×

অতি তীব্র তাপপ্রবাহ

গরমে পুড়ছে কৃষি অর্থনীতি

Icon

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গরমে পুড়ছে কৃষি অর্থনীতি
মরিয়ম সেঁজুতি : চলমান তাপদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। এর প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতেও। অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত কৃষি শিল্পেও তাপদাহের ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতেও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, আবহাওয়ার কারণে সরবরাহ সংকট দেখা দিলে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এ অস্বস্তিকর আবহাওয়ায় পণ্য যাতে নষ্ট না হয়; তাতে যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেখানেও যোগ হচ্ছে বাড়তি খরচ। এর প্রভাব বাজারে পড়া খুব স্বাভাবিক। কৃষকরা বলছেন, গরমের কারণে এবার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে এখন মাঠে থাকা বোরো ফসল তাপদাহের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় বাড়তি সেচ দিতে হচ্ছে তাদের। ফলে ফসল উৎপাদনে বেড়ে যাচ্ছে খরচ। কৃষি অর্থনীতিবিদ ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ভোরের কাগজকে বলেন, অতিমাত্রায় গরমে অর্থনীতি অনেকটাই নি¤œগামী হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে কৃষি খাতেও। তিনি বলেন, যারা মাঠে বা জমিতে কাজ করে তারা এই গরমে খুব একটা বের হতে চায় না। এতে একদিকে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে; অপরদিকে দক্ষতা কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের খাদ্যশস্যের মধ্যে বোরো ধান হচ্ছে সবচেয়ে প্রধান ফসল। ধান তোলার ক্ষেত্রে তীব্র গরম সবকিছুতেই বাধার সৃষ্টি করছে। বিলম্বিত বোরো ধানে এখনো পানি সেচের দরকার হচ্ছে। কিন্তু পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে পানি ঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোডশেডিং। এতে ফসল উৎপাদনের খরচও অনেক বেড়ে গেছে। গরমে শাক-সবজির শুকিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন আম, লিচু, কাঁঠালের সময়। পানি সরবরাহ সঠিকভাবে না থাকায় এসব ফল উৎপাদনে বাধা পাচ্ছে। আমগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, হলুদ রং ধারণ করছে এবং অপরিপক্ব অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে। একই পরিস্থিতি লিচু এবং কাঁঠালের ক্ষেত্রেও। অতি গরমে প্রাণিজ কৃষিরও ক্ষতি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে এবং খুব গরম হয়ে যাচ্ছে। এতে মাছের ক্ষেত্রে ক্ষতি হচ্ছে। গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি গরম আবহাওয়াজনিত কারণে মারা যাচ্ছে। এমনকি উৎপাদন সক্ষমতাও হারাচ্ছে। দেশে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪২ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে। কোথাও কোথাও ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। তবে গরম অনুভূত হচ্ছে আরো বেশি। এমন তীব্র তাপদাহের প্রভাব পড়ছে কৃষি উৎপাদনে। পুড়ছে ফসলের মাঠ। ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ধানের জন্য অসহনীয়। এদিকে বৈশাখ মাস শেষ হতে চললেও বৃষ্টির দেখা নেই। প্রখর এই খরতাপে কৃষকের ফসল পুড়ে হচ্ছে নষ্ট। পাশাপাশি বিদ্যুতের সীমাহীন লোডশেডিংয়ে বিঘিœত হচ্ছে ইরি-বোরো ধানক্ষেতের পানি সেচ। এতে পুড়ে যাচ্ছে ভুট্টা, গম, বাদামসহ বিভিন্ন জেলার চরাঞ্চলের ফসলের ক্ষেত। যা সার্বিক ধান উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় অন্তরায়! এই অতি তাপদাহে ধান ছাড়াও আম, কাঁঠাল, লিচু ও তুলাসহ অন্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ভুট্টা ও সয়াবিন উৎপাদনেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বলছে, বোরো ধানের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমে এসেছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর ভোরের কাগজকে বলেন, শঙ্কা আছে, অস্বস্তি, ভয়- সবকিছু আছে। তবে আমরা আশাবাদি উচ্চতাপের ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো। তিনি বলেন, হাওরের ধান প্রায় কাটা হয়ে গেছে। খুলনা, সাতক্ষীরা বাগেহাট- এসব এলাকার ধান প্রায় কাটা শেষ। এসব এলাকায় কোনো সমস্যা নেই। মধ্যাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে একটু দেরি হচ্ছে, সেখানে কিছুটা ভয় ছিল। তবে এখন পর্যন্ত ক্ষতির কোনো তথ্য পাইনি। আমাদের বিজ্ঞানীরা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি আরো বলেন, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড় পর্যন্ত পুরো অঞ্চল নিয়ে একটু ভয় আছে। এখানে কেউ আলু চাষ করছে, কেউ সবজি করেছে। এজন্য বোরো ধানের ফসল একটু দেরিতে ফলানো হয়েছে। তাপদাহ থেকে আমরা হয়তো বেঁচে যেতে পারব। কিন্তু এই মুহূর্তে আশঙ্কা করছি, টর্নেডো বা শিলাবৃষ্টি হলে আমাদের ফসলের ক্ষতি বেশি হবে। তথ্য বলছে, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে খরার আশঙ্কা বাড়ে। তখন সমস্যা দ্বিগুণ হয়। অর্থনীতির ওপর উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব নিয়ে গবেষক ইরিনা ইভানোভা একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এর শিরোনাম ‘দ্য ডিভাসটেটিং ইকোনমিক টোল অব সিভিয়ার হিট ওয়েভস’ (২০ জুলাই, ২০২২ প্রকাশিত)। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ইউরোপের প্রায় অর্ধেক অংশ বর্তমানে খরার ঝুঁকিতে আছে। ফলে খাদ্য ঘাটতি হতে পারে বলে ইউরোপীয় কমিশন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। একটি গবেষণার বরাত দিয়ে ইরিনা ইভানোভা জানান, অত্যধিক তাপমাত্রা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে প্রতি ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা বাড়লে একটি দেশের জিডিপি দশমিক ২৫ শতাংশ কমে যায়। জানা গেছে, বাড়তি সেচে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। এ অবস্থায় ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে কৃষকের। এরই মধ্যে অসহনীয় লোডশেডিং জনজীবনে বাড়িয়েছে দুর্ভোগের মাত্রা। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গ্রামগঞ্জ ও শহরের জনজীবন। বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যেও এসব চিত্র উঠে এসছে। কৃষকরা বলছেন, এপ্রিলের তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে ফলনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। চলতি মৌসুমে উচ্চ ফলন ও দাম ভালো পাওয়ার আশা ছিল তাদের। কিন্তু তীব্র তাপদাহের কারণে লাভের পরিবর্তে লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন তারা। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও ফসল রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। ভুট্টা, মরিচ, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল মাঠেই নষ্ট হচ্ছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তীব্র তাপদাহ ও খরতাপে কৃষকের ফসল পুড়ে নষ্ট হচ্ছে। আর কদিন পরেই পুষ্টিকর খাবার বাদাম চরাঞ্চলের কৃষকদের ঘরে তোলার কথা। কিন্তু তীব্র খরায় বা প্রখর রৌদ্রে চরাঞ্চলের বাদাম ক্ষেতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। সেচ দিয়েও খুব একটা কাজে আসছে না। একই অবস্থা সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের ক্ষেত্রেও। বীজ বপন করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন কৃষকরা। সেচ দিয়েও খুব একটা কাজে আসছে না। স্যালো ইঞ্জিন দিয়ে সেচ দিতে না দিতেই তীব্র খরায় শুকিয়ে যাচ্ছে ক্ষেত। এতে বাড়ছে কৃষকের উৎপাদন খরচ। প্রকৃতির বিরূপতায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ। বৈরী আবহাওয়ার পরিবর্তন না হলে কৃষিতে বিপর্যয় ঘটবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরকম অবস্থায় বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিদ্যুতের লোডশেডিং কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ ২৪ ঘণ্টায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা থাকছে। বরিশালের উজিরপুরের কৃষক কাবিল হোসেন বলেন, আগে ক্ষেতে টানা ১০ ঘণ্টা কাজ করতাম। এখন ২-৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করাই যাচ্ছে না। টাকা বাড়িয়েও ক্ষেতকামলা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ধানের আগা শুকিয়ে যাওয়ায় চিটা ধানের পরিমাণ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু ধান নয়, তাপদাহের প্রভাব পড়েছে সবজিক্ষেতেও। ঝালকাঠির কৃষক আমিনুল হক বলেন, রোদ্দুরে শসা ও টমেটো শুকিয়ে যাচ্ছে। বেগুনে পোকা বেড়েছে। সেচ দিয়েও আর্দ্রতা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। আবার দফায় দফায় লোডশেডিং সেচকাজে বাধার সৃষ্টি করছে। আম-লিচুর বাগানেও পড়েছে তাপদাহের নেতিবাচক প্রভাব। নওগাঁর সাপাহারের ফলচাষি সোহেল রানা বলেন, শুরু থেকেই এবার আমের ফলন কম। সেচের পানি দিয়ে কোনোরকমে গাছের ফল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও এখন যে পরিমাণে গরম পড়েছে; তাতে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। কোনোভাবেই গুটি ঝরা ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। একই অবস্থা লিচুতেও। তিনি বলেন, প্রখর রোদে লিচুবাগানে এক রকমের খরা দেখা দিয়েছে। সেচ দিয়েও গাছের আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। তীব্র তাপে লিচু ফুলের শীষ শুকিয়ে যাচ্ছে, পচন ধরছে ফলের গুটিতে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App