×

জাতীয়

তবুও নাগালের বাইরে রান্নার সিলিন্ডার গ্যাস

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ০৮:৫৬ এএম

কয়েক বছর ধরে বাসাবাড়িতে গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ। নতুন কোনো সিএনজি স্টেশনেরও অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। শিল্পেও সংযোগ দেওয়া হচ্ছে সীমিত পর্যায়ে। কারণ, গ্যাসের ঘাটতি ব্যাপক। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, 'বাসাবাড়িতে মূল্যবান এ গ্যাস পোড়ানো এক প্রকার অপচয়। এ জন্য বাসাবাড়িতে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে উৎসাহিত করতে চায় সরকার।' কিন্তু এলপি গ্যাস সিলিন্ডার সহজলভ্য করার জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। ফলে পরিবেশবান্ধব এই রাম্নার গ্যাস এখনও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই। যদিও সরকার ২০২০ সালের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ আবাসিক জ্বালানি চাহিদা এলপি গ্যাসের মাধ্যমে মেটানোর ঘোষণা দিয়েছে। এলপি গ্যাস প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয় বেসরকারি উদ্যোগে। বর্তমানে সাড়ে ১২ কেজির একটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম স্থানভেদে নয়শ' থেকে এক হাজার টাকা। একটি ছোট পরিবারে রাম্নার জন্য মাসে অন্তত দুটি সিলিন্ডার লাগে। খরচ হয় কমবেশি দুই হাজার টাকা। পাইপলাইন গ্যাস সুবিধা যাদের আছে, তাদের গুনতে হয় মাসে মাত্র ৮০০ টাকা। এ বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রেও সরকারের কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই।   পাশের দেশ ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে এলপি গ্যাসের দাম দ্বিগুণ। ভারত এই এলপি গ্যাস জনপ্রিয় করতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে, বাংলাদেশ সরকার ভর্তুকি দেয় না। ফলে এই রাম্নার গ্যাসের দামও আশানুরূপ কমে না। শুধু ভারত নয়, থাইল্যান্ডসহ বহু দেশে এই রাম্নার গ্যাসে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। গাছপালা কেটে কাঠ-খড়ি দিয়ে রাম্না বন্ধ করার লক্ষ্যে এলপি গ্যাসে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য পরিবেশবাদীরাও বহু আগে থেকেই দাবি জানিয়ে আসছেন; কিন্তু সরকার নির্বিকার। এলপিজির চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। বেসরকারি তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে বছরে এলপি গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে প্রায় পাঁচ লাখ টন। \হমাত্র ২০ হাজার টন দেশে উৎপাদিত হয়। এলপি গ্যাস শুধু আবাসিকেই নয়, খাবার হোটেল, যানবাহন, ক্ষুদ্র শিল্পসহ বহু খাতে ব্যবহার হয়। যানবাহনেও সিএনজির পাশাপাশি এলপিজি ব্যবহার শুরু হয়েছে। সিএনজিকে নিরুৎসাহিত করে পরিবহন খাতেও এলপিজি ব্যবহার বাড়াতে চায় সরকার। ঢাকাসহ বিভিম্ন জেলায় এলপিজির কয়েকটি স্টেশন রয়েছে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এলপিজি স্টেশন স্থাপনের অনুমতি চেয়েছে।   এলপিজির মূল্য :বর্তমানে সাড়ে ১২ কেজির এক সিলিন্ডার এলপি গ্যাস নয়শ' থেকে এক হাজার টাকা। দেশে উৎপাদিত সরকারি কোম্পানির এলপিজির নির্ধারিত দাম সিলিন্ডারপ্রতি ৭০০ টাকা। তবে এ দামে বাজারে এলপিজি সিলিন্ডার মেলে না। অভিযোগ রয়েছে, চোরাপথে স্থানীয় বেসরকারি কোম্পানির ডিলারদের কাছে সরকারি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করে দেওয়া হয়। ডিলাররা বেসরকারি কোম্পানির সিলিন্ডারের সঙ্গে মিশিয়ে একই দামে এই এলপি গ্যাস বিক্রি করেন। দামের বিষয়ে জানতে চাইলে যমুনা এলপিজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলায়েত হোসেন  জানান, বর্তমানে এলপিজির যে দাম রয়েছে, সেটা স্ট্যান্ডার্ড। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে হয়তো কিছু কমতে পারে, তা-ও খুব বেশি নয়। তবে সিলিন্ডারের ব্যয় কমানো গেলে গ্রাহক কিছু কম দামে এলপিজি পেতে পারেন। তিনি জানান, সিলিন্ডারের বাল্ক্বের ডিউটি আগে ছিল ১ শতাংশ। এটি বাড়িয়ে এখন ২৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতে সিলিন্ডারপ্রতি ৪৫ টাকা ব্যয় বেড়েছে। তবে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেছেন ভিম্ন কথা। তার মতে, এলপিজির কারখানা বাড়লে প্রতিযোগিতাও বাড়বে। তখন মূল্য আরও কমবে। তিনি অভিযোগ করেন, এলপিজির খুচরা মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। কোম্পানিগুলো একেক দামে ডিলারের কাছে গ্যাস বিক্রি করছে। ডিলাররা ইচ্ছামতো লাভ ধরে গ্রাহক পর্যায়ে তা সরবরাহ করছেন। শামসুল আলম আরও জানান, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে যে দামে এলপি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে তার সঙ্গে কমিশন, ট্যাক্স-কর যোগ করে সিলিন্ডারপ্রতি মূল্য ৬০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। তিনি বলেন, এলপিজি জনপ্রিয় করতে হলে এ খাতের ট্যাক্স-ভ্যাট তুলে নিতে হবে। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ  বলেন, বর্তমানে এলপিজির দাম কমেছে। সামনে আরও কমবে। খুচরা পর্যায়ে বাজার মনিটরে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাজার মনিটরে একটি কমিটি গঠন করা হবে।   বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন পাইপলাইনের গ্যাসের দাম নির্ধারণ করলেও এলপিজির ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে না। তারা ২০০৯ সালে সর্বশেষ সরকারি খাতে উৎপাদিত এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ৭০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বেসরকারি খাতের বিষয়ে সংস্থাটির কোনো ভূমিকা নেই। জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য আজিজ খান  বলেন, এলপিজি কারখানা স্থাপনে লাইসেন্স দিলেও তারা দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনো চিন্তা করছেন না। এটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া রয়েছে। ভারতের চেয়ে দাম বেশি :ভারতের চারটি বড় শহর- দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই ও চেম্নাইয়ের গত মাসের তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, ১৪ দশমিক ২ কেজির একটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাংলাদেশি টাকায় ৬৬৩ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশে সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম নয়শ' থেকে এক হাজার টাকা। ভারতে নিবন্ধিত প্রতিটি পরিবার ভর্তুকিসহ বছরে ১২টি এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে পারে। এলপিজি কোম্পানি বিএম এনার্জির সিইও নুরুল আলম  বলেন, ভারতের মতো ভর্তুকি চালু করলে বাংলাদেশের গ্রাহকও সুলভে এলপি গ্যাস ব্যবহার করতে পারবেন। তবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এলপিজিতে ভর্তুকি দেওয়ার কোনো চিন্তা সরকারের নেই। নতুন কারখানা আসছে না :জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে এলপি গ্যাস আমদানি, সিলিন্ডারজাত ও বিপণনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজে অগগ্রতি না থাকায় ২০টি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা হয়। যারা নতুন লাইসেন্স পেয়েছে, তারাও নানা জটিলতায় সময়মতো উৎপাদনে আসছে না। ২০১৪ সালে লাইসেন্স পাওয়া চট্টগ্রামের একজন উদ্যোক্তা  বলেন, বিভিম্ন ধরনের ছাড়পত্র ও অনুমোদন নেওয়ার জন্য তাকে ২৯টি সরকারি দপ্তরে ঘুরতে হয়েছে। ফলে তিন বছরেও তিনি কারখানা স্থাপন করতে পারেননি।   এলপিজি কোম্পানির একজন সিইও  বলেছেন, সরকারের কিছু নীতির কারণে এলপিজি কারখানা স্থাপনে আগ্রহীরা পিছিয়ে পড়ছেন। নিরাপত্তার জন্য সরকার কারখানার আয়তন বাড়িয়েছে। আগে সেফটি ডিসটেন্স লাগত আট একর, এখন তা করা হয়েছে ২০ একর। এতে কারখানার স্থাপন ব্যয় বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, সিলিন্ডার ব্যয়ও এ খাতে ব্যবসার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সিলিন্ডারপ্রতি এক হাজার ২০০ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক সিলিন্ডার আমদানি করলে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকা খরচ হয়। সেই সিলিন্ডার সর্বোচ্চ এক হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। দীর্ঘ মেয়াদে গ্যাস রিফুয়েলিং করে এ লোকসান পুষিয়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে ৮০ শতাংশ সিলিন্ডার আমদানি করা হয়। সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি এলপিজি লিমিটেড বছরে ২০ হাজার টন এলপিজি সরবরাহ করে। আর দেশি-বিদেশি ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান এলপিজি আমদানি ও বাজারজাত করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- মংলায় রয়েছে বসুন্ধরা, যমুনা, সেনাকল্যাণ সংস্থার সেনা এলপিজি, ওমেরা এলপিজি ও লাঘফস গ্যাস (সাবেক ক্লিনহিট, বিদেশি কোম্পানি); চট্টগ্রামে রয়েছে সুপার গ্যাস (টি কে গ্রুপ), বিএম এনার্জি, প্রিমিয়ার এলপি (সাবেক টোটাল গ্যাস, বিদেশি কোম্পানি), বিন হাবিব; কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ইউনিভার্সেল ইত্যাদি। তা ছাড়া নাভানা, ওরিয়ন, এনার্জিপ্যাক, বেক্সিমকো এ খাতে ব্যবসা করতে এগিয়ে আসছে বলে জানা গেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App