×

মুক্তচিন্তা

বই উৎসবের বাস্তবতা ও আমাদের করণীয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:৪৫ পিএম

বই উৎসবের বাস্তবতা ও আমাদের করণীয়
বই উৎসবের বাস্তবতা ও আমাদের করণীয়

৪০ লাখ শিক্ষার্থী প্রথম দিনে বই না পেলেও নতুন বই প্রাপ্তির আনন্দ থেকে শেষমেশ তারা বঞ্চিত হয় না। কিছুদিন পরই তারা তাদের নির্ধারিত শ্রেণির বই পেয়ে যায়। তবে পয়লা দিনে তাদের মনে থেকে যায় নতুন ক্লাসে প্রমোশন না পাওয়ার ও নতুন বই হাতে না পাওয়ার দুটি কষ্ট। সেদিন এই বিজিতদের হাতে হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে উৎসবের আনন্দে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কোনো উপায় এখনো বিদ্যমান নেই।

দেশের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেয়া শেখ হাসিনা সরকারের এক বিরাট সাফল্য। অনেক সফলতার অন্যতম এটি। সরকারি, বেসরকারি, প্রাইভেট, সাধারণ স্কুল, কেজি স্কুল, এনজিও স্কুল, মাদ্রাসা, বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, গ্রাম, শহর, উপশহর, ধনী, দরিদ্র, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই বিনামূল্যে পাচ্ছে সরকারি বই। এটিই কল্যাণ রাষ্ট্রে ধারণা। সমালোচকরা যাই বলুক, সারা বিশ্বে এটি একটি গণকল্যাণমুখী অনন্য উদাহরণ। যা গত দশ বছর ধরে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে চলমান।

বিনামূল্যের বই বিতরণের জন্য প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করা হয় বই উৎসব। সত্যিই এটি খুব আনন্দের বিষয়। কেননা এই বই উৎসব আমাদের পহেলা বৈশাখের চেয়েও অধিক সর্বজনীন উৎসব। কিন্তু এর বাস্তবতায়ও রয়েছে দুয়েকটি কষ্টের বিষয়। পর্যাপ্ত বই থাকার পরও জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে সবার হাতে হাতে বই তুলে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর কয়েকটি কারণ বিদ্যমান।

প্রথমত, যেসব শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরীক্ষায় পাস করে না, সঙ্গত কারণেই তাদের উপরের ক্লাসের বই দেয়া হয় না এবং তারা পরবর্তী সময় বিশেষ বিবেচনায় বা তদবিরে প্রমোশন পাবে এই আশায় নিচের ক্লাসের বই নিজেরাই নেয় না। প্রথম দিন বই পায় না বিধায় তারা বই উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। এ কষ্ট নিয়ে তারা প্রতিষ্ঠানেই আসে না প্রথম দিন। কেউ এলেও প্রমোশন না পাওয়ায় তাকে উপরের ক্লাসের বই দেয়া সম্ভব হয় না। এদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর শতকরা প্রায় ১০ ভাগ শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করে থাকে। বর্তমানে দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সোয়া চার কোটি। কম করে হলেও এই চার কোটি শিক্ষার্থীর ১০ ভাগ ৪০ লাখ। এই ৪০ লাখ শিক্ষার্থী প্রথম দিনে বই না পেলেও নতুন বই প্রাপ্তির আনন্দ থেকে শেষমেশ তারা বঞ্চিত হয় না। কিছুদিন পরই তারা তাদের নির্ধারিত শ্রেণির বই পেয়ে যায়।

তবে পয়লা দিনে তাদের মনে থেকে যায় নতুন ক্লাসে প্রমোশন না পাওয়ার ও নতুন বই হাতে না পাওয়ার দুটি কষ্ট। সেদিন এই বিজিতদের হাতে হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে উৎসবের আনন্দে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কোনো উপায় এখনো বিদ্যমান নেই।

দ্বিতীয়ত, নতুন বছরের সেশন চার্জ দিয়ে ভর্তি নিশ্চিত না করলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বই দিতে চায় না। কেননা বার্ষিক পরীক্ষায় যারা অতি উত্তম রেজাল্ট করে এবং যারা ফেল করে তারা উভয়েই অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং অনেকেই যায়। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এই বাস্তবতা বিদ্যমান। বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেলে এবং সেই প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক সেট বই নিলে সে বইয়ের হিসাব মিলাতে বেকায়দায় পড়তে হয় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের।

কেননা কিছুদিন পর যখন শ্রেণিভিত্তিক ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের নামের তালিকাসহ বইয়ের হিসাব চায় সরকার তখন আর উপায় থাকে না। এ ছাড়া যে শিক্ষার্থী পিইসি বা জেএসসি পাস করে সরকারি সনদ লাভ করে, সে সেই সনদ দিয়ে যে কোনো যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভর্তি হতে পারে।

