×

মুক্তচিন্তা

কেঁদেও পাবে না তারে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৫৪ পিএম

বিএনপির মহান মহান নেতাদের অনেকেই হারিয়েছেন জামানত, সেই দলের সাবেক শিক্ষক, বিখ্যাত দল বদলকারী ব্যারিস্টার। ষাটের দশকের বিখ্যাত ফুটবলারসহ অন্য আশাবাদীরা হারিয়েছেন জামানত। এখন যারা জামানত হারিয়েছেন তাদের অনেককেই নাকি নিজ মহল্লাতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা কথায় কান দিতে নেই, তবে সৈয়দ আমানত আলী, জামানত হারিয়ে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হয়ে প্রতিবেশীদের নাকি জানিয়েছেন, মাল্লারা তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছেন পুলিশকে খবর দিতে হবে, একদিন আমানত সাহেবের এমন প্রতিপত্তি ছিল, ছিল সম্মান, আজ সেই তিনি কি জানতেন না দুর্বলের কথায় কান না দেয়াই ভালো। ‘সম্মান’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

‘সম্মান গ্রহণ করা সহজ, বহন করা কঠিন।’

কবি অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন কবিগুরুর সচিব, কবিগুরুর যাবতীয় কাজকর্ম অমিয় চক্রবর্তীকেই করতে হতো। চক্রবর্তী বাবুর আগে, ডাবল আইসিএস বিশিষ্ট সাহিত্য সেবক অন্নদা শংকর রায়কে রবীন্দ্রনাথ নিজে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব হওয়ার জন্য। আইসিএস সাহেব রাজি হননি, না হওয়ার কারণটা কি, আমি জানতে চাইলে মি. রায় আমাকে জানিয়েছিলেন হুকুম দেয়ার আনন্দ একরকম, তার উপরে ব্রিটিশ রাজের চেয়ারে আসীন আমি, যদি বেঁচে থাকি সচিব একদিন হয়তো হতে পারি, আবার চাকরি ছেড়েও দিতে পারি, যদি ভালো না লাগে, আমি হুকুম শুধু বড় সাহেবদেরটাই যে পালন করি তাই নয়, লীলার হুকুমও শুনতে হয়।

আমি তখন রাজশাহীর দায়িত্বে ছিলাম, কবিগুরু সেবার পতিসরে এসেছিলেন সৌজন্যবোধের তাগিদে দেখা করতে গিয়েছিলেম, নওগাঁ মহকুমার পতিসরে কুঠিবাড়িতে, সেটি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের কোনো এ সময়। হয়তো আমার যোগ্যতার কথা বিবেচনা করে তিনি স্থির করেছিলেন, আমি যদি কবিগুরুর ব্যক্তিগত সচিব হই- অন্তত কবি নিশ্চিত থাকবেন আমাকে পেয়ে, প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে আড়েঠারে বুঝিয়ে দিয়েছিলেম, আমার চেয়ে অমিয় চক্রবর্তীকে নিলে ভালো হবে, কেননা অমিয় নিজেও একজন কবি, ও বুঝতে পারবে আপনার মনের কথাগুলো, উপরন্তু আমি তো কবিতা লিখিনে, কবিগুরু মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন বলেই আমার মনে হয়েছিল, কিন্তু আমি যে অন্যের হুকুম পালন করতে অপারগ, যেটি অমিয় পারবে সেটি আমি পারব না, চক্রবর্তীকেই নিতে হয়েছিল সচিবের দায়ভার।

কবির দেশে ভ্রমণের যাবতীয় কাজকর্ম এবং বিদেশে কখন কীভাবে যাবেন থাকবেন, হয়তো পারস্যে, রাশিয়ায়, ইউরোপের অন্যান্য দেশে, এমনকি ঢাকায় কবে আসবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন উপলক্ষে সেই দায়ভার অমিয় মহাসুখে কাঁধে তুলে নিলেও কবিতা লেখা ছাড়েননি। অমিয় চক্রবর্তীর বিখ্যাত একটি কবিতার চরণ আজ মনে পড়ল, যেন হঠাৎ করেই, “কেঁদেও পাবে না তারে” কবিতার বিষয়বস্তু অতি সাধারণ, প্রেমিকা চলে গেছেন অন্য আরেকজনের গৃহে,- সংবাদটি জানাজানি হওয়ার পরেই প্রেমিক প্রবরকে কাঁদতে দেখে, হয়তো কেউ কেউ বলেছিল, প্রেমিকা সেতো অন্যের গৃহিণী, তার জন্য ক্রন্দন করাটাই বৃথা, কিন্তু প্রেমিকের মন।...

ইতোমধ্যে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮। একাদশ জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং তার সহকর্মীরা। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন দল থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন প্রায় ১৯০০ প্রার্থী। দাঁড়াতেই পারেন, যেহেতু তাদের পা এবং অর্থ দুটোই আছে। তারচেয়ে অধিক প্রাপ্তি হবে যদি সাংসদ হতে পারি, সরকারি অথবা বিরোধী দলের- পেয়ে যাবো বিনা ট্যাক্সের কয়েক কোটি টাকার গাড়ি, সরকারি যাবতীয় সব সুযোগ-সুবিধে, এই আশায় এই মোহ থেকে মানব মনের মুক্তি নেই।

যদি সাংসদ হতে পারি, তবে আমার দলের লোকজনকেও কিছু দিয়ে যেতে হবে, কাবিখার টাকাসহ সাতপাঁচ এবং একবাক্যে একনামে চিনবে জানবে। সাংসদ এই নির্বাচনে সৈয়দ বাড়ির অমূক সৈয়দ সাংসদ হয়েছেন, গেছেন আশায়, নীলস্বপ্ন, যতই সেই সৈয়দ সাহেব দেখান না কেন, পাড়া প্রতিবেশী, এমনকি তার দলের প্রধান ব্যক্তিও জানেন, সৈয়দ এবং সৈয়দদের পিতা দুজনেই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। বাংলাদেশ বিরোধী। শুধু তাই নয়, শান্তি কমিটির পাক আর্মির সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরে। তাই পিতা-পুত্রকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছিল দীর্ঘ দিন। ১৯৭৬-৭৭-৭৮ সালের কোনো এক শুভক্ষণে পলাতকরা পদধূলি দিলেন, হারানো পূর্ব পাকিস্তানের, বাংলাদেশ নামের দেশটিতে।

কেউ কেউ ফিরে এলেন- পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্য হয়ে এই দেশে। এখানে পা রাখলেন কেউ কেউ পিতা-মাতার অসুখের ছল করে, কেউ এলেন পাকিস্তানি পাসপোর্ট হাতে মাতার অসুস্থতার কথা বলে, কেননা মধ্যপ্রাচ্যের রাজা বাদশারা নির্দেশ দিয়েছিলেন, যিনি যাচ্ছেন তিনি গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধার করবেন, আবার দুই পাকিস্তান এক হবে। ঘরে ঘরে শোনা যাবে জিন্দাবাদ। সেই সব স্বপ্নবিলাসীদের অনেকেই গত হয়েছেন এবং যারা এখনো বেঁচেবর্তে আছেন তাদেরই কেউ কেউ শুধু স্বপ্ন দেখেছেন যেন ২০১৮, ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মাননীয় সাংসদ হতে পারি। কিন্তু তারা ভাবেননি- তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে, লোকজন তাদের দিকে করুণার দৃষ্টি ছুড়ে দেবেন।

গত ৩ জানুয়ারি অনেকগুলো জাতীয় পত্রিকায় আমার মতো হাজার হাজার পাঠক হয়তো সংবাদটি পাঠ করেছেন, লক্ষ করেছেন। তবে একটি পত্রিকার নগর সংস্করণের প্রথম পৃষ্ঠার বামদিকের প্রথম সংবাদটির শিরোনাম দিয়েছেন ‘ধানের শীষের ১৬১ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন’ প্রথম আলো। দুঃখের বিষয় ওই সব সাংসদ প্রার্থীদের কেউ দয়া করে ভোট দেননি। বিএনপি বাদে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো ও ঐক্যফ্রন্টের জনাকয়েক ধানের শীষের পক্ষে প্রার্থী হয়েছিলেন, ইতোপূর্বে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পক্ষের মাত্র ১৪ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছিলেন।

