×

মুক্তচিন্তা

ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হালকাভাবে নেয়ার বিষয় নয়!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩১ পিএম

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত মূলধন ঘাটতির মতো নতুন এক সমস্যার সম্মুখীন হতে চলেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় দেশে নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক আর বাকি তিনটি বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক।

আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের অনেক সমস্যার কথা শোনা গেলেও, মূলধন ঘাটতির মতো সমস্যার কথা খুব একটা শোনা যায়নি। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি অনেক বড় একটি সমস্যা। একটি ব্যাংকের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো তার মূলধন এবং সেই মূলধনেই যখন ঘাটতি দেখা দেয়, তখন এর মূল ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যায়। যে কোনো মানদণ্ডে মূলধন ঘাটতি কোনো ব্যাংকের জন্য মারাত্মক একটি সমস্যা।

আর এ সমস্যার দ্রুত সমাধান করা না গেলে সেই ব্যাংককে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নানারকম সমস্যায় পড়তে হয়। আমানতকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ব্যাপকহারে তাদের গচ্ছিত আমানত প্রত্যাহার করে নিতে পারে, যা তাৎক্ষণিকভাবে সেই ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারণ হতে পারে।

তা ছাড়া মূলধন ঘাটতি নিয়ে কোনো ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেন করতে সক্ষম হবে না। কারণ যেসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকে তাদের সঙ্গে বিদেশি কোনো ব্যাংক করসপনডেন্ট ব্যাংকিং সম্পর্ক রক্ষা করতে চাইবে না। সর্বোপরি কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দীর্ঘ হলে, সেই ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কথা।

আমাদের দেশে দেউলিয়া আইন এবং মার্জার ও এয়াকুইজিশন আইন কার্যকর না থাকায় ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতি নিয়েও দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে চলেছে। তবে সাময়িকভাবে রক্ষা পেলেও দীর্ঘ মেয়াদে সেসব ব্যাংকের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে যদি না তাদের মূলধন ঘাটতির দ্রুত সমাধান করা না হয়।

ব্যাংকের এই মূলধন ঘাটতির খবর সাধারণ মানুষের মাঝে ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে। কেননা মানুষ ভাবতে পারে যে ব্যাংকের মালিকরা হয়তো মূলধন ব্যাংক থেকে সরিয়ে ফেলেছে। অন্তত টেলিভিশনের টকশোর কিছু তথাকথিত বিজ্ঞ আলোচকদের টকশোর অনুষ্ঠানে এই বিষয় নিয়ে আলোচনার এক ভালো খোরাক হবে।

হ্যাকিঙের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ খোয়া যাওয়ার ঘটনাকে যদি সেসব আলোচকরা শত শত কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছে বলে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেলতে পারে। তাহলে এটা তো তাদের আলোচনার জন্য ভালো একটি ইস্যু হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিষয়টি মোটেই তা নয়। ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ঠিকই আছে।

সঠিকভাবে হিসাব-নিকাশ না করে ব্যাংকের প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে চলা, অতিমাত্রায় নিম্নমানের ঋণ প্রদান করা, খেলাপি ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হওয়া এবং সর্বোপরি খেলাপি ও নিম্নমানের উভয় প্রকার ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত প্রভিশন বা রিজার্ভ না রাখার কারণে ব্যাংকের সম্পদ বা ঋণের তুলনায় ন্যূনতম মূলধনের পরিমাণ কমে যায়, যাকে মূলত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বলে আখ্যায়িত করা হয়।

যদিও ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির মতো সমস্যা দূর করা মোটেই সহজ কাজ নয়, তথাপিও প্রয়োজনীয় এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারলে এ সমস্যা দূর করা অসম্ভবও নয়।

স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া প্রয়োজন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো (১) ঝুঁকিভিত্তিক ঋণের সুদের হারের প্রচলন, (২) ঋণের শ্রেণিবিভাগের সেই গতানুগতিক সিএল প্রদ্ধতির আধুনিকায়ন, (৩) ঋণের নিয়মিত মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখা, (৪) ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ঋণ পুনঃতফসিলি করার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা, (৫) ব্যাংকের মুনাফার ওপর ডিভিডেন্ড প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন আনা এবং (৬) দেশের ব্যাংক ব্যবসার ক্ষেত্রে ঋণ ক্রয়-বিক্রয় (লোন ট্রেডিং) ব্যবস্থার প্রচলন করা।

দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেহেতু আধুনিক পদ্ধতি ব্যাসেল- তিন বাস্তবায়ন করা হয়েছে তাই এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক পদ্ধতিগুলোকেও আধুনিকায়ন করতে হবে। তা নাহলে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির মতো একটি জটিল সমস্যার স্থায়ী সমাধান কখনই সম্ভব হবে না। ভুলে গেলে চলবে না যে ব্যাংকিং খাতের যত সমস্যা আছে তার চূড়ান্ত রূপ হলো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি। তাই ব্যাংকের এ সমস্যাকে মোটেই হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।

ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App