোনো মাথা নেই, যেখানে জ্ঞান-বুদ্ধির অস্তিত্ব আছে, ভাবতে পারেন কী শেখানো জরুরি, আর কী শেখানো হচ্ছে। কিছুদিন আগে জাতীয় শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। হেফাজতিকরণের বিষয়টি প্রতীয়মান হতে জনমনে ক্ষোভ সঞ্চার হয়েছে। কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে। ক্ষোভের পরিণামে কিছুটা সংশোধনও হয়েছে। কিন্তু থেমে থাকেনি পাঠ্যপুস্তক নিয়ে অবহেলা, ছেলেখেলা।

দুঃখজনকভাবে বলতে হয় যে, বাংলাদেশে যে সেক্টর অত্যন্ত নাজুক, দৈন্যদশায়, হেলাফেলায়, অবহেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে তার নাম শিক্ষাব্যবস্থা। সামাজিক নৈতিক মূল্যবোধ গড়তে, চর্চা করতে এই শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উপযুক্ত কারিকুলাম, বিষয়, কৌশল, পরিকল্পনা, বাস্তবসঙ্গত যাই বলি না কেন, আশাব্যঞ্জকভাবে তা নেই। ছিটেফোঁটা আছে কিনা সে প্রশ্নও থেকে যায়। ফলে পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস হচ্ছে হয়তো ঠিকই কিন্তু বোধোদয়ের মধ্য দিয়ে ভালো মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা, সুযোগ থাকছে না। উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে সামাজিক অবক্ষয়ে জড়িয়ে পড়ে একশ্রেণির কিশোর-যুবক পৌঁছে যাচ্ছে পরিণত বয়সে। পরিণত বয়সে এরাই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশে এখন বড় যে আতঙ্ক অভিভাবকদের মনে, নারীদের মনে তা হলো ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারীরা নিজের ঘর, বাস, ট্রেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, রেস্তোরাঁ, নিয়ন্ত্রিত এলাকা ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে, জায়গায় প্রায় প্রতিদিন যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। বলা যায় ধর্ষণ এখন জাতীয় সংকট। জানি না সেই দৃষ্টিকোণে, দায়বোধে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত অষ্টম শ্রেণির গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের সপ্তম অধ্যায়ে ৬৫ নম্বর পৃষ্ঠায় পাঠ-৩-এ যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষার সতর্কতা ও কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে তাহলে এই বিষয়ে আরো যতœশীল, গভীর দৃষ্টিদান এবং সর্বোপরি একজন নারী শিশু-কিশোরী বা তরুণীর অধিকার সংরক্ষিত হওয়া জরুরি ছিল। যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন থেকে রক্ষার কৌশল হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে বলা হয়েছে, বাড়িতে কখনোই একা না থাকা, অন্যকে আকর্ষণ করে এমন পোশাক না পরা, পরিচিত কিংবা অপরিচিত ব্যক্তি গায়ে হাত দিলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া বা পরিত্যাগ করা, পরিচিত-অপরিচিত কারো সঙ্গে একা বেড়াতে না যাওয়া, মন্দ স্পর্শ টের পেলে অবশ্যই তা সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবাকে জানানো এবং পাড়ার বখাটে দলের হয়রানিতে সরাসরি প্রতিক্রিয়া না করে কৌশলে উপেক্ষা করা। মারহাবা! খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কোন শ্রেণির বুদ্ধিওয়ালারা এমন উপদেশ, কৌশল রচনা করতে নিয়োজিত ছিলেন? প্রতিটি উপদেশে নারীর অধিকার হরণ করা হয়েছে, যৌন নিপীড়ককে অবাধ করেছে, যৌন নিপীড়নকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এই সত্য অনুধাবনে ন্যূনতম বোধও তাদের কাজ করেনি এটাও নিশ্চিত প্রমাণিত হয়েছে।

