×

জাতীয়

সিলেট অঞ্চলের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০৪:৩৬ পিএম

সিলেট অঞ্চলের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব

আগুন পোহানোর পর্ব

সিলেট অঞ্চলের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব
সিলেট অঞ্চলের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব
সিলেট অঞ্চলের পৌষ সংক্রান্তি উৎসব
পৌষ সংক্রান্তি বাঙ্গালীর সংস্কৃতির একটি অংশ হলেও এটি বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে পালিত হয়। এটি সাধারণত জানুয়ারী মাসের ১৪ অথবা ১৫ তারিখ এবং পৌষ মাসের শেষ দিনে হয়ে থাকে। এই দিনটিকে সিলেট অঞ্চলের মানুষ একটু ভিন্নভাবে পালন করেন।
[caption id="attachment_112424" align="aligncenter" width="1920"]                            মোলভীবাজারে চলছে ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা ----ছবি- বিকুল চক্রবর্তী[/caption] মাছের মেলা : দিনটিকে সামনে রেখে একসময় সিলেটের হাওর বাওয়রে ও নদীতে মাছ শিকার করে সংক্রান্তির আগের রাত্রিতে উৎসব আমেজে আহার করা হতো। এরমধ্যে বিন্নি ভাতের সাথে সেই মাছের বিরান (ভাজা) উল্লেখযোগ্য ছিলো। কালক্রমে এই এলাকায় সকলের কাছে এই দেশীয় মাছ সহজলভ্য করার লক্ষ্যে বহুবছর পূর্ব থেকেই শুরু হয় মাছের মেলা। আর এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মেলা হয় সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে।শেরপুরে কয়েকশত বছর আগে থেকেই এ মাছের মেলা হয়ে আসছে।এই মেলাকে সামনে রেখে হাওরে পুকুরে মানুষ বড় বড় মাছ মজুদ রাখনে। মেলায় মজুদকৃত এই মাছ বিক্রিকরে আশানুরুপ অর্থও পেয়ে থাকেন মাছ চাষিরা। কালক্রমে এই মেলা শেরপুর থেকে বিস্তৃতিলাভ করে ছড়িয়ে পড়ে উপজেলা উপজেলায়। [caption id="attachment_112741" align="aligncenter" width="700"]                                                                  আগুন পোহানোর পর্ব- ছবি- বিকুল চক্রবর্তী[/caption] আগুন পোহানোর পর্ব : এই পৌষ সংক্রান্তিকে উদযাপন করতে সিলেট অঞ্চলে থাকে আগুন পোহানোর পর্ব। পৌষ সংক্রান্তির কয়েকদিন পূর্ব থেকেই সিলেটের গ্রামে গ্রামে আমন ধানের খড় কেটে এনে মজুদ করে রাথা হয়। আগের দিন রাতে ওই খড় আর কাঁচা বাঁশ দিয়ে তৈরী করা হয় ছোট মেরামেরীর(মেষ)ঘর।সেই ঘরের এক পাশে রান্না করে শিশু কিশোর ও যুবযুবতীরা ঘরে বসে খাওয়াদাওয়া করেন। অনেকে মজার মজার কিচ্ছা শুনার আসর করেন। বর্তমানে অনেকে মাইক, স্পীকার ও ডিজে পাটি করেন। পরের দিন কাক ডাকা ভোরে সবাই ঘুম থেকে উঠে স্নান করে রাতে তৈরীকরা ঘরটিতে আগুন দেন। আর স্নান শেষে সে আগুনে সবাই মিলে তাও/তাপ নেন।আগুনে তাপ নেয়ার সময় কাঁচা বাঁশের আখি যখন পুঁড়ে ফোটে তখন গুলির শব্দের মতো একটি শব্দ হয়। আর সেই শব্দ শোনামাত্র আগুনে তা নেয়া সবাই উচ্চ স্বরে উচ্ছাস প্রকাশ করেন। রয়েছে হাস্যকর বাক্য বিনিময়। তবে ভেরাভেরীর ঘর তৈরী ও আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার চিরাচরিত নিয়মগুলোর হয়তো ধর্মীয় বিশেষ কোন তাৎপর্যও রয়েছে। উত্তরায়ন সংক্রান্তি : এই দিনে হিন্দু ধর্মালম্বীরা ভগবানের কাছে নিবেদনের জন্য নতুন ধানের চাল দিয়ে (বিন্নি ধান)রাতভর তৈরী করেন হরেক রকমের পিঠাপুলি।