×

জাতীয়

দণ্ড মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ৩৩ যুদ্ধাপরাধী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০১৯, ০১:১৮ পিএম

দণ্ড মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ৩৩ যুদ্ধাপরাধী
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বেশির ভাগ আসামিই পলাতক রয়েছে। ক্রমশ এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে ৭ জনের বিদেশে থাকার তথ্য থাকলেও বাকিরা কোথায় আছে সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। চিহ্নিত, দণ্ডপ্রাপ্ত এসব যুদ্ধাপরাধীকে ধরতে ট্রাইব্যুনাল থেকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসনকে বারবার নির্দেশনা দেয়া সত্ত্বেও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। এ অবস্থায় আসামি গ্রেপ্তারে সফলতা না থাকায় স্বয়ং ট্রাইব্যুনালও একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন। প্রসিকিউশনের একাধিক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেছেন, পলাতকদের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দিয়েছেন তা কার্যকর হলে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ পলাতকদের গ্রেপ্তারে একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিবেদন জমা দিলেও এখন পর্যন্ত কার্যত বা দৃশ্যত কোনো সুফল আমরা পাইনি। ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টদের মতে, মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিলেও এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো ভ‚মিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইনজ্ঞ নিয়োগ করা, যেটি ওই দেশগুলোর সঙ্গে আইনি জটিলতা নিষ্পত্তি করতে কাজ করবে। এ ছাড়া পলাতকদের ফিরিয়ে দিতে ওই দেশগুলোর সরকারকে রাজি করতে লবিস্ট নিয়োগ করা যেতে পারে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কিছু দিন আগে জানিয়েছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে যারা বিদেশে পলাতক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে ক‚টনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। দেশের ভেতর পালিয়ে থাকা দণ্ডপ্রাপ্তদেরও আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করে রায় কার্যকরের লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। ২০১৫ সালের ১৩ মে পলাতক আসামিদের ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের একটি নির্দেশে মনিটরিং কমিটি গঠন করে পুলিশ। একজন উপমহাপরিদর্শককে (ডিআইজি) প্রধান করে গঠিত ৫ সদস্যের এই কমিটিকে ৪০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। ইতোমধ্যে মনিটরিং কমিটি বেশ কয়েকবার প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা বরাবরই তাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে আসছে ট্রাইব্যুনালের কাছে। জানা যায়, যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের এপ্রিলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এর আগেই পালিয়ে যায় এ যুদ্ধাপরাধী। এ ঘটনায় তোলপাড় হয় সারা দেশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নড়েচড়ে বসে। ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। কিন্তু গত ছয় বছরেও ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এই যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলেও রেড অ্যালার্ট জারি রয়েছে। তবে বাচ্চু রাজাকার ঠিক কোন দেশে আত্মগোপন করে আছে, তা নিশ্চিত নয় কেউ। শুধু বাচ্চু রাজাকারই নয়, তার মতো দণ্ডপ্রাপ্ত আরো ৩২ জন যুদ্ধাপরাধী পালিয়ে আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের দাবিতে সোচ্চার সংগঠন ও মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, দণ্ডপ্রাপ্ত এসব যুদ্ধাপরাধী যতদিন পালিয়ে থাকার সুযোগ পাবে, ততদিনই তারা দেশের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা চালাবে। যে কোনো মূল্যে এদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির দণ্ডিত এসব যুদ্ধাপরাধী গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তদন্ত সংস্থার গাফিলতি রয়েছে, শৈথিল্য রয়েছে। তারা গ্রেপ্তার না হলে দেশে-বিদেশে বসে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখবে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা অপতৎপরতা চালাবে এবং চালাচ্ছেও। পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল (এনসিবি) শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, দণ্ডিত এসব যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে বাচ্চু রাজাকার ছাড়া আরো ৬ জন বিদেশে আত্মগোপনে আছে। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি রয়েছে রেড নোটিস। তবে এখনো ইন্টারপোল থেকে তাদের বিষয়ে তথ্য মেলেনি। বাচ্চু রাজাকার ছাড়া ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি থাকা অন্য ৬ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে রয়েছেন আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মইনুদ্দিন, জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার, সৈয়দ হাসান আলী ও সৈয়দ মুহম্মদ হোসাইন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত বিচার শেষ করে ৬৯ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন। তাদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, এম কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাদের মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপি এবং অন্য সবাই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ ছাড়া ৯০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত কারাবন্দি যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আমির গোলাম আযম ২০১৪ সালের অক্টোবর এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা আবদুল আলীম একই বছরের আগস্টে মারা যান। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া জামায়াতের অন্যতম নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ ২৭ জন কারাগারে রয়েছেন। বাকিরা বর্তমানে পলাতক। এর মধ্যে জামালপুরের দণ্ডিত ৬ জন ধরা পড়েনি আড়াই বছরেও। তাদের মধ্যে স্থানীয় আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা আশরাফ হোসেন, আবদুল মান্নান ও আবদুল বারীকে ফাঁসি এবং অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, হারুন ও আবুল হাসেমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ওই রায় ঘোষণা হয়। তবে এসব যুদ্ধাপরাধী এখনো পলাতক। গাইবান্ধার ঘোড়ামারা আজিজসহ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৫ রাজাকারই অধরা। ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাবেক এমপি জামায়াত নেতা আবু সালেহ মুহম্মদ আবদুল আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ, রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু, আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী, নাজমুল হুদা, আবদুর রহিম মিঞা ও আবদুল লতিফ রাজাকারের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়ে রায় দেন। তাদের মধ্যে লতিফ রাজাকার ছাড়া অন্য পাঁচজনই পলাতক। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যশোরের কেশবপুরের জামায়াতের সাবেক এমপি ও রাজাকার কমান্ডার সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদণ্ডে এবং অন্য ৭ রাজাকারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত। ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের আগেই শাখাওয়াত ও বিল্লাল হোসেন গ্রেপ্তার হন। তবে আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া অন্য ৬ রাজাকার এখনো অধরা। তারা হলেন মো. ইব্রাহিম হোসাইন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, এম এ আজিজ সরদার, আবদুল আজিজ সরদার, কাজী ওহিদুল ইসলাম ও মো. আবদুল খালেক। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের রাজাকার দুই সহোদরসহ চার রাজাকারকে ফাঁসির আদেশ ও এক রাজাকারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে ২০১৬ সালের ৩ মে রায় ঘোষণা করেন আদালত। তাদের মধ্যে মামলা চলাকালে রাজাকার শামসুদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করা গেলেও শামসুদ্দিনের ভাই নাসিরউদ্দিন আহমেদ এবং রাজাকার কমান্ডার গাজী আবদুল মান্নান, হাফিজ উদ্দিন ও আজহারুল ইসলাম এখনো অধরা। তাদের মধ্যে আজহারুল রাজাকারের আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অন্য চারজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। একই জেলার সদর ও নিকলী উপজেলার এক মামলায় দুই রাজাকারের বিরুদ্ধে রায় হয় ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল। ওই রায়ে দুই রাজাকার সৈয়দ মোহাম্মদ হুসাইন ও মোসলেম প্রধানকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। রায় ঘোষণার আগেই মোসলেম প্রধান গ্রেপ্তার হলেও সৈয়দ মোহাম্মদ হুসাইন এখনো অধরা। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর শরীয়তপুরের রাজাকার ইদ্রিস আলী সরদার ওরফে গাজী ইদ্রিসকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। তবে এখনো এ রাজাকারকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App