আন্দালিব রাশদী
ধারাবাহিক উপন্যাস : পর্ব ৫
[গতসংখ্যার পর]
আমি চিনি না, আব্বুর কোনো বন্ধুর ছেলে। ব্যারিস্টার হতে লন্ডন যাচ্ছে।
তাহলে তো ভালো পাত্র।
এর চেয়ে হাজার গুণ ভালো হলেও আমি বিয়ে করব না। আমি আব্বুর কাউকে বিয়ে করব না। আব্বু আমাকে শিক্ষা দেবার জন্য বিয়ে দেবে, আমার অনেক শিক্ষা হয়েছে, আর শিখতে চাই না। আব্বু বলেছে, আপনি তাকে বলেছেন আমি নাকি ডিফারেন্ট ক্যারিয়ার চাচ্ছি। আব্বু ডিফারেন্ট ক্যারিয়ার চাওয়ার শিক্ষা দিতেই বিয়ের ব্যবস্থা করেছে।
এটা মিথ্যে নয় ঋতু সম্পর্কে কোনো কটু কথা না বলতে চেয়ে আমি ডিফারেন্ট ক্যারিয়ারের কথা বলেছি। আমি তবুও শিক্ষকের মতো বললাম, বাবার মারা সব সময়ই সন্তানের ভালোটাই চান।
আমার ভালোকিছুর দরকার নেই, ঋতু বারবার এই কথাটা বলতে থাকে এবং হঠাৎ অঝোর কান্না শুরু করে দেয়। তার কান্নার জন্য আমিই দায়ী এরকম একটা ধারণা যাতে রানুর মনে না আসে সে জন্য আমি দরজা খুলে তাকে ডাকি এবং বলি পাগলিটাকে সামলাও।
রানু আসতেই সে তাকে বলল, স্যারকে বলুন, এখনই যাতে গলা টিপে আমাকে মেরে ফেলে।
তার হাবভাব দেখে রানু বলে, মেয়েটা কিন্তু কিছুক্ষণ পর অজ্ঞান হয়ে যাবে। একটা কম্পাউন্ডার ডেকে এনে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখো, ভালো ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঋতু অজ্ঞান হয়নি। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বলল, আমি খুব হাংরি, সকাল থেকে কিছু খাইনি।
রানুবু বলল, তাহলে হাতমুখ ধোও। খাবার দিচ্ছি।
ডাল-ভাত সাধারণ খাবার দেবেন।
সাধারণই, আমাদের রাতের সাধারণ খাবার।
খাবার পর ধোয়ামোছা নিয়ে রানু আড়াল হয়ে যায়, কিংবা সামনে কোনো কাজ থাকলেও এগিয়ে আসেনি।
আমি বললাম, যদি তোমার বাবা রাতেই পুলিশসহ হাজির হন? আব্বু কেমন করে জানবে আমি এখানে?
রাত প্রায় একটা। আমি অনেকটা জোর করেই তাকে আমার বাবার বিছানায় পাঠিয়ে দিই এবং বলি ভেতর থেকে লক করে থাকবে।
একাধিকবার বলেছে, স্যার, আমি আপনার সাথে ঘুমোবো।
আমি যখন দৃঢ়স্বরে বলি প্রশ্নই আসে না, তখন বলল, তাহলে ফ্লোরে ঘুমাবো। বাধ্য হয়ে বাবার ঘরে ঢোকার সময় আমাকে বলল, একবার বুকে হাত দিয়ে বলেন তো আমি আপনার সাথে ঘুমাই- এটা আপনি চান না।
রাত তিনটার দিকে ঋতু বাবার রুম থেকে বেরিয়ে আমার দরজায় টোকা দেয় এবং ডোরলক ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। জিজ্ঞেস করে, স্যার আপনি ঘুমোননি? আমার ঘুম আসছে না। এখানেই ঘুমোবো, নিজেই সুইচ অন করে আমার পাশে বালিশহীন তোষক ও চাদরের উপর শুয়ে পড়ে এবং মিনিট কয়েকের মধ্যে আমি নিশ্চিত হই ঋতু ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি জানি যে অস্বস্তিকর কাজটি আমাকে করতে হচ্ছে তার নাম দমন। আমি আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দমন করি। আমার হাই উঠে, আমি একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।
ভোরের দিকে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে যায়, আমি ঋতুকে পাশ কাটিয়ে বাবার ঘরে চলে আসি। বাকি ঘুমটুকু এখানেই হোক, রানু দেখুক আমি একজন মেয়ে মানুষের সাথে ঘুমাইনি।
আমি যখন সাড়ে আটটার প্রথম ক্লাস ধরার জন্য পৌনে আটটার মধ্যে বেরিয়ে যাই, ঋতু তখনো ঘুমে। আমি রানুকে বলি তুমি মেয়েটাকে ভালো করে বোঝাও যাতে বাবা-মার কাছে ফিরে যায়।
সেদিন আমার ক্লাস শেষ হয় আড়াইটায়, ফিরে এসে দেখি রানুর পুরোনো শাড়ি পরে ঋতু এই বাসার একজন স্থায়ী সদস্যের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি ঢুকতেই জিজ্ঞেস করে, আপনি কি পুলিশকে খবর দিয়ে এসেছেন?