এমতাবস্থায় প্রতি বছর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পিইসি ও জেএসসি পাস করে আসা লাখ লাখ শিক্ষার্থী যদি মাধ্যমিক স্তরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের আগে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি না হয় এবং যারা পাস করে না তারাও যদি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের আগে কোনো প্রতিষ্ঠানের ৫ম শ্রেণিতে পুনরায় ভর্তি না হয়; তো ১ তারিখের বই উৎসবে তাদের হাতে হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার উপায় কী? ২০১৮ সালে যাদের সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৫ জন।

অনুরূপভাবে যে লাখ লাখ শিক্ষার্থী প্রতি বছর জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা পাস করে শিক্ষা বোর্ডের সনদ লাভ করে এসএসসি পাসের মতোই স্বাধীন হয়ে যায় তারা যদি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের আগে কোনো প্রতিষ্ঠানের ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি না হয় এবং যারা পাস করে না তারাও যদি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের আগে কোনো প্রতিষ্ঠানের ৮ম শ্রেণিতে পুনরায় ভর্তি না হয়; তো তারা ১ তারিখের বই উৎসবে বই পাবে কীভাবে? ২০১৮ সালে যাদের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২৯ হাজার ২৪১ জন।

তৃতীয়ত, অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যারা আর্থিক অনটনের কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারে না। তারা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন যে, জানুয়ারি মাসে ভর্তি ও সেশন ফি বাবদ কিছু টাকা আয় হলে সামান্য বেতন-ভাতা পাবেন। তাই তারা নির্ধারিত সেশন ফি জানুয়ারি মাসের আগেই দিয়ে দিতে বলেন এবং নতুনদের ভর্তি হতে বলেন।

কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তা করেন না বিধায় শিক্ষকরা জানুয়ারির ১ তারিখে সবাইকে বই না দিয়ে ভর্তি/সেশন ফি আদায় করে দুয়েকদিন পর বই দিতে চান। কেননা শিক্ষার্থীরা নতুন বই হাতে পেয়ে গেলে দেনা পরিশোধে অভিভাবকরা চরম অনীহা দেখান। সব অভিভাবক যে অভাবের কারণে এমনটি করে থাকেন তা নয়।

একেকজন একেক রকম ক্ষমতা খাটিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টাকা না দেয়ার সুযোগ নিয়ে থাকেন এবং একাধিক সেট বইও নিয়ে থাকেন কেউ কেউ। ফলে প্রাপ্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন শিক্ষক-কর্মচারী। বইয়ের সঠিক হিসাব দিতে পারেন না শিক্ষকরা। হাতেগোনা কিছু নামিদামি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাস্তব অবস্থাই এমন।

সরকারি বই আটকে রাখার কোনো অধিকার শিক্ষকদের নেই এবং শেষমেশ তারা তা আটকে রাখেন না। উল্লিখিত তিনটি বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের বই উৎসবে কম-বেশি ৯০ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারেন না শিক্ষকরা। ফলে তারা বঞ্চিত হয় বই উৎসবের আনন্দ থেকে। তবে কয়েকদিন পরই ভর্তিকৃত সবাইকে দিয়ে দেন তাদের প্রাপ্য বই। এতে যথাযথ হয় সরকারি বইয়ের বণ্টন ও রোধ হয় সরকারি সম্পত্তির অপচয়।

তা না হলে বিনামূল্যে সরকারি বই নিয়ে সের দরে বিক্রি করবে লাখ লাখ ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। যার হার প্রাথমিক স্তরে প্রায় ২০% এবং মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৪০%। আর এ কারণেই নির্ধারিত শ্রেণিতে ভর্তি নিশ্চিত না করে কাউকেই বই দেয়া উচিত নয়। ‘জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের বই উৎসবেই সবাই বই পাবে। তা না হলে শিক্ষকদের শাস্তি হবে।’ এমন অবাস্তব বক্তব্য দেয়া ও কঠোর অবস্থান নেয়ার আগে উল্লিখিত বাস্তবতাগুলো অনুধাবন করা সবারই দায়িত্ব।

শিক্ষকরাও এই সমাজেরই মানুষ। সবদিক বিবেচনায় জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে করা যেতে পারে এই বই উৎসব। অথবা ১ জানুয়ারি উদ্বোধন করে ১ সপ্তাহ হতে পারে শিক্ষার্থীদের বই বিতরণ উৎসব। তা না হলে নেয়া যেতে পারে আরো অধিক যুক্তিযুক্ত কোনো পদক্ষেপ। এককথায় সরকারি বই বতরণের ক্ষেত্রে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে আলোচিত সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে একটা সুষ্ঠু নীতিমালা থাকা এবং তা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জানা থাকা একান্ত আবশ্যক।

মো. রহমত উল্লাহ্ : লেখক এবং অধ্যক্ষ কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App