×

জাতীয়

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:৪৮ পিএম

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কি

প্রতীকী ছবি

বছরের শুরুতেই বেপরোয়া বাসের চাপায় প্রাণ গেল দুই পোশাক কন্যার। যার জের ধরে বেশ কয়েকটি যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধরা। যান চলাচল বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টা। নির্বাচনের পর এটিই প্রথম কোনো অরাজনৈতিক ইস্যু, যা নিয়ে রাজপথে বিক্ষোভ হলো। গত মঙ্গলবার রাজধানীর রামপুরার ঘটনা এটি। শুধু এ ঘটনা নয়, দীর্ঘদিন ধরে পরিবহন খাতে চলে আসা নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রায়ই রাস্তায় নেমে আসছেন সাধারণ মানুষ। কিছুদিন আগে যা চরম আকার ধারণ করেছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আবারো এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যে কোনো সময়। তাই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পরিবহন খাত নিয়ে সরকারের বেশিরভাগ পরিকল্পনাই এর আগে ভেস্তে যেতে দেখা গেছে। ফলে যতই দিন গেছে, ততই বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট কিংবা দুর্নীতি অনিয়মের হার। এখন শুধু ঢাকার রাজপথই নয়, দেশের অনেক জেলা শহরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের খবর পাওয়া যায়। ঈদ বা বিশেষ সময়ে মহাসড়কে ১০-২০ কিলোমিটার জুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ সারি অনেকটা গা-সহা হয়ে গেছে। গত বছর বিশ^ব্যাংকের ‘টুওয়ার্ডস গ্রেট ঢাকা’ নামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীতে এখন যন্ত্রচালিত গাড়ির গড় গতি ৭ কিলোমিটার, যা হাঁটার গতির চেয়ে সামান্য বেশি। প্রতিদিন শুধু ঢাকায় যানজটের কারণে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান বলেন, এ দেশে সড়ক নিরাপত্তার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বেশ কয়েকটি বিষয় মারাত্মকভাবে জেঁকে বসেছে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো, পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকদের সিন্ডিকেট। এরাই আবার রাজনীতির সঙ্গে প্রবলভাবে জড়িত। ফলে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের চেয়ে কে কোন রুট, স্ট্যান্ড বা টার্মিনাল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, কোন প্রতিষ্ঠানের গাড়িকে রাস্তায় চলতে দেয়া হবে এসব বিষয় প্রাধান্য পায় তাদের কাছে। এ কাজের জন্য দলবল পোষার খরচ আসে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে। নতুন সরকারের পক্ষে আদৌ এ সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। বিআরটিএর গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬২০টি। অথচ লাইসেন্সধারী চালক আছেন ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ জন। যার অর্থ দাঁড়ায় দেশের ১৬ লাখেরও বেশি চালকের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্সই নেই। আর দেশে বিআরটিএর নিবন্ধিত ড্রাইভিং স্কুল রয়েছে মাত্র ১২৩টি। প্রশিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৭৯ জন। ফলে দেশে কত বছরে সত্যিকার প্রশিক্ষিত চালক তৈরি সম্ভব, এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া মুশকিল। যাদের লাইসেন্স আছে তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশিরভাগ চালকই বিআরটিএ অফিসে দালালদের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়েছেন। যানবাহন চালানোর কোনো নিয়মকানুন নিয়েও পড়াশোনা করতে হয়নি তাদের। প্রয়োজন হয়নি কোনো প্রশিক্ষণেরও। এ কারণে সড়কে যানবাহন চালনার সাধারণ নিয়মগুলোও প্রতিপালন করতে দেখা যায় না অধিকাংশ চালককেই। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, যেখানে সেখানে থেমে যাত্রী তোলা, উল্টো পথে যানবাহন, অনিয়ন্ত্রিত রিকশা, ইজিবাইক প্রভৃতি কারণে সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে। চালকদের এ মানসিকতার পরিবর্তন আসবে কীভাবে সংশ্লিষ্টদের কাছে এর সদুত্তর নেই। এদিকে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের অদক্ষতার বিষয়টিও প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। পুলিশের সঙ্গে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের বিশেষ সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শাহীন খান বলেন, বছরে শত শত কোটি টাকার চাঁদা পুলিশ, মালিক ও শ্রমিকসহ বিভিন্ন পক্ষে ভাগাভাগি হয়। ফলে নির্দিষ্ট পরিবহনগুলোর অনিয়মের বিরুদ্ধে খুব একটা ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না পুলিশকে। আর ব্যক্তিগত, বিশেষ করে পণ্যবাহী বা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত যানবাহনের বিরুদ্ধে ঠুনকো অজুহাতেও মামলা দিতে দেখা যায়। পাশাপাশি বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে। যানবাহনের নিবন্ধন, ফিটনেস, রুটপারমