×

জাতীয়

তবু ইয়াবায় সয়লাব টেকনাফ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০২:২১ পিএম

তবু ইয়াবায় সয়লাব টেকনাফ
গত বছরের মে থেকে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৩ শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। যার মধ্যে ৩৬ জনই কক্সবাজারের টেকনাফের। এরপরও ইয়াবায় সয়লাব হয়ে আছে টেকনাফ। এখানকার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিয়তই ইয়াবার বড় বড় চালান আটক করছে র‌্যাব-পুলিশ, ডিএনসি, কোস্ট গার্ড ও বিজিবি। গত বছর এই উপজেলা থেকে ৩২ লাখ ১৩ হাজার ৫২ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ডিসেম্বর মাসেই উদ্ধার হয়েছে ৭ লাখ সাড়ে ৭ হাজার পিস ইয়াবা। এ বছরও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। গত ১২ জানুয়ারি ৪০ হাজার ও ১৩ জানুয়ারি ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেছে বিজিবি। সর্বশেষ গত বুধবার সন্ধ্যায় বরইতলী থেকে ৫ হাজার ৯১০ পিস ইয়াবাসহ এক পাচারকারীকে আটক করে র‌্যাব। আগের দিন মঙ্গলবারও কক্সবাজার বিসিক এলাকা থেকে ৪৫ হাজার ইয়াবাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। এই চালানটিও টেকনাফ হয়েই এসেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে আগের তুলনায় পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা ইয়াবা পাচার ৭০ শতাংশ কমে এসেছে বলে দাবি করে জানান, ইতোপূর্বে টেকনাফ থানায় শত শত মামলা হতো। বর্তমানে তা অনেক কমে গেছে। যদিও কেউ কেউ বলছেন, দুর্গম সীমান্ত এলাকা হওয়ায় ইয়াবার চালান পুরোপুরি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে, ক্রমশ জোরদার হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে নড়েচড়ে বসেছে টেকনাফের মাদক ব্যবসায়ীরাও। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া ও বুলডোজার দিয়ে ব্যবসায়ীদের দুর্গ গুঁড়িয়ে দেয়ায় বাঁচার পথ খুঁজছে তারা। ইতোমধ্যে বনদস্যুদের মতো আত্মসমর্পণের পরিকল্পনাও করা হয়েছে। স্থানীয়দের অনেকেই তাদের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার অনেকে বলছেন, নিজেদের প্রাণ এবং অবৈধ সম্পদ রক্ষার কৌশল হিসেবে আত্মসমর্পণের পথ বেছে নিয়েছেন তারা। যদিও আত্মসমর্পণকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ বিষয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, যদি কোনো অপরাধী আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে স্বাগত জানানো হবে। অন্যথায় যে কোনো উপায়ে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। আত্মসমর্পণ সম্পদ বাঁচানোর কৌশল কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিজি বলেন, সরকার চাইলে আত্মসমর্পণের পরেও তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। টেকনাফে ইয়াবার চালান না থামার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, টেকনাফে ইয়াবার চালান বন্ধ না হওয়ার প্রধান কারণ দুর্গম সীমান্ত। তবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভালো। আশা করা হচ্ছে, সীমান্ত সড়ক কাজ সম্পূর্ণ হলে চালান আসার পরিমাণ অনেক কমে যাবে। সূত্র জানায়, টেকনাফ উপজেলা মিয়ানমারের সঙ্গে লাগোয়া হওয়ায় পাচারকারীরা সহজেই ইয়াবা আদান-প্রদান করতে পারে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্থানীয় অনেকেই রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন রিকশাচালক, দিনমজুর, জেলে, কাঠুরিয়া, জিপচালক, হেলপারসহ (চান্দের গাড়ি) আরো অনেক পেশাজীবী। প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি করেছেন প্রাসাদোপম অট্টালিকা। তবে, মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে একের পর এক প্রাণহানি ও ইয়াবা প্রাসাদগুলোতে বুলডোজারের আঘাতের পর বাঁচার পথ খুঁজছেন তারা। এ জন্য মহেশখালী দ্বীপের জলদস্যুদের মতো আত্মসমর্পণের মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে দফায় দফায় গোপন বৈঠকে বসেন