জুয়েল আশরাফ
বিয়ের রাতেই নতুন বউ জানালো, সে অন্তঃসত্ত্বা। আমি স্বামী। সংবাদটা আমাকে বিচলিত করবে এটাই স্বাভাবিক। প্রথমে ঝিম মেরে বসে থাকলাম। মধুময় একটা রাত। এমন রাত জীবনে একবারই আসে। আমার বিয়ের রাতে মধুর চিত্র পাল্টে এরকম গøানি বয়ে আনবে কল্পনাও করিনি। একবার মনে হলো বিছানার চাদর আর একটা বালিশ নিয়ে ছাদের ওপর চলে যাই। আবার মনে এলো বউকেই ঘর থেকে বের করে দিই। ভেবে দেখলাম, নতুন বউয়ের সঙ্গে এরকম হালকা আচরণ একেবারেই বেমানান। আমাকে জটিল কিছু করতে হবে। এমন জটিল যে, বিয়েবাড়িটাকে নরকে পরিণত করে ছাড়ব।
বউ খুব স্বাভাবিক এবং সহজ ভঙিতে বলল, ছয় মাস চলছে। ডাক্তার আমাকে ভারী জিনিস উঠাতে নিষেধ করেছে।
আমি কী বলব, আমার কী বলা উচিত, কী করা উচিত- মাথাতে আসছে না কিছুই। টের পেলাম আমার বুকের ভেতরেই নরক হতে যাচ্ছে।
– আমাকে সঙ্গে করে যেই ব্যাগটা দেয়া হয়েছে কষ্ট করে একটু যদি বিছানায় উঠিয়ে দিতেন। আমার প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে ব্যাগে।
আমি রেগেই কিনা, মেঝের ওপর রাখা ব্যাগটাকে তুলে নিয়ে বিছানার ওপর আছড়ে ফেললাম। লক্ষ করলাম বউ বিন্দুমাত্র চমকে উঠল না। বরং আগের চেয়ে আরো স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি আপনাকে কোনোদিনই সুখী করতে পারব না। এটা আমার ভাগ্য। আমি এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। বিয়েটা কীভাবে হয়ে গেল আপনি সবই জানেন।
এই পর্যন্ত বলেই বউ নিজের ব্যাগ খুলে জিনিসপত্রে মন দিল। আমার সব জানা আছে কি-না, এটা জানার জন্যও বউ আমার দিকে তাকাল না। আসলে আমি কিছুই জানি না। আমি দুবাই থাকি। বিয়ের জন্য দেশে এসেছি তিন মাসের ছুটিতে। আমার বাবা-মা নেই। বড় বোন আছে দুজন। বড় আপা আর দুলাভাই দায়িত্ব নিয়েই আমাকে বিয়ে করিয়েছেন। মেয়েকে আগেই দেখে রেখেছিলেন। আমি দেশে এসে মেয়ে দেখে পছন্দ করলেই বিয়ে চূড়ান্ত। মেয়েকে আমি দেখেছি, এমন রূপবতী মেয়ে মফস্বলে খুব কমই দেখা যায়। মেয়ের রূপ দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম। দেশে আসার ছয় দিনের ভেতরেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। এবং ছয় দিনের দিন বিয়ের প্রথম রাতেই আবিষ্কার করলাম বিয়ে বিষয়টা কত ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার।
– আপনি একটু বাইরে বের হতেন যদি! আমি পরনের কাপড়টা পাল্টাব।
না বললেও এমনিতেই এখনই আমি বের হতাম। বাসর ঘরটা একটা দণ্ডিত নরক ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।
বড় আপা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। ঘরোয়া বিয়ে। ঘনিষ্ঠ লোকজন ছাড়া আত্মীয়দের বলা হয়নি।
আমি বললাম- আপা তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে। একটু বাইরে আয়।
আপার হাত টেনে ছাদে নিয়ে এলাম।
– একি রে! তুই কাঁদছিস কেন?
– আমি তো তোরই মায়ের পেটের ভাই। আমার এত বড় সর্বনাশ কেন করলি তোরা?
– কিসের সর্বনাশ? কি বলছিস?
– জেনেশুনে একটা প্রেগন্যান্ট মেয়ের সঙ্গে কেন বিয়ে দিলি তোরা?
– আহা আস্তে বল। কেউ শুনবে।
– এই মেয়ের ছয় মাসের বাচ্চা পেটে। এত বড় ঘটনা লোকেরা তো জানবেই। আমার কাছে কেন আড়াল করলি? কেন বিয়ে দিলি একটা নষ্টা মেয়ের সঙ্গে?
– বেলাল! ভাই চুপ কর। এই মেয়ে নষ্টা না। মেয়েটার স্বামী রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। বড় ভালো মেয়ে। তোরও অনেক বয়স হয়েছে। এমন ভালো আর সুন্দর মেয়ে কপালে জুটেছে শুকরিয়া কর ভাই।
– আমার জীবনটাকে নিয়ে তুই এরকম খেলবি? সত্যি করে বল মেয়েপক্ষ থেকে তোরা কত টাকা খেয়েছিস?
– ছি! কি যা তা বলছিস? মানছি একটা ব্যাপার তোর কাছে গোপন করেছি। তাই বলে আমাদের এত নীচ ভাববি!
– তোর মতন বোনের সঙ্গে কথা বলা বৃথা। যে বোন আপন ভাইয়ের এত বড় সর্বনাশ করতে পারে; এমন বোনের সঙ্গে আমি কোনোদিন সম্পর্ক রাখব না।
এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকব না। ঘরে এসে দেখি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটি জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়েছে। আমার কাপড়গুলো ব্যাগে ভরে দ্রুত ঘর থেকে বের হলাম। বড় দুলাভাই আমাকে বোঝাতে এসে ধমক খেয়ে ফিরে গেলেন। গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শুধু শুনলাম আপাকে বকতে বকতে বলছেন- আমি আগেই বলেছিলাম বেলালকে সব জানিয়ে বিয়েটা দাও। এরকম যে একটা অঘটন হবে জানা কথা।
ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসল বেলাল। বাইরে ভোরের আলো। ঘুমের ভেতর কী সব অসংলগ্ন স্বপ্ন দেখল সে। বিয়ের দিন এরকম স্বপ্ন! পরিবেশটা ভয়ানক বাজে আর নোংরা লাগছে।
বালিশের পাশে মোবাইল ফোনটা বিশ্রী শব্দে বেজে উঠল। বড় আপার ফোন। রিসিভ করতেই ওপাশে বড় আপার উত্তেজিত গলা- বেলাল! একটা খারাপ খবর আছে। যেই মেয়েটির সঙ্গে আজ তোর বিয়ে মেয়েটি রাতে মারা গেছে। বেলাল… হ্যালো… হ্যালো…।
:: নবাবগঞ্জ, ঢাকা