×

মুক্তচিন্তা

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৫৩ পিএম

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার করল, বলল ঐক্যের কথা, কিন্তু সে ঐক্যের ভেতরে চাপা রইল না সাম্প্রদায়িকতা এবং ক্রমান্বয়ে ঐক্যের ভৌগোলিক দিকটাকে ছাপিয়ে উঠল ধর্মের দিকটা। সে ধর্ম হিন্দু ধর্ম। রণধ্বনি উঠল ‘বন্দে মাতরম’র। ফলে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’র পাল্টা আওয়াজ ওঠার পটভূমিটা তৈরি হয়ে গেল। যে শাসকরা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠনে উৎসাহ জুগিয়েছিল তারাই আবার উৎসাহ দিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনের।

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে উপমহাদেশে এবং বাংলাদেশেও আমরা চার ধরনের চিন্তা ও দুশ্চিন্তার তৎপরতা দেখি। প্রথমটি জাতীয়তাবাদী, দ্বিতীয়টি উদারনৈতিক, তৃতীয়টি ধর্মীয় মৌলবাদী এবং চার নম্বরটি সমাজতান্ত্রিক। এদের ভেতর বিরোধ আছে, কিন্তু স্বল্প সন্ধানেই ধরা পড়বে যে, মস্ত মস্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রথম তিনটি একই ধারার এবং চতুর্থটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের।

জাতীয়তাবাদী, উদারনৈতিক ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা একে অপরের থেকে দূরেই থাকেন, মৌলবাদীরা তো অপর দুপক্ষ থেকে খুবই দূরের, কিন্তু তবু অন্তর্গতভাবে তিন ধারাই এক ধারা এই অর্থে যে তিনটিই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী। পুঁজিবাদের ভেতরের খবরটা হলো সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাস।

সমাজতন্ত্র নানা রকমের হয় বলে প্রচার করা হয়ে থাকে, কিন্তু ওই মতবাদের কেন্দ্রে আছে ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। সমাজতান্ত্রিক ধারাটি তাই অন্য তিন ধারার কেবল প্রতিপক্ষই নয়, শত্রুপক্ষও বটে। অন্যরা চায় শ্রেণি ব্যবস্থাকে কোনো না কোনোভাবে রেখে দিতে, সমাজতন্ত্রীরা চায় সেটাকে ভেঙে ফেলতে। মিলনের কোনো সুযোগই নেই।

জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রকাশ ঘটে। তবে প্রধান প্রকাশ দুই রকমের, একটি আগ্রাসনের অপরটি আত্মরক্ষার। ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশের জাতীয়তাবাদ ছিল আগ্রাসনের, লক্ষ্য ছিল লুণ্ঠন; আর যে ভারতবর্ষীয়রা ব্রিটিশকে বিতাড়িত করে স্বাধীন হতে চাইছিল তাদের জাতীয়তাবাদটা ছিল আত্মরক্ষার। পার্থক্যটা স্পষ্ট; কিন্তু মিলটা এখানে যে দুপক্ষের কোনোটিই পুঁজিবাদে অবিশ্বাসী ছিল না, শত্রু-মিত্র উভয়পক্ষই ছিল পুঁজিবাদী।

ব্রিটিশরা এসেছিল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাবে এই ইচ্ছায়, এখানে তারা ছিল আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী। আর স্বাধীনতার জন্য যে জাতীয়তাবাদীরা লড়ছিলেন তারা চাইছিলেন দেশের সম্পদ দেশে রাখবেন। তবে সে সম্পদ যে সবার সমান অধিকারে থাকবে তা নয়।

তাদের দ্বারা যে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হবে তাতে শ্রেণিব্যবস্থা অক্ষুণ্ন থাকবে; যার অর্থ হলো যারা ধনী তারা সুযোগ পাবে আরো ধনী হওয়ার, আর যারা দরিদ্র তারা যদি দরিদ্রতর হতে থাকে তবে সেটা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ চলবে, তবে ব্যবস্থাটাকে ভাঙা চলবে না। মূল লড়াইটা আসলে ছিল দখলদার বিদেশি পুঁজিবাদীদের সঙ্গে উঠতি দেশি পুঁজিপন্থিদের।