সেই জামানত হারানোর ভেতরে ছিলেন জনাকয়েক, যাদের রাজনীতিতে কোনো অবদান ছিল না বলে অনেকেই মনে করেছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে মনোনয়ন জমা দেয়ার সময় নগদ কুড়ি হাজার (২০,০০০) নির্বাচন কমিশনের অনুকূলে জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়। সংসদীয় আসনে সেই প্রার্থী যদি মোট প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের একভাগ (৮% ১) ভোট যদি প্রার্থী না পান, তাহলে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় জামানতের উক্ত কুড়ি হাজার (২০,০০০) টাকা।

বিএনপির মহান মহান নেতাদের অনেকেই হারিয়েছেন জামানত, সেই দলের সাবেক শিক্ষক, বিখ্যাত দল বদলকারী ব্যারিস্টার। ষাটের দশকের বিখ্যাত ফুটবলারসহ অন্য আশাবাদীরা হারিয়েছেন জামানত। কেউ কেউ দুটি আসন থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন, তিনি হারিয়েছেন মাত্র চল্লিশ হাজার (৪০,০০০) টাকা। হিসাবে করে দেললাম সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে ১৬১ জনের দেয়া জামানতের টাকা মাত্র ৩২,২,০০০ টাকা। সম্ভবত তারা ভোটে হেরেছেন- তাতে যতটা দুঃখ পাননি তারচেয়ে বেশি পেয়েছেন টাকা হারানোর শোক। যাকে আজ কেঁদেও পাওয়া যাবে না। এমনকি ‘কেঁদেও পাবে না তারে।’

১৯ মে শুক্রবার ২০১৭ সালের দৈনিক মানব কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় লালকালিতে যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল তার নাম ছিল ‘সারা দেশে কোন্দলে বিপর্যস্ত বিএনপি’। তৃণমূলে সংগঠন নিয়ে কোন্দলের উৎপত্তি, জনাব আমানউল্লাহ আমানের উপস্থিতিতে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার তৃণমূল পর্যায়ের, দুই গ্রুপের মারামারিতে কর্মিসভা পণ্ড হয়ে গিয়েছিল, তবে সেখানে নির্বাচনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।

মির্জা আব্বাসেরও হয়তো করার কিছুই ছিল না, অপরদিকে চট্টগ্রামেও হয়েছিল মারামারির উপদ্রব। সেই উপদ্রব হয়েছিল বিএনপির আরেক নেতা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ফোনে খালেদা জিয়াকে বলতে শোনা গেছে যে, ‘ম্যাডাম, এখানে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের নামে কোনো স্লোগান হয় না, স্লোগান দেয়া হয়েছে স্থানীয় ভাইদের নামে।’

গত ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে লালকালিতে প্রথম পৃষ্ঠায় চমকপ্রদ একটি সংবাদ। শিরোনাম, ‘ধানের শীষে রাজাকার ৩২ অপরাধী ও অভিযুক্ত বিএনপির প্রার্থী’। সংবাদটি তথ্যবহুল। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো- সেই নির্বাচনে কেন বিএনপি ধরাশায়ী হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সঙ্গে হারিয়েছেন জামানত ১৬১ জন।

এখন যারা জামানত হারিয়েছেন তাদের অনেককেই নাকি নিজ মহল্লাতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা কথায় কান দিতে নেই, তবে সৈয়দ আমানত আলী, জামানত হারিয়ে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হয়ে প্রতিবেশীদের নাকি জানিয়েছেন, মাল্লারা তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছেন পুলিশকে খবর দিতে হবে, একদিন আমানত সাহেবের এমন প্রতিপত্তি ছিল, ছিল সম্মান, আজ সেই তিনি কি জানতেন না দুর্বলের কথায় কান না দেয়াই ভালো। ‘সম্মান’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ‘সম্মান গ্রহণ করা সহজ, বহন করা কঠিন।’

মাকিদ হায়দার : কবি ও প্রাবন্ধিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App