তাকে কবি করেছে…
সারওয়ার-উল-ইসলাম
ছড়ার ছন্দ যতই তালে তালে নাচুক না কেন তার কলমে, কিশোর কবিতাই ধরা দেয় যথাযথভাবে। আপাদমস্তক তিনি একজন কিশোর কবি। তার মানে এই নয় যে ছড়ায় সিদ্ধহস্ত নন। পুরো মুন্সিয়ানা জানেন প্রকৃত ছড়া লেখার।
শৈশব-কৈশোরের বেড়ে ওঠা গ্রাম তাকে কবি করেছে, একটা দোয়েল তাকে কবি করেছে, প্রজাপতি তাকে কবি করেছে, পাহাড় তাকে কবি করেছে, নদী-বৃষ্টি তাকে কবি করেছে। সবুজ প্রকৃতি তাকে কবি করেছে- তাই তো লিখে যান-
‘আকাশ জুড়ে কান্না বুঝি বৃষ্টি ঝাপুর ঝুপুর
বনহিজলের পাতায় পাতায় বাজছে যেন নূপুর
ঝুপ করে সঁাঁঝ নামল বুঝি কাকের পিঠের মতো
ওইদিকে মা খোকনকে তার ডাকছে অবিরত।’
[রোদ-বৃষ্টির খেলা]
‘বনহিজল’ শব্দটায় কি এক মায়া! কি এক ব্যঞ্জনা মূর্ত হয়ে ওঠে। আবার লেখেন
‘রেলগাড়ি ছুটে ছুটে যায় ঝিকঝিক
চোখ যায় দিগন্তরেখা অবধি
গ্রামের সীমানা দিয়ে জল চিকচিক
বহুদূর বরাবর বইছে নদী।’
[রেলগাড়ি]
এ দৃশ্য আমাদের খুবই পরিচিত। এ দৃশ্য বহু আগে এঁকেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পথের পাঁচালি উপন্যাসে। অপু দুর্গার কথাই মনে করিয়ে দেয়। সেই যে কাশের বনের পাশ দিয়ে কালো ধোঁয়া ছেড়ে চলে যাওয়া রেলগাড়ি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। কাল থেকে কালান্তরের এই আবহমান বাংলার চিরচেনা প্রকৃতির কথাই বলে গেছেন কবি-সাহিত্যিকরা।
শিশুসাহিত্যিক রহীম শাহ বলাটাই বেশি প্রাসঙ্গিক। ছোটদের জন্য লিখছেন চার যুগ ধরে। সম্প্রতি বেরিয়েছে তার কিশোর কবিতার সংকলন ‘ছোটোদের কবিতা’। দরদ মাখা ভাষায় লেখা কবিতাগুলোর প্রতিটি শব্দের গাঁথুনিতে রয়েছে পরিকল্পনার ছাপ। শুধু ছন্দ ও মিলের জন্য শব্দের মালা গাঁথেননি। ছোটদের স্বপ্নের জগতটাকে চেনেন নিজের আপন আলোয়। সেখানে রূপকথার গন্ধ রয়েছে যেমন, আছে একাত্তরের আমাদের সেই সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধারাও। তাই লেখেন-
‘আমার মাটি শ্যামল মাটি
সোনার চেয়ে খাঁটি
এই মাটিতে কারা করে
উৎপীড়নের ঘাঁটি।
খোকা ধরে গান
জলদি লাঠি আন।
লাঠির মুখে আগুন দিতেই
পথ হয়েছে চেনা
খোকার ভয়ে যায় পালিয়ে
পাকিস্তানের সেনা।’
[খোকার ভয়ে]
যে কবিতাটি ‘ছোটদের কবিতা’ গ্রন্থটিকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছে সেটা হচ্ছে ‘তিনি আসছেন’।
‘আকাশ বলছে, তিনি আসছেন, বাতাস বলছে, তা-ই
পাখিরা বলছে, তিনি আসছেন-চলো না সেখানে যাই।
তিনি আসছেন-তাই ঈশ্বর নতুন পৃথিবী আঁকে
পৃথিবীর যত সৃষ্টিরা এসে শুভেচ্ছা দেয় তাঁকে।
চারদিকে দেখি কিশোর যুবক নারী-পুরুষের বন্যা
তিনি আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবের কন্যা।
[তিনি আসছেন]
একজন রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে এ ধরনের কবিতা খুবই কম লেখা হয়েছে। কবিতাটি পড়লে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার পরবর্তী সময়ের ছবিও ভেসে ওঠে। যখন এদেশে বঙ্গবন্ধু নামটা উচ্চারণ করতে মানুষ ভয় পেতেন। সেই সময় তিনি দেশে ফিরে এসে পিতার রেখে যাওয়া সোনার বাংলাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিলেন।
রহীম শাহ লিখেছেন-
যখন এদেশে ঘাতকের দল উল্লাসে মাতোয়ারা
যখন এদেশে সকল মানুষ হয় স্বাধীনতা হারা
তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের পাশে আছি
জন অরণ্যে প্রতিটি মানুষ এসে যান কাছাকাছি।
[তিনি আসছেন]
মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রতিটি চরণ কি এক মায়ায় ভরা।
ছোটদের কবিতা গ্রন্থটি শিশু-কিশোর সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন সন্দেহ নেই। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন দেশবরেণ্য কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। তার কাছ থেকেই ধার করে বলতে দ্বিধা নেই- রহীম শাহ কথার ফেরিঅলা, ছবির পর ছবি আঁকে, থামে না তার ছলাকলা। নীল হরিণীর দেশে গিয়ে স্বাধীনতা চায়, তারপর এক সবুজ দেশের স্বপ্নকুমার হয়ে যায়।
ধ্রæব এষের চমৎকার প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে বইটি প্রকাশ করেছে আদিগন্ত প্রকাশন। কিশোর বন্ধুদের জন্য সুখপাঠ্য গ্রন্থটি ফেসবুকে ডুবে থাকা প্রজন্মের হাতে পৌঁছে যাক- সেই প্রত্যাশা।