×

পুরনো খবর

জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা করেছেন-এ বক্তব্য অজ্ঞতা প্রসূত

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৭, ০৪:১৪ পিএম

বর্তমান নির্বাচন কমিশন চাইছে আগামী একাদশ সংসদীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল যেন অংশগ্রহণ করে। নি:সন্দেহে এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হয়। ইতোমধ্যে বহু রাজনৈতিক দল সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হতে পারে তা নিয়ে কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি আলোচনায় আসলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বিএনপি তথা খালেদা জিয়া এবং জেনারেল জিয়ার স্তুতি গেয়েছেন। প্রথম কথা কোনো রাজনৈতিক দলের সাফল্য, অর্জন বা ব্যর্থতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা কি কমিশনের কার্যকলাপের আওতায় পড়ে? এই আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালুর ব্যাপারে জেনারেল জিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অজ্ঞতাপ্রসূত। এ নিয়ে কথা বলার আগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। সে সময় দেশে ১৯টি জেলা এবং ৬২টি মহকুমা ছিল। সব মহুকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়- জেলার প্রধান হবেন গভর্নর, আর ডিসির পরিবর্তে থাকবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। প্রথমবার গভর্নর নিয়োগ দেয়া হবে। এরপর তারা নির্বাচিত হবেন। আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়। শুধু একটি দল থাকবে যার নাম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বা বাকশাল)। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ১৯৭৫-এর ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাকশাল প্রশাসন চালু হবে। গভর্নর এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ঢাকায় প্রশিক্ষণ শুরু হয় জুলাইয়ের শেষ থেকে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই ঘটনার অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক দেশের রাষ্ট্রপ্রতি হন। এখানে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং বাকশালপ্রধান। এই আইনের ব্যত্যয় না ঘটালে তো মোশতাককে বাকশাল শাসন ব্যবস্থা চালু করতে হয় ১ সেপ্টেম্বর থেকে। অতএব মোশতাক সম্ভবত ২০ আগস্ট ১৯৭৫-এ এক ঘোষণা বলে বাকশাল প্রশাসন রহিত করে দিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার ফরমান জারি করেন। এই কলামিস্ট বাকশাল ব্যবস্থায় ঢাকায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়োগ পেয়ে ঢাকায় প্রশিক্ষণে ছিলেন। পরে আবার সাবেক পদে অর্থাৎ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে পূর্ব পদে ফিরে যান। অর্থাৎ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালুর সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ঘটনার পর গোটা জাতি স্তম্ভিত। রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করত। কিন্তু এদিকে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা গোটা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। স্থানীয়ভাবে রাতে কারফিউ। এ রকম একটা অবস্থার মাঝে ঘটল ৩-৭ নভেম্বরের সেনা সংঘাত। একদল একে সিপাহি বিপ্লব বলে থাকেন। কিন্তু বিপ্লবের আদর্শ-উদ্দেশ্য কী তা কেউ জানে না। আসলে এটি ছিল সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে ক্ষমতা দখলের লড়াই। এর মাঝে ২ নভেম্বর মধ্য রাতে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ঘটে ইতিহাসের নিন্দিত এক হত্যাকান্ড। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান এই চার জাতীয় নেতাকে বন্দি অবস্থায় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। অথচ জেলখানা বন্দিদের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহু রাজাকার, আলবদর কোর্টে আত্মসমর্পণ করে জেলে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। আর দেশের সবচেয়ে বড় অর্থাৎ কেন্দ্রীয় কারাগার জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা দিতে পারল না। কথিত বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয়ী হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। অবশ্য বলা হয়ে থাকে যে, তার বিজয়ের চালিকাশক্তি ছিলেন কর্নেল তাহের, যাকে কথিত বিপ্লব ঘটার ৯ মাসের মাথায় কেন্দ্রীয় কারাগারে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়। এই বিপ্লব সম্পর্কে এই কলামিস্টের অভিজ্ঞতার কথা বলা প্রয়োজন। তখন আমি বগুড়ায় এডিসি। ডিসির কক্ষে আমরা বসে আছি। সম্ভবত নভেম্বর ১৯৭৫-এর ৮/৯ তারিখের ঘটনা। এক সেনা জওয়ান ডিসির কক্ষে ঢুকে বললেন যে, তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসেছেন। যশোর ক্যান্টনমেন্টে বিপ্লব ঘটেনি। সেখানে তিনি সে কাজটি করতে যাচ্ছেন। পুরো ট্যাংক পেট্রোল ভর্তি করে তাকে একটি জিপ দেয়া হলো। ক’দিন পর যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে জানানো হলো যে, সেই বিপ্লব রপ্তানিকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লোক পাঠিয়ে গাড়িটি যেন নিয়ে যাওয়া হয়। এমন বিপ্লব যে এক ক্যান্টমেন্টে ঘটল, অন্য ক্যান্টনমেন্টে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। জেনারেল জিয়া তার ভাষণে বলেছিলেন যে, তিনি সৈনিকদের অবস্থা স্বাভাবিক হলে ব্যারাকে ফিরে যাবেন। তিনি সে কথা রেখেছিলেন কিনা তা বলার প্রয়োজন নেই। ১৯৭৭ সালে সম্ভবত জুন মাসে হ্যাঁ-না ভোট করে নিজের কর্মসূচি জায়েজ করলেন। ইতোমধ্যে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি। একটি ভোট না হলে তো সিভিল বৈশিষ্ট্য হয় না। সামরিক আইন চলছিল দেশে। তাই রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ ছিল। তিনি ফরমান দ্বারা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করলেন। আলোচনা চালানো হলো। ইতোমধ্যে তিনি চীনপন্থী ন্যাপ এবং মুসলিম লীগ থেকে কিছু জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গ পেলেন। এভাবে ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন হলো। তিনি প্রার্থী হয়ে জয়ী হলেন। তখন তিনি সেনাবাহিনী প্রধান। প্রজাতন্ত্রের সার্বক্ষণিক একটি পদে অসীন থেকে কি নির্বাচন করা যায়, এ প্রশ্ন অন্তরায় হলো না। বস্তুত জেনারেল জিয়া যে পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তার মূল প্রেরণা পাকিস্তানের জেনারেল আইয়ুব খান যিনি আবার স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল। কিছুটা রদবদল করা হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে। জেনারেল এরশাদও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। আসলে সামরিক আইনের বিধি জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ঘুমিয়ে রাখা হয়, আবার জাগানো হয়। অতএব এই গণতন্ত্র হলো সামরিক স্টাইলের গণতন্ত্র। এবার শুরুতে আসি। কে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছেন, কে স্বাধীনতার ঘোষক, এসব নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে হয়তো বা আরো হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজনীতিকরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন সরকারের কোনো কর্মকর্তা কিছু বলেন বা বলতে চান, তাহলে তাকে একটু হিসাব-নিকাশ করতে হবে। বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুু বলেছিলেন বাকশাল কায়েমের মধ্য দিয়ে মানুষের সার্বিক মুক্তি আসবে, শোষণের অবসান হবে। যেহেতু বাকশাল চালু হয়নি, তাই একে নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, এর মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। তাই বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালুর কথা এসেছে। অবশ্য অনেকেই হয়তো একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বা বাকশাল ব্যবস্থা পছন্দ করেননি এবং এর ফলে বঙ্গবন্ধুকে দোষারোপ করে থাকেন এই বাকশাল ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়ার জন্য। আগেই বলেছি যে, মোশতাক নিজেকে ক্ষমতায় রাখার জন্য বাকশাল রহিত করেছেন। অতএব বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু করার কৃতিত্ব যদি দিতে হয় তাহলে তো মোশতাককে দিতে হয়। জেনারেল জিয়া যে গণতন্ত্র দিয়েছেন সেটি সব দেশে সব সামরিক শাসকরা দিয়ে থাকেন। জেনারেল জিয়া দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তার ইতিবাচক কর্মসূচি থাকতে পারে, তা নিয়ে কথা বলা যায়, প্রশংসা করা যায়। কিন্তু যে দৃশ্যপটে তার কোনো ভ‚মিকা ছিল না সেখানে তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটা হাস্যকর। আর সেটি যদি করেন একজন সচিব পদ মর্যাদার কেউ তাহলে সেটা আরো দুঃখজনক। ইতোমধ্যে এর ফল হিতে বিপরীত হয়েছে। তিনি একটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, আর তার ইন্টিগ্রিটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন তিনি।  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App