প্রথমেই আসি বাড়িতে একা না থাকতে বলার প্রসঙ্গে। বাড়িতে একা থাকলে কোনো নারী শিশু-কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হতেই পারেন বা হবেন এমন ধারণা ও বিশ্বাস শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের হয়তো হয়ে গেছে। শিক্ষাবোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা দেশে নারীদের নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবেই এই ধারণা পোষণ করেছেন কিনা, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমাদের প্রশ্ন, যদি পরিবারে মা-বাবা উভয়ই চাকরিজীবী হন, একমাত্র কন্যা সন্তান তাদের কিংবা আরো ভাইবোন আছে তারা বিভিন্ন কাজ হয়তো ব্যস্ত, তেমন একজন নারী শিশু-কিশোরী বা তরুণীকে সামাজিক প্রতিক‚লতা, নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে হবে, এই বাস্তবতা কি তাহলে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত, অনুধাবিত? এ বিষয়ে রাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যই বা কী? নাকি নিরাপত্তা দেয়ার প্রশ্নে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ঢাকার এই কৌশল? আর ঘরে মেয়েটি কারো সঙ্গে থাকলেও কি নিরাপদ, মানে যৌন নিপীড়নের শিকার হবে না, সেই উত্তরই বা কী হতে পারে? কিংবা মেয়েটি ঘরে একা না থাকলে কোথায় থাকবে? এমন কিছু শেখানো উচিত নয়, যা উত্তরের পরিবর্তে হাজারো প্রশ্নের, সংশয়ের জন্ম দেয়, নারীর অধিকার হরণ করে। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে ডাকাতি, চুরি থেকে রক্ষার কৌশল হিসেবে একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক সময় বলেছিলেন, ছুটিতে ঘরের বাইরে গেলে জনগণ যেন নিজেদের ঘরের নিরাপত্তার জন্য তালাচাবি মেরে যান। মন্ত্রীর বিশ্বাস ঘরে তালাচাবি মেরে গেলে চুরি, ডাকাতি হবে না। কারণ চোর-ডাকাতের বুদ্ধি নেই ওই তালাচাবি খুলে চুরি-ডাকাতি করার কিংবা যার যার নিরাপত্তা তাকেই নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত ভেবে নিতে পারি সেসব বুদ্ধির ধারাবাহিকতায় গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের এই দশা। তারপর পোশাক, পরিচিত-অপরিচিতর সঙ্গে বেড়াতে না যাওয়া, এলাকার বখাটে ছেলেদের আপত্তিকর আচরণের প্রতি সরাসরি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে কৌশলে উপেক্ষা করার বিষয়ে যা বলা হয়েছে, তা অত্যন্ত ক্ষীণবুদ্ধিসম্পন্ন এবং পুরুষতান্ত্রিক। সব বলাতেই নিপীড়কের অস্তিত্বকে বহাল তবিয়তে রাখা হয়েছে, যে নিপীড়ক একজন পুরুষ। প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার টার্গেট নারী এবং তা অন্যান্য সব জায়গার মতো পাঠ্যপুস্তকেও!

জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও জাতীয় শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত কোনো পাঠ্যপুস্তকে কি পুরুষ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, কীভাবে তারা নারীদের শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখবে কিংবা দেখা উচিত? কিংবা বলা হয়েছে, যৌন নিপীড়ন একটি অসভ্য, অপরাধজনিত আচরণ, একজন যৌন নিপীড়ক সমাজের নিকৃষ্ট ব্যক্তি, এ আচরণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ? আমার জানা নেই কোথাও বলা হয়েছে কিনা। বলতেই হয়, বোধের শেকড়ে কীট মারার সার না দিয়ে, বোধকে ধ্বংস করার এই পাঁয়তারা মূলত জাতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দেয়া। পাঠ্যপুস্তকে যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে যৌন নিপীড়ক বলে একটি গোষ্ঠী, বখাটে বলে একটি গোষ্ঠী সমাজে থাকবেই, আর এটা মেনে নিয়ে নারী নিজেকে রক্ষা করে চলবে। দুঃখজনক, লজ্জাকর বিষয়। উন্নয়ন উন্নয়ন বলে এত যে চেঁচামেচি, একজন শিশু বা কিশোরী যদি বাড়িতে একা নিরাপদে না-ই থাকতে পারে, তাহলে কিসের কী? আর মাথায় এলো তাই ইচ্ছে মতন যাচ্ছেতাই লিখে দিলাম, তাও আবার জাতীয় শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে! যারা এসব লেখেন, মনিটরিং করেন, তারা কতটুকু জ্ঞান রাখেন, বোঝেন তা নিয়ে সংশয় থেকে যায় বৈকি। শিক্ষা নিয়ে মাথা ঘামানোর লোক যেন নেই এ দেশে। যা শেখানো হচ্ছে, তা কতটা পিছিয়ে দেয়, দিতে পারে জাতিকে সেটুকুন বুঝবার, দেখবারও যেন কেউ নেই।

আধুনিককালে সব ধরনের কাজই তো নারী ও পুরুষকে করতে হয়, জানতে হয়। করছেন ও জানছেনও তা। কারণ এ ছাড়া উপায় নেই। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা বজায় রাখা, নিজেদের শিক্ষা-মেধাকে কাজে লাগিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে নারী-পুরুষ সমান তালে কাজ করেন। ঘরের কাজে নারী ও পুরুষ, উভয়ই ওস্তাদ বা পারদর্শী হচ্ছেন। তেমন একটি সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য কেন কেবল গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, আর পুরুষ শিক্ষার্থীর জন্য কৃষি বিজ্ঞান? নারী তো প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিকাজ করে আসছে। এক সময় কৃষিই নারীদের প্রধান পেশা ছিল। পাঠ্যপুস্তকে নারী ও পুরুষের জন্য এ ধরনের বিষয়ভিত্তিক ভিন্ন পাঠ পরিকল্পনা বৈষম্য তৈরিতে শক্ত প্রভাবক, সহায়ক। এ বিষয়ে ভাবতে হবে। পরিশেষে বলি, শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে যত্নশীল হয়ে না দেখলে, ভাবলে ফলাফল ভয়াবহ হবে। যে ভয়াবহতা মোকাবেলা প্রায় অসম্ভব।

 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App