সকাল বেলা ভগবানকে তিলচাল উৎসর্গ করে তৈরী করা পিঠাপুলি ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করেন। আর এই পিঠাপুলি খাওয়ার জন্য গ্রামবাসী একে অন্যকে আমন্ত্রনও করেন। অনেকে এই সংক্রান্তিকে তিল সংক্রান্তি ও উত্তরায়ন সংক্রান্তিও বলেন। নৃতাত্তিক জনগোষ্টীর মধ্যেও এই পৌষ সংক্রান্তিকেনিয়ে চলে নানা আয়োজন। ওই দিন রাতে তারা বাশের মধ্যে ভাত, মাছ, মাংস ও চুঙ্গা পিঠা তৈরী করে মেরামেরীর ঘরে বসে আহার করেন। নগর কীর্তন : এই দিন সিলেট বিভাগের গ্রামে গ্রামে বের হয় নগর কীর্তন। সিলেটের ভাটি এলাকায় পৌষ সংক্রান্তিতে নতুন কাপড় পড়ার রেওয়াজ রয়েছে। ওই দিন পরিবারের প্রায় সকলেই নতুন কাপড় কিনেন। বড়রা না কিনলেও ছোটদের সাধ্যমতো নতুন কাপড় কিনে দেয়া হয়। আর নতুন কাপড় পড়ে গ্রামবাসী নিজের ও জগতের মঙ্গলে অংশনেন নগর কীর্তনে। নগর কীর্তনও থাকে বৈচিত্রতায় ভরপুর। কীর্তনে কমলা, নারিকেল, নকুলদান, বাতেসা, কলা, খিড়া, কদমা ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে দেয়া হয় লুঠ।থাকে ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ কীর্তনীয় সংগীত। কীর্তন শেষে আয়োজন করা হয় মহাপ্রসাদ বিতরণের। আল্পনা : এই উৎসবকে ঘিরে সিলেটের গ্রামীণ জনপদে আনন্দ উচ্ছাসের শেষ নেই। বিশেষ করে প্রত্যেক বাড়ির আঙ্গিনা উজ্জ্বল মাটির হালকা আস্তরণ (লেপে দেয়া) দেয়া হয়।যা দেখলে মনের মধ্যে আসে অন্যরকম এক আনন্দ্। গ্রামের তরুণী ও বধুরা তাদের উঠানে চালের গুড়ি, রঙ্গিন মাঠি ও বিভিন্ন রং দিয়ে আঁকেন হরেক রকম আল্পনা। যা নিয়ে সাপ্তাহ ব্যাপী আলোচনা থাকে ভালো আল্পনার। ধর্মীয় অনুষ্ঠান : জ্যোতিশাস্ত্র অনুযায়ী পৃথিবী সুর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশকে সংক্রান্তি বলে। এটি একিটি সংস্কৃত শব্দ।যার অর্থ ক্ষন বা বিশেষ মুহুর্ত। বিভিন্ন সুত্র থেকে জানাযায়, প্রতিবছর পৃথিবী সুর্যের চার দিকে একবার পরিভ্রমন করার সময় মোট ১২বার সূর্যের রাশি পরিবর্তন করে। এই পরিবর্তনের বিশেষ মুহুর্তকে ক্ষন বা সংক্রান্তি বলে। আর ১২ মাসেই ১২টা সংক্রান্তিকে ১২টি নামে আখ্যায়িত করে সনাতন ধর্মালম্বীরা আয়োজন করেন নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি। পৌষ সংক্রান্তির মতো আরো ১১টা সংক্রান্তিতেও আয়োজন রয়েছে এমন অনেক অনুষ্ঠানমালার। সংক্ষেপে বলা যায় প্রত্যেকটি সংক্রান্তি বা ক্ষন হলো বাংলামাসের শেষ দিন। পৌষ মেলা : জানাযায়, দেশে দেশে বিভিন্ন নামে পালিত হয় পৌষ সংক্রান্তি। এর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ভারতে পৌষসংক্রান্তি নামেই পালিত হয়। নেপালে এটা পরিচিত মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি-মা-লাও, মিয়ানমারে থিং-ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে পরিচিত। বিভিন্ন জায়গায় বসে মেলা। এই মেলাকে অনেকে পৌষ মেলাও বলে থাকেন। প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। তবে সুস্পষ্টভাবে এর কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারনা করা হচ্ছে এটি হাজার বছরের পুরনো ঐত্যয্যবাহী উৎসব । পুরাণেও এর উল্লেখ আছে। পুরাণ অনুযায়ী, মকর সংক্রান্তির এই মহাতিথিতেই মহাভারতের প্রধান চরিত্র পান্ডবদের পিতামহ ভীস্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। আবার অন্য মত অনুযায়ী, এই দিনই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। দেবতারা বিজয়ী হয়েছিলেন। বিষ্ণুদেব অসুরদের বধ করে তাঁদের কাটা মুন্ডু মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলেন, তাই মকরসংক্রান্তির দিনই সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাস হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সব কারণেই হয়তো আজও বিশেষ এই দিনটিকে দেশে দেশে মানুষ নানাভাবে পালন করে আসছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App