×

খেলা

ফুটবল সম্রাটের জীবনের গল্প

Icon

শামসুজ্জামান শামস

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১১:০৯ পিএম

সময়টা ১৯৫৬ সাল। মাত্র ১৬ বছর বয়সের এক তরুণকে নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠল গণমাধ্যমে। ইউরোপের নামি-দামি ক্লাবগুলো উঠেপড়ে লাগল তখনো কৈশোরের গন্ধ শরীরে লেগে থাকা বালকটিকে তাদের দলে ভেড়ানোর জন্য। বলছি বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে সেরাদের সেরা বলে খ্যাত ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার পেলের কথা। [caption id="attachment_4117" align="aligncenter" width="1024"] বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট ( পেলে)[/caption] ৬০ বছর আগে অসাধারণ ফুটবলশৈলী দেখিয়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে দেয়া সেই ১৬ বছরের ছেলেটি এই সপ্তাহেই পা দেবেন ৭৭ বছরে। ২৩ অক্টোবর ৭৭তম জন্মদিনের কেক কাটবেন ফুটবলের এই জীবন্ত কিংবদন্তি। যখন ফুটবল খেলতেন তখন মাঠে পায়ের জাদুতে তার দেখানো অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য, খেলা ছাড়ার পরও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা এবং অসহায় মানুষদের জন্য তার করা কিছু সেবামূলক কর্মকা- শুধু একজন ফুটবলার হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবেও তাকে নিয়ে গেছে এক অন্য উচ্চতায়। ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি পেলের ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, ফুটবলের সঙ্গে তার সখ্য এবং তার বর্তমান অবস্থা নিয়েই এই লেখা। [caption id="attachment_4118" align="aligncenter" width="744"] ১৯৬৬ সালে প্রথম স্ত্রী রোসমেরি ডস চলবির সঙ্গে পেলে। ১৯৮৩ সালে এ জুটির বিচ্ছেদ ঘটে[/caption] ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের ক্রেশ কোরাকেয়েস শহরের এক বস্তিতে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর জন্ম নিয়েছিলেন পেলে। তবে হয়তোবা তাকে বিজ্ঞানী বানানোর স্বপ্ন ছিল তার বাবা-মায়ের। হয়তো এজন্যই বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিল রেখে তারা ছেলের নাম রেখেছিলেন এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট। উল্লেখ্য, ব্রাজিলের লোকজন পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে এবং পর্তুগিজ ভাষায় এডিসন শব্দের উচ্চারণ হয় এডসন। তবে, ফুটবল জাদুকরকে তার বন্ধুরা ডাকতেন ডেকো বলে। বাবা-মায়ের রাখা নাম এবং বন্ধুদের ডাকা নামের বিলুপ্তি ঘটে এক সময় কীভাবে তার নাম পেলে হয়ে গেল তা তিনি নিজেও জানেন না। দরিদ্র পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে অল্প বয়সেই পেলেকে নিতে হয়েছিল সংসারের দায়িত্ব। সে সময় সংসার চালানোর জন্য চায়ের দোকানে কাজ নেন তিনি। তবে ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে জন্ম নেয়া আর ১০ জন বালকের মতোই ফুটবলের প্রতি ছিল তার অশেষ ভালোবাসা। যে কারণে চায়ের দোকানের কাজের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই রাস্তার গলিতে নেমে পড়তেন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে। তবে দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের ছেলে পেলের ফুটবল কেনার জন্য কোনো টাকা না থাকায় পুরনো মোজার ভেতরে খবরের কাগজ ঢুকিয়ে তা তৈরি ফুটবল নিয়েই বন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠতেন ফুটবল খেলায়। এতেই বুঝা যায় ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি তার টান কতটা। পেলের ছোটবেলার অনেক বন্ধুদের কাছে শোনা যায়, ছোটবেলায় ফুটবলের প্রতি পেলের