আমি বলি, এখনো দিইনি। কিন্তু দেব। আমি কখনোই নারী অপহরণ মামলার আসামি হতে চাইব না।
ভয়ঙ্কর হুমকি দেয় ঋতু। এ বাড়ি থেকে জীবিত অবস্থায় আমাকে বের করতে পারবেন না। যদি বের হতেই হয় আমার লাশ বের হবে।
আমি আবার বের হই। বোরোবার সময় ঋতু বলে দেয়, আমার জন্য সস্তা দরের একজোড়া ম্যাক্সি আর একটা টুথব্রাশ নিয়ে আসবেন।
আমি পৌনে ছ’টার দিকে ঋতুর বাবার অফিসে পৌঁছি। তিনি তখনই বেরোচ্ছিলেন। তিনি আমাকে বসিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনিও খবর পেয়ে গেছেন? হারামজাদি আমার নাক-কান কেটে বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে!
বিয়ের আসর থেকে?
ঠিক বিয়ের আসর নয়। পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল, অন দ্য স্পট বিয়ে হয়ে যাবার কথা।
ঋতু কি সেখান থেকে পালিয়েছে?
না, ম্যাডোনা বিউটি পার্লার থেকে।
সাথে কেউ ছিল না?
ছিল আমার ছোট ভাইয়ের বউ, আর ভাগ্নি।
আপনি পুলিশকে বলেছেন?
হারামজাদির আঠার হয়ে গেছে। কিছু করতে গেলে আমি ফেঁসে যাব। পুলিশকে বললে মান সম্মান থাকবে না।
আমি বললাম, আমার কাছে ঋতুর খবর আছে।
বেশ তাহলে তাকে জানিয়ে দেন, আমার মৃত্যুর আগে সে যেন আমার বাড়িতে না ঢোকে।
এটা তো বাবার কথা হলো না।
রাখেন আপনার বাবার কথা।
ঋতুর মা হয়তো দুশ্চিন্তা করবেন।
দুশ্চিন্তা করবেন না, বয়স যখন সাড়ে ষোলো তখন আরো একবার ভেগেছিল।
আমি কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে যাই।
আমি খানিকটা বাসে, খানিকটা পায়ে হেঁটে ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেট ও গাউছিয়াতে আসি, ম্যাক্সি কিনি, অনুমানের উপর ভিত্তি করে দু’সেট থ্রিপিস, নিউমার্কেট ফুট ওভারব্রিজের নিচ থেকে এক জোড়া স্যান্ডেল, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ কিনে রওয়ানা হই। বাসার কাছাকাছি এসে মনে হয় কি যেন কেনা হয়নি। আমি আরো তিনশ মিটার পিছিয়ে এসে ঔষধের দোকানে ঢুকি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আঙ্গুলে ইশারা করে বলি, ওটা দিন এক প্যাকেট।
ঋতুর জন্য আমার কেনাকাটার মধ্যে আরো একটি আইটেম-স্যানিটারি ন্যাপকিন যোগ হয়।
কলিং বেল টিপি। রানু দরজা খোলেনি, খুলেছে ঋতু। আমি তার হাতে ব্যাগটা তুলে দিই।
আমার রুমে এসে অবাক হই। পূর্ব-পশ্চিমে রাস্তাঘাট চলে গেছে উত্তর-দক্ষিণে একেবারে দেয়াল ঘেঁষা কাঠের আলমারিটা খাট আর দেয়ালের মাঝখানে, টেবিল-চেয়ার আরেক প্রান্তে। আলমাটির আড়ালে ঢাকা পড়া জানালা খুলে গেছে, রুমের ভেতর প্রচুর স্পেস। এই স্পেস এতোদিন কোথায় ছিল?
রানু এসে বললো, মেয়েটার শরীরে অসুরের শক্তি। খাট, আলমারি একাই সরিয়েছে।
আমি ও ঋতু খেতে বসি।
সাধারণ খাবারই, মাছ, ডাল, ঢেঁরস ভাজি, দুটো ডিম মামলেটও আছে।
একটা ডিম মামলেট আর ডালে আমার খাবার হয়ে যায়।
ঋতু বলে ডিম আমারও প্রিয়।
খেতে খেতে ঋতু বলে, স্যার আপনি অনেক কেয়ারিং।
মানে?
আপনি কেমন করে জানলেন যে ওটা আমার লাগবে? ওটার কথা আমি কেমন করে বলব বুঝতে পারছিলাম না।
ঋতুর কাছে হালকা হয়ে যাবার ভয়ে আমি একটি কথাও বললাম না। ঋতু বলল স্যার আমি কিন্তু আপনার বিছানাতেই ঘুমোবো, আপনার যেখানে ইচ্ছে ঘুমোতে পারেন। বাবার ঘরটাই ভালো, কিন্তু ভেতর থেকে নক করে দেবেন, নতুবা যে কোনো সময় আমি ঢুকে আপনাকে জাপটে ধরতে পারি।
আমি নিশ্চুপ থাকি।
আমি বাবার ঘরে শুয়ে পড়ি। রাত দেড়টা কি দুটোর দিকে আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দরজা ঠেলে আমার ঘরে ঢুকি। আলো জ¦লছে। শুয়ে, কিন্তু পিটপিট করে তাকিয়ে আছে ঋতু। আমি বলি, ঘুমোওনি?