দেশীয় জাতীয়তাবাদীদের ভেতরে সশস্ত্র বিপ্লবীরা ছিলেন। বিপ্লবী তারা এই অর্থে যে অহিংস নন, সশস্ত্র; নইলে অহিংস গান্ধীবাদীদের সঙ্গে তাদের মৌলিক কোনো বিরোধ নেই। কারণ গান্ধীবাদীদের মতো তারাও ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় আস্থা রাখতেন।

গান্ধী নিজে বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন, বস্তিতে থাকতে তার অসুবিধা হতো না, কিন্তু তার কাক্সিক্ষত রামরাজ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না এমন অলুক্ষণে চিন্তাকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি। তিনি কংগ্রেসেরই নেতা। কংগ্রেসকে তিনি জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন, কিন্তু জনগণের স্বার্থে নয়।

কংগ্রেস ছিল বিত্তবানদের দল, তিনি তাদের স্বার্থই দেখতেন। শ্রমিক ও কৃষকরা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হোক এটাও তার কাম্য ছিল না। সমাজতন্ত্রীরা তখনো প্রবল হয়নি, কিন্তু ওই উঠতি সমাজতন্ত্রীরাও তাকে প্রীত করেনি, বিরক্তই করেছে।

ওদিকে সহিংস বিপ্লবীরাও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চাননি; তারা হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করতেন।  এই বিপ্লবীদের অনেকেই আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিলেন। ১৯৩৭-এ মুক্তি পেয়ে তাদের কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। এদের কথা আলাদা। বলা যায় এরা একটা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন, যে কাজটা অন্যরা করতে পারেননি।

জওহরলাল নেহেরু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, এক সময়ে তিনি প্রায় কমিউনিস্টই হয়ে যাচ্ছিলেন, হতে পারলেন না কারণ টের পেয়ে গেলেন যে কমিউনিস্টরা যথেষ্ট ভারতীয় নয়। দেখা যাচ্ছে জাতীয়তাবাদ কতটা প্রভাব ফেলেছিল তার ওপর; আর ওই জাতীয়তাবাদের কারণেই তিনি বাপুজির সঙ্গেই রয়ে গেলেন, যে বাপুজি আবার তার নিজের পাশে রাখতেন বড় শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাকেও।

কমিউনিস্টদের শ্রেণি সংগ্রাম বাপুজির অনুসারী নেহেরুর পছন্দ হওয়ার কথা নয়। নেহেরু বছরের পর বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে পেরেছেন, তাই বলে শ্রেণিচ্যুত হয়ে যাবেন এবং সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে লড়বেন এমনটা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তার রাজনীতি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরই। তার শাসনামলে কমিউনিস্টরা যে সুবিধায় ছিল তা নয়, খুব অসুবিধাতেই ছিল।

স্বাধীনতার প্রশ্নে নেহেরুর তুলনায় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন অনেক বেশি অনমনীয়। গান্ধীর নেতৃত্বকে আপসকামী মনে করে সেটাকে পরিত্যাগ করে তিনি চলে গিয়েছিলেন সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ঘটানোর পথে। সুভাষ বসু সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতেন এবং ভারতবর্ষের সমস্যার পথ যে সমাজতান্ত্রিক সেটাও মানতেন।

কিন্তু তিনিও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন; নেহেরুর চেয়ে কম নয় বরং বেশিই। তাই দেখি তিনি কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ছেন ঠিকই, কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেসের ভেতরই থেকে যাচ্ছে। গান্ধীকে ‘জাতির পিতা’ উপাধি তারই দেয়া। সে জন্য এটা অস্বাভাবিক ছিল না যে সমাজতন্ত্রকে তিনি ভারতবর্ষীয় রূপ দিতে চাইবেন।

তার মতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ‘সমাজতান্ত্রিক’ পথটাই ছিল সঠিক, মার্কস-এঙ্গেলসের পথের তুলনায়। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র থাকবে আবার ব্যক্তিমালিকানারও অবসান ঘটবে না। মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের যে বিরোধ অনিবার্য ছিল সেখানে তার প্রবণতা মালিকের দিকেই ঝুঁকার। ঝুঁকেছেন যে তার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