টান, আগ্রহ এবং ফুটবল নিয়ে তার পায়ের জাদু দেখে মনে হতো ফুটবল যেন মিশে আছে তার রক্তে। তবে অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কেউ ভাবেননি বস্তির গলিতে ফুটবল খেলা এই ছেলেটা একদিন বিশ্বসেরা ফুটবলার হবেন। কিন্তু ফুটবল যার রক্তে আছে তাকে তো কোনো বাধায় দমিয়ে রাখতে পারে না। তার প্রতিভা দেখে সাবেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার দে ব্রিটো তাকে নিয়ে যান ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোসে। ১৫ বছর বয়সে সান্তোসের বি দলের হয়ে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় পেলের। আর এরপরের গল্পটা যেন রূপকথাকেও হার মানায়। সান্তোসের বি দলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে পরের বছরই জায়গা তিনি করে নেন সান্তোসের মূল দলে। সে মৌসুমে ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন তিনি। বলা বাহুল্য তখন পেলের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এত অল্প বয়সে কোনো দেশের ঘরোয়া লিগে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড নেই আর কারো। এরপর শুধু ব্রাজিল নয়, ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুরো উঠেপড়ে লাগে এই বিস্ময় বালককে দলে নেয়ার জন্য। [caption id="attachment_4123" align="aligncenter" width="780"] বিশ্বকাপ জয়ের অানন্দে পেলেকে নিয়ে সমর্থকদের উল্লাস[/caption] তবে নিজ জন্মভূমি ছাড়তে অনিচ্ছুক এই ফুটবলার ইউরোপের নামি-দামি ক্লাবগুলোর বিশাল অঙ্কের অর্থের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে যে ক্লাবে তার ফুটবলের হাতেখড়ি সেই সান্তোসেই থেকে যান। তবে এক্ষেত্রে তখনকার ব্রাজিল সরকারেরও প্রভাব ছিল। পেলের এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স সবার এতটাই নজর কেড়েছিল যে শেষ পর্যন্ত সরকার তাকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ব্রাজিলের বাইরে অন্য কোনো দেশের ক্লাবের হয়ে তার খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ কারণে ভিনদেশি কোনো ক্লাবের হয়ে কখনো খেলতে পারেননি পেলে। সান্তোসের হয়ে ঘরোয়া লিগে তার পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন সে বছরই তাকে সুযোগ দেয় জাতীয় দলে। চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলার মধ্য দিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় তার। তবে সেই ম্যাচে ব্রাজিল ২-১ গোলে হারলেও ব্রাজিলের হয়ে একমাত্র গোলটি আসে পেলের পা থেকে। যা তাকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার স্বীকৃতি। [caption id="attachment_4125" align="aligncenter" width="780"] দ্বিতীয় স্ত্রী ব্রাজিলিয়ান সুন্দরী আসিরিয়া লিমোসের সঙ্গে পেলে[/caption] তারপরের বছর ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে অভিষেক ঘটে তার। তবে বিশ্বকাপের প্রথম দিকের কয়েকটি ম্যাচে নিজেকে মেলে ধরতে না পারলেও শেষের কয়েকটি ম্যাচে ঠিকই জ্বলে উঠেন তিনি। আর শেষদিকে তার এই জ্বলে উঠাতেই মূলত সে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত টানা চারটি বিশ্বকাপে খেলেছেন পেলে। এর মধ্যে ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৭০-এর বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। যার মধ্যে ১৯৫৮ এবং ১৯৭০-এর বিশ্বকাপ বিজয়ে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তার। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপের সদস্য হিসেবে দলে থাকলেও দ্বিতীয় ম্যাচে আঘাত পাওয়ার পর ইনজুরির কারণে পরবর্তী ম্যাচগুলোতে আর মাঠে নামতে পারেননি তিনি। ক্যারিয়ারের ১৩৩৬টি ম্যাচে মাঠে নেমে ১২৮৩টি গোল করেছেন পেলে। যার মধ্যে নিজ দেশ ব্রাজিলের হয়ে করেছেন ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল এবং ক্লাব সান্তোসের হয়ে করেছেন ৬৩৮ ম্যাচে ৬১৯ গোল। শুধু খেলা নয়, খেলার বাইরের নানান কর্মকান্ডেও অনন্যসাধারণ পেলে। নিজে উঠে এসেছেন অতি দরিদ্র এক পরিবার থেকে। হয়তোবা এ কারণেই অসহায় এবং দরিদ্র মানুষের কষ্ট, দুর্দশা ও মানবেতর জীবনযাপনের গল্পগুলো বেশি স্পর্শ করে তাকে। তাই খেলোয়াড় থাকাকালীন গরিব, দরিদ্র এবং অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা। তাছাড়া ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পরও জাতিসংঘ, ইউনিসেফ ছাড়াও আরো বহু সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন সব সময়। নিজের জীবনী নিয়ে একটি বই লিখেছেন পেলে। পুরো ক্যারিয়ারে ১২৮৩টি গোল করেছেন। তাই নিজের লেখা আত্মজীবনীমূলক এই বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘১২৮৩’। এই বইয়ে তার জীবনের অজানা বহু গল্পের পাশাপাশি রয়েছে তার ফুটবলার জীবনের দুর্লভ কিছু ছবি এবং মাত্র ১২৮৩ কপি ছাপানো এই বইয়ের প্রতিটি কপিতে রয়েছে বিশ্বের বিখ্যাত ফুটবলারদের অটোগ্রাফ। [caption id="attachment_4126" align="aligncenter" width="1920"] তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ৭৭ বছর বয়সেও সুখী পেলে[/caption] তবে ৩ ছেলে এবং ৩ কন্যার বাবা পেলের সাংসারিক জীবনটা তার ফুটবল ক্যারিয়ারের মতো গোছানো নয়। ১৯৬৬ সালে রোসমেরি ডস চলবিকে বিয়ে করেন তিনি। তবে ১৯৮৩ সালে দীর্ঘ ১৬ বছরের সংসার জীবনের অবসান ঘটে তাদের। অবশ্য এ বিচ্ছেদের জন্য পেলেকেই দায়ী করেন অনেকে। এ সময় ব্রাজিলিয়িান সুন্দরী মডেল জোজার সঙ্গে গভীর প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে–ছিলেন তিনি। তবে মডেল জোজোর সঙ্গে ৬ বছর প্রেম করলেও তাকে বিয়ে না করে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ সালে আরেক ব্রাজিলিয়ান সুন্দরী আসিরিয়া লিমোসকে বিয়ে করেন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার। তবে সেই সম্পর্কও টিকেনি বেশিদিন। ২০০৮ সালে বিচ্ছেদ হয় পেলে-আসিরিয়ার দাম্পত্যের। এরপর দীর্ঘদিন একাকী জীবন কাটানোর পর সর্বশেষ ২০১৬ সালে মার্সিয়া ওকির সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে জড়িয়েছেন পেলে। বর্তমানে তার সঙ্গেই ঘর করছেন কয়েকদিন পরেই ৭৭ বছরে পা দিতে চলা পেলে।  তবে বেঁচে থাকার জন্য ব্রাজিলের কালো মানিক খ্যাত পেলেকে এখন প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে বার্ধক্যের সঙ্গে। দুই বছর আগেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু সারাবি বিশ্বের কোটি কোটি ভক্তের প্রার্থনা তাকে ফিরিয়ে এনেছে মৃত্যুর মুখ থেকে। সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? পেলে নাকি ম্যারাডোনা? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান সারা বিশ্বের ফটবল প্রেমীরা। বহুদিন আগে থেকে চলে আসা এই বিতর্কের সমাধান হয়নি এখনো। হয়তোবা এই বিতর্ক চলবে আরো বহুকাল। তবে এই বিতর্কে কিছুটা সমাধান ফুটবল বিশেষজ্ঞরা দিয়ে দিয়েছেন। ফুটবল বিশ্লেষকরা আর্জেন্টাইন ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে আখ্যা দিয়েছেন ফুটবলের রাজপুত্র হিসেবে। প্রশ্ন জাগতে পারে ম্যারাডোনা যদি ফুটবলের রাজপুত্র হন তাহলে পেলে কি। এ প্রশ্নের উত্তর ইতোমধ্যই দিয়েছেন ফুটবলবোদ্ধারা। ম্যারাডোনা যদি ফুটবলের রাজপুত্র হন তাহলে পেলে ফুটবলের সম্রাট। ফুটবলের সম্রাট পেলে আমাদের মাঝে আরো বহু বছর বেঁচে থাকুন সেই প্রার্থনায় শেষ করছি লেখাটা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App