না, আমার ঘুম আসছে না, আর দশ মিনিট অপেক্ষা করে আমি আপনার রুমেই যেতাম।
আমারও ঘুম আসছিল না।
ঋতু বলে, ঘুম না আসারই কথা।
বাতি নিভিয়ে দিই। আলমারি সরে যাওয়ায় যে জানালাটি বেরিয়ে এসেছে তার উপর দিক দিয়ে খানিকটা আলো আসছে।
আমি ঋতুর পাশে শুয়ে পড়ি।
একটা হাত বাড়িয়ে দিই তার শরীরের উপর। বিদ্যুতস্পৃষ্ট মানুষ যেমন তারে লেগে থাকে মুহূর্তের ছোঁয়া ঋতুকে এতোটাই বিদ্যুয়ায়িত করল যে প্রায় গোটা শরীরটা নিয়ে আমার সাথে লেপ্টে গেল; আমরা দু’জন তখন এক বালিসে।
ঋতু ফিসফিস করে বলে, স্যার, আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?
আমি ঋতুকে শরীরের সাথে আরো মিলিয়ে বললাম, করব।
ঋতু বলল, স্যার সত্যি?
আমি বললাম, সত্যি।
ঋতু বলল, আমাকে ছুঁয়ে বলেন।
তোমাকে ছুঁয়েই তো আছি।
এভাবে নয়, হাতটা দিন।
ঋতু আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে তার জামা উচিয়ে নাভি বরাবর পেটে রেখে বলল, এবার বলুন, সত্যি?
সত্যি।
ঋতু বলল, এখানে বাবু হবে। আপনি আমাকে ও বাবুকে ছুঁয়ে বলেছেন, বিয়ে করবেন।
বলেছি তো, আমি বাবুর বাবা হবো।
ঋতু বলল, আমি মা।
সে রাতে যখন আমাদের হাই উঠে তখন সেই জানালা দিয়ে সকালের আলো ঢুকছে।
পরদিন শুক্রবার। ছুটি। ঋতু বলল, আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবেন?
চিড়িয়াখানায়? বাচ্চারা চিড়িয়াখানায় যায়। অন্য একদিন যাব। আজ চলো শুয়েই থাকি।
আচ্ছা।
(ছয়)
অবন্তী পরের শুক্রবার শবনমের সাথে মিরপুর চিড়িয়াখানা ঘুরে এসে জিরাফ, জেব্রা, বানর ও কুমিরের কথা তার রানু ফুপুকে শোনালো। ফ্যান্টাসি কিংডম থেকে ফেরার সময় অবন্তী ঘুমিয়ে পড়েছিল। শবনম ঘুমন্ত অবন্তীকে তার বিছানায় শুইয়ে ফিরে যায়। আমি তখনও বাসায় ছিলাম না। এখনও না।
আমি ফেরার পর ভেবেছি এখনই ছুটে এসে অবন্তী বাঘ-ভাল্লুকের গল্প বলতে শুরু করবে।
কিন্তু তা না করে আমি বাইরের কাপড় ছেড়ে ঘরের মানুষ হিসেবে সোফায় এসে বসার পর অবন্তী আমার পাশে একেবারে গা ঘেঁষে বসল। আমি তখনো চুপ, অবন্তীই আলোচনার সূত্রপাত করুক।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে অবন্তী বলল, তুমি কি এখন চা খাবে?
আমি বললাম, পরে খাব।
অবন্তী জিজ্ঞেস করল, বাবা তোমার মুড ভালো?
কেন?
মুড ভালো থাকলে একটা কঠিন প্রশ্ন করব।
করো।
অবন্তী প্রশ্ন করল, বাবা স্মরণীয় দিন মানে কি?
কেন?
আন্টি বলেছে আজকের দিনটা তার স্মরণীয় দিন।
এবার আমি বললাম, মানেটা হচ্ছে- যে দিনটার কথা মানুষ ভোলে না। স্মরণ মানে মনে রাখা- যে দিনের কথা সবসময় মনে থাকে।
তাহলে বাবা তুমি আন্টিকে বলে দিয়ো আজকের দিনটা আমারও স্মরণীয় দিন।
কেন? বাঘ হাতি গণ্ডার, বান্দর এসব দেখেছো, সেজন্য?
শোনো বাবা, ওটা বান্দর নয়, বানর। বাঘ হাতি আর গণ্ডারের জন্য নয় বাবা, আন্টি বলেছে একবার যদি কেউ তাকে মা ডাকে তাহলে সেদিনটাই হবে স্মরণীয় দিন।
এটা শুনে আমি তিনবার তাকে বলেছি মা, মা, মা। আর তখন আন্টি আমাকে কোলে নিয়ে একটা চুমো দিয়েছে।
সত্যি নাকি?
অবন্তী বলল, শতভাগ সত্যি।
(চলবে)