×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার কয়েকটি দিক

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ১০:০৬ পিএম

[caption id="attachment_799" align="alignleft" width="195"] আবুল কাসেম ফজলুল হক[/caption] এক. রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের জরুরি অধিবেশনের যে খবর ২৯/০৯/২০১৭ তারিখে প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তা থেকে জানা গেল যে, রাশিয়া ও চীন দৃঢ়তার সঙ্গে মিয়ানমারের পক্ষ অবলম্বন করেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স অবলম্বন করেছে রোহিঙ্গাদের পক্ষ। রাশিয়া বলেছে যে, আরসা (আরাকান-রাখাইন সেলভেশন আর্মি) রোহিঙ্গাদের দুরবস্থার জন্য দায়ী। এমন কথা মিয়ানমারও বলে আসছে। তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন সমাপ্ত হয়েছে। ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করলে বোঝা যায়, দুর্গত রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে ভারত, চীন ও রাশিয়া রিলিফ সামগ্রী পাঠালেও রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়া এবং নাগরিকত্ব লাভের ব্যাপারে কার্যকর কোনো চেষ্টা করবে না। তারা মিয়ানমার সরকারের মতকেই গুরুত্ব দেবে। বাংলাদেশের ভূভাগে রোহিঙ্গাদের রেখে বাংলাদেশের সরকারকে তাদের খাওয়া-পরা চালিয়ে নিতে হবে। কোনো কোনো রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের জন্য রিলিফ সামগ্রী দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করবে। শেষ পর্যন্ত কী হবে? যারা খুব সহজে স্বল্প সময়ের মধ্যে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান আশা করেছিলেন, তাদের মনঃক্ষুণœ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। কূটনৈতিক আলোচনা চলতে থাকবে। সমাধান কবে হবে কে জানে? ১৯৬২ সালে বার্মায় রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানের কিছু পর থেকেই বার্মার (পরে মিয়ানমারের) সরকার রাখাইন ও আরাকানের মুসলিম জনসাধারণকে অধিকার-বঞ্চিত করে, নাগরিকত্বহীন অবস্থায় বাঙালি বলে পূর্ব পাকিস্তানে (পরে বাংলাদেশে) পাঠিয়ে দেয়ার তৎপরতা চালায়। এ নিয়ে গত অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে নানা ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়েছে। ক্রমে বার্মার পরে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে বিতাড়িত করার কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। বঞ্চিত, দুর্বল, অসহায় রোহিঙ্গারা নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন যাবৎ মিয়ানমার সরকার প্রচার করে আসছে যে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গিবাদী আছে। আইএস, আলকায়েদা প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সংযোগ আছে। সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে আরসাকে। আরসা অবশ্য প্রচার করছে যে, তাদের সঙ্গে আইএস, আলকায়েদা ইত্যাদি কোনো জঙ্গি সংগঠনেরই কোনো যোগাযোগ নেই। তারা আরাকানি ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মানবিক অধিকার চায়। ইতিহাসের দিক দিয়ে দেখতে গেলে আরো অনেক জটিল ব্যাপার সামনে আসবে। গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ঢাকায় বেশ কটি সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু কোনো সরকারই সমস্যাটির গভীরতা ও ব্যাপকতা বুঝতে চেষ্টা করেনি। যদি আরো অন্তত বছর ত্রিশেক আগে থেকে বাংলাদেশ বার্মায় পরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা ও বিশ্বজনমত গঠনের আন্দোলন চালাত রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসের পথে না গিয়ে নিজেদের নাগরিকত্বের জন্য গণতান্ত্রিক উপায়ে দল গঠন করে আন্দোলন করত এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসতে দেয়া না হতো, তাহলে এ অবস্থা সৃষ্টি হতো না। বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আসা এখনো বন্ধ হয়নি। যদি এ পর্যন্ত ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে থাকে, তবে বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই তা এক বড় বোঝা। ক্রমেই বোঝা বাড়ছে। এই বোঝা বাংলাদেশ কীভাবে বহন করবে সেটাই প্রশ্ন। রোহিঙ্গারা দুর্গত। তাদের দুর্দশা অবর্ণনীয়। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশও কি দুর্গতির মধ্যেই পড়ছে না? বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য ও আশ্রয় দেয়ার মধ্যে মহত্ত¡ আছে। যদি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নাগরিকত্ব না পায় আর বাংলাদেশে মানবিক সাহায্য নিয়ে কোনোক্রমে বাঁচতে বাঁচতে মরতে থাকে তাহলে তাতে বাংলাদেশ সরকারের মহত্ত্ব কি ম্লান হয়ে যাবে না? তাদের স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী করা যাবে কীভাবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ যে সমস্যায় পড়েছে বিশ্ববাসী কিন্তু তা বুঝতে পারেনি। মিয়ানমারকে বোকার দেশ ভাবা ঠিক নয়। মিয়ানমারও অবশ্যই কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাইরের দুনিয়াকে বোঝতে তৎপর হয়েছে যে, রোহিঙ্গারা বাঙালি, বাংলাদেশকেই তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। আমার ধারণা ভুল হলে আমি আনন্দিত হব। দুই. বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যাই একমাত্র বড় সমস্যা নয়। এ সমস্যার চেয়েও বড় সমস্যা বাংলাদেশে আছে। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ নেই। সরকার, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিএসও (সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশন) ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রে কমবেশি ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য নিয়ে আছে। যে কোনো বড় সমস্যার সমাধানের জন্য জাতীয় ঐক্য দরকার হয়। জাতীয় অনৈক্য নিয়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সুবিধা করতে পারবে না। রাষ্ট্র হলো জাতির, জনগণের, রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার অভিব্যক্তি। রাষ্ট্রকে অবলম্বন করে সরকারের মাধ্যমে জনগণ নিজেদের সমস্যার সমাধান করে এবং সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে অগ্রসর হয়। এ দেশের জনগণ পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে এই জনগণ আর জাতি থাকতে পারেনি। নানাভাবে বিভক্ত হয়ে তারা জাতীয় চেতনা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দুই দলের নেতারা বছরের পর বছর ধরে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে এবং ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টে গণতন্ত্রের জন্য ধরনা দিতে যায়। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা, শাসক শ্রেণির লোকেরা, বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করছেন এবং তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে নাগরিক করে চলছেন। বাংলাদেশের জনগণের ওপর, বাংলাদেশে রাষ্ট্র গড়ে তোলার ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই। এ সমস্যা রোহিঙ্গা সমস্যার চেয়ে অনেক বড়। বাংলাদেশকে গড়ে উঠতে ও টিকতে হলে কিছু বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। যারা বিদেশে নাগরিকত্ব নিয়েছেন, যাদের স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা ছেলেমেয়ে বিদেশে নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তারা যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, উচ্চ পর্যায়ের বিচারক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে না পারেন তার জন্য সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার চেয়ে এ সমস্যা অনেক বেশি কঠিন। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণিতে নিজেদের জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের কোনো সংকল্প কি আছে? ভোগবাদী মন নিয়ে তারা তো অন্যদের দেশে বাস করতে বেশি আগ্রহী। কথাগুলো অপ্রীতিকর বটে কিন্তু সত্য। [caption id="attachment_797" align="aligncenter" width="700"] বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য ও আশ্রয় দেয়ার মধ্যে মহত্ত্ব আছে। যদি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নাগরিকত্ব না পায় আর বাংলাদেশে মানবিক সাহায্য নিয়ে কোনোক্রমে বাঁচতে বাঁচতে মরতে থাকে তাহলে তাতে বাংলাদেশ সরকারের মহত্ত্ব কি ম্লান হয়ে যাবে না? তাদের স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী করা যাবে কীভাবে।[/caption] গণতন্ত্রকে পরিণত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। গণতন্ত্র সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা পরিহার্য। নতুন ধারণা উদ্ভাবন ও কার্যকর করতে হবে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার সামর্থ্য রাখে না। সিএসও মহল থেকে গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সব দলের অংশগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করার এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার দাবি তোলা হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই। রাজনৈতিক দল ছাড়াই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। নাগরিক আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলন ইত্যাদি কথা প্রচার করা হয়। উন্নত রাজনৈতিক দল ছাড়া বাংলাদেশে রাজনীতির কোনো উন্নতি হবে না। দেশি-বিদেশি বহু শক্তি চেষ্টা করে চলছে যাতে বাংলাদেশে উন্নত চরিত্রের কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে না ওঠে। উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো আগ্রহ ডানপন্থী, মধ্যপন্থী, বামপন্থী কোনো মহলে আছে কি? আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠনের কথা কেউ কেউ বলেন। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা লিখিতভাবে আজো কেউ প্রকাশ করেনি। এটা স্পষ্ট যে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠনের অপচেষ্টা পূর্বশর্ত উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের মাধ্যমে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হবে রাজনৈতিক দলের মাধ্যম। এসব দলের কেউই আলোচনায় আসছেন না। ঘুষ-দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ- সমস্যারূপে আছে। সমাজটা ভেতর থেকে পচে যাচ্ছে। পরিবার অবক্ষয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের পর হত্যা, আত্মহত্যা ইত্যাদি ব্যাপকতা লাভ করছে। নারীবাদীরা আন্দোলন করেছন ক্ষমতায়নের জন্য এবং অনেকে বড় বড় ক্ষমতার আসন লাভ করছেন। তারা ভোগবাদের দিকে যাচ্ছেন। নারী নির্যাতন বন্ধ করা এবং সুস্থ, স্বাভাবিক নারী-পুরুষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। জাতীয় জীবনে কাম-ব্যবস্থাপনা নিয়ে জাতীয় সংসদে গভীর আলোচনা দরকার। ধনী ও গরিবের এবং ক্ষমতাবাদ ও ক্ষমতাহীনদের বৈষম্য বাড়ছে। সমাজের স্তরে স্তরে চলছে জুলুম-জবরদস্তি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর রূপ নিয়ে আছে। যেসব সমস্যার কথা এখানে উল্লেখ করলাম এগুলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে চলছে। শাসক শ্রেণির লোকেরা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। সমাজরক্ষা, জাতিগঠন, রাষ্ট্রগঠন, সভ্যতা-সংস্কৃতি-প্রগতি- এসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। জনগণ উদাসীন, ঘুমন্ত। প্রচার মাধ্যম নতুন কোনা চিন্তার, নতুন কোনো সামাজিক শক্তির উত্থানের প্রতিক‚লে কাজ করে। এই বাস্তবতা পরিবর্তন করতে হবে। তার জন্য উন্নত চরিত্রের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন দরকার। প্রচার মাধ্যম দরকার, রাজনৈতিক দল দরকার। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য সংগঠন দরকার। বাংলাদেশের যোগ্য ব্যক্তিরা বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেন না, বাংলাদেশকে গড়ে তোলার প্রয়োজন বোধ করেন না, তারা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালান, তারা রাজনৈতিক দল গঠনকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নন। প্রচলিত ব্যবস্থার বিশ্বস্ত সমর্থক তারা। প্রগতির বিরোধী তারা। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য এই বাস্তবতার পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তন স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে হবে না, তার জন্য চেষ্টা লাগবে। তরুণ সমাজকে অগ্রযাত্রীর ভুমিকা পালন করতে হবে। আবুল কাসেম ফজলুল হক : রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তক, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App