শীর্ষ ইয়াবা গডফাদাররা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মিডিয়ার মাধ্যমে জনমত তৈরি করে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলে হয়তো আত্মসমর্পণ করে অভিযান থেকে বেঁচে যেতে পারবে তারা। ইতোমধ্যে সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে আত্মসমর্পণের তালিকা প্রস্তুত করেছে তারা। ইয়াবা গডফাদারদের এভাবে আত্মসমর্পণ করার আগ্রহকে অনেকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু সচেতন মহলে নানা প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, আবার অনেকে সরাসরি তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। টেকনাফ সরকারি কলেজের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আবু তাহের ভোরের কাগজকে বলেন, আত্মসমর্পণ করে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা মূল স্রোতে ফিরে আসুক, তাতে সমস্যা নেই। তবে ইয়াবা সেবন করে দেশের যুবসমাজ যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিক তেমনি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের রাতারাতি অর্জিত অবৈধ অর্থের কারণে সামাজিক ভারসাম্য-স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। তাই জলদস্যুদের অস্ত্র সমর্পণের মতো ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অর্থ সমর্পণ অত্যন্ত জরুরি। টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গুরা মিয়া গত বুধবার তার ফেসবুকে টাইমলাইনে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ সম্পর্কে একটি লেখা পোস্ট করেছেন। যার সারমর্ম দাঁড়ায়, জলদস্যু আর ইয়াবা কারবারি এক না। কারণ জলদস্যুরা গুটি কয়েকজনকে হত্যা করেছিল। কিন্তু ইয়াবা ব্যবসায়ীরা হাজার কোটি টাকা পাচার, জমি দখল, সাধারণ মানুষকে হয়রানি, কথায় কথায় গুলি চালিয়ে এসেছে। এসবের ক্ষতিপূরণ কে দেবে। আর যারা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেল তাদেরই বা কি দোষ ছিল। কেউ ঘোষণা না দিলেও সর্বত্র চাউর হয়েছে আগামী সোমবার (২১ জানুয়ারি) আত্মসমর্পণ করবে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দাবি উঠেছে আত্মসমর্পণের আগে তাদের অবৈধ অর্থ-সম্পদ যেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নেয়া হয়। এ জন্য যুক্তি দেয়া হচ্ছে, জলদস্যুদের যেমন আত্মসমর্পণের সময় জমা নেয়া হয় আগ্নেয়াস্ত্র ঠিক তেমনি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অস্ত্র হচ্ছে তাদের অর্থ-সম্পদ। তাই তাদের বিপুল অর্থ সম্পদ আত্মসমর্পণের সময় যেন জমা নেয়া হয়। সচেতন মহলের মতে, যদি ইয়াবা ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ-সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে চায় তাহলে ধরে নিতে হবে আত্মোপলদ্ধি থেকেই তারা অনুতপ্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করে নতুন জীবনে ফিরে যেতে চাচ্ছে। আর যদি তাদের সেই অবৈধ অর্থ-সম্পদ জমা দিতে রাজি না হয়, তবে ধরে নিতে হবে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান হতে রক্ষা পেতেই তারা আত্মসমর্পণের নামে সাময়িক কৌশল গ্রহণ করেছে মাত্র। কেননা, সাগরে দস্যুতা আর ইয়াবা কারবার এক নয়। জলদস্যুতা হয় দৃশ্যমান আর ইয়াবা কারবার হয় অদৃশ্যে। আত্মসমর্পণের পর তারা পুরনো কারবারে ফিরে যাবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। কেবল সান্ত¡না এখানেই ওরা আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারিদের তালিকাভুক্ত হবে। এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেছেন, ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের জন্য কঠোর শর্ত দেয়া হবে। শর্তবিহীন আত্মসমর্পণ করে অপরাধ হতে রেহাই পাওয়ার কারো সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, যেসব ইয়াবা ডিলার ইতোমধ্যে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন; তাদের এ পদ্ধতিতে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App