এটির উল্লেখ আছে মণি সিংহের আত্মজীবনীতে। ১৯২৮ সালের কথা। মণি সিংহ তখনো কমিউনিস্ট হননি, তবে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। কলকাতার উপকণ্ঠে মেটিয়াবুরুজে বিড়লাদের পাটকলে শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছে। পুলিশ এবং মালিকের পোষাবাহিনীর যৌথ আক্রমণে শ্রমিকরা বিধ্বস্ত।

এরই মধ্যে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের এক সভা ডেকেছে; বিড়লারা যে মহৎ, তারা যে শ্রমিকের বাবা-মা এসব কথা বলার জন্য। মণি সিং তখন যুবক, বয়স ২৮; তিনি ধর্মঘটী শ্রমিকদের সঙ্গে ছিলেন। শোনা গেল মালিক পক্ষের সভাতে সুভাষ বসু আসবেন, ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বলার জন্য।

শুনে মণি সিংহ ঘাবড়ে গেছেন। শ্রমিকরা তাকে সাহস দিয়েছে, বলেছে আপনাকে কিছু করতে হবে না, সুভাষ বসুর বক্তব্যের পর দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের মত কি তা জানতে চাইবেন। সুভাষ বসু ঠিকই এসেছিলেন। ধর্মঘট তুলে নেয়ার পক্ষেই বলেছেন তিনি। শ্রমিকরা শুনেছে। শুনে চুপ হয়ে গেছে। শ্রমিক নেতারা চায়ের দোকান থেকে একটা টুল নিয়ে এসেছিল।

মণি সিংহ সেটার ওপরে দাঁড়িয়ে তার জীবনে প্রথম এবং সংক্ষিপ্ততম বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। ধর্মঘটের পক্ষে শ্রমিকদের শিখিয়ে দেয়া কথা কয়টিই শুধু বলেছিলেন। তাতেই কাজ হয়েছে। স্তব্ধতা ভেঙে শ্রমিকরা চিৎকার করে বলে উঠেছে, ‘হরতাল চালু রহেগা।’ সভা প- হয়ে গেছে। হরতাল চালু থেকেছে। বিড়লারা সমঝোতায় এসেছেন।

সুভাষ বসু পুরোপুরি বাঙালি ছিলেন। রাজনীতিতে তার প্রবেশ চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে। চিত্তরঞ্জনের চেষ্টা ছিল বাংলার রাজনীতিকে ভারতীয় রাজনীতি থেকে পৃথক রাখার; চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু অকাল মৃত্যুর দরুন কাজটা খুব একটা এগুতে পারেনি।

বাংলার রাজনীতি যদি ভারতের রাজনীতি থেকে আলাদা থাকতে পারত তাহলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্য অবশ্যই সুবিধা হতো এবং কংগ্রেস যে এক জাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িকতাকে পুষ্ট করার কাজটা করছিল সে কাজে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটত।

সুভাষ বসুর বাঙালিত্ব কিন্তু বাংলার রাজনীতিকে সর্বভারতীয় রাজনীতির আওতামুক্ত করার কাজে উৎসাহের সঞ্চার করতে পারেনি, তিনি রয়ে গেছেন ভারতীয় রাজনীতিতেই। ১৯৪৬-৪৭-এ তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শরৎচন্দ্র বসু সর্বভারতীয় ওই রাজনীতি যে বাংলাকে খন্ডিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল সেটা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছেন।

বাংলার অখ-তা রক্ষার জন্য তিনি আবুল হাশিম ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্ত উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাজটাতে সুভাষ বসু সময়মতো যদি হাত দিতেন তবে সেটা উপমহাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো বলেই আমাদের ধারণা।

পরাধীন ভারতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা যে জাতীয়তাবাদী রূপ নেবে সেটা ছিল অনিবার্য; তবে জনগণের মুক্তির আন্দোলন শক্তিশালী হতো যদি তাতে সমাজতান্ত্রিক উপাদান কার্যকর থাকত। কিন্তু জাতীয়তাবাদী সংগ্রামটা সংগঠিত রূপে শুরুই হয়েছিল সমাজবিপ্লবের সম্ভাবনাকে ঠেকানোর জন্য।

ওই সূচনাটা ঘটে ১৮৮৫-তে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। উদ্যোগটা এসেছিল একজন ব্রিটিশ আইসিএস অফিসারের দিক থেকে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন উঠতি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিরা। ব্রিটিশ শাসকরা খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ১৮৫৭-এর সিপাহি অভ্যুত্থান দেখে।

তাদের দুশ্চিন্তা ছিল যে পরবর্তী কোনো অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যদি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুক্ত হয়ে যায় তবে ফরাসি বিপ্লবের মতো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে। মধ্যবিত্তকে তারা তাই কাছে টেনে নিতে চেয়েছে, মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিতে চেয়েছে অভাব-অভিযোগের দরখাস্ত নিয়ে হাজির হতে।

বলাবাহুল্য শ্রেণিগত কারণেই এই মধ্যবিত্ত উপরের দিকে উঠতে চেয়েছে, তারা ভীষণ ভয় পেয়েছে নিচের দিকে নামতে। তারা ইংরেজকে ভয় করত, কিন্তু আতঙ্কিত হতো সমাজবিপ্লবের আশঙ্কায়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাকে প্রধান রাজনৈতিক সত্য করে তুলল।

বলাবাহুল্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা জাতিগত ছিল না, ছিল শ্রেণিগত; কৃষক শোষিত হচ্ছিল জমিদার ও মহাজনের হাতে, শ্রমিকদের শোষক ছিল পুঁজির মালিকরা; কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শ্রেণিবাস্তবতাকে আড়ালে ঠেলে দিয়ে জাতীয় ঐক্যকে প্রধান করে তোলে; ‘আমরা সবাই ভাই ভাই’ আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায় ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁইয়ের নিষ্ঠুর বাস্তবতা।

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার করল, বলল ঐক্যের কথা, কিন্তু সে ঐক্যের ভেতরে চাপা রইল না সাম্প্রদায়িকতা এবং ক্রমান্বয়ে ঐক্যের ভৌগোলিক দিকটাকে ছাপিয়ে উঠল ধর্মের দিকটা। সে ধর্ম হিন্দু ধর্ম। রণধ্বনি উঠল ‘বন্দে মাতরম’র।

ফলে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’র পাল্টা আওয়াজ ওঠার পটভূমিটা তৈরি হয়ে গেল। যে শাসকরা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠনে উৎসাহ জুগিয়েছিল তারাই আবার উৎসাহ দিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনের। চেষ্টা শুরু হলো সম্প্রদায়কে জাতিতে পরিণত করার। শুরুতে ভোট ছিল শতকরা মাত্র দুজনের; তারই মধ্যে বিভাজন দাঁড় করানো হলো হিন্দু মুসলমানের পৃথক নির্বাচনের।

পরিণামে কি ঘটেছে সেটা তো আমরা জানি। সমাজতন্ত্রীরা সংগঠিত হচ্ছিল, তাদের আওয়াজ ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। হিন্দু-মুসলমানকে তারা নিয়ে আসতে চেয়েছে বিপ্লবের পক্ষে, কিন্তু তাদের আওয়াজটা জোরদার হয়নি। কারণ ছিল। প্রধান কারণ জাতীয়তাবাদীদের গলার জোর। তারা বিত্তবান, নেতারা উচ্চশিক্ষিত, সংবাদপত্র তাদের পক্ষে।

ব্রিটিশ শাসকরাও তাদের উৎসাহ দিয়েছে। উঠতি জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশকে ভয় পায়, কিন্তু আরো বড় ভয় তাদের কৃষককে, কারণ জমিদারি ব্যবস্থার সুবিধাগুলো তারা ভোগ করে। তারাই আবার পেশাজীবী, ব্যবসা-বাণিজ্যও তারাই করে। এর মধ্যে কৃষক যদি ক্ষেপে ওঠে তাহলে তো সর্বনাশ।

সে জন্য শ্রেণি হিসেবে সমাজবিপ্লবের অনুমোদন তারা তো দেয়ইনি, উল্টো যতভাবে পারা যায় ওই ধরনের বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে। অন্য ব্যাপারে প্রবল শত্রুতা থাকলেও বিপ্লববিরোধিতার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ স্বার্থ আর ভারতীয় বিত্তবানদের স্বার্থ এক হয়ে গেছে; যেন বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মিলন, অভিন্ন এক শত্রুর বিরুদ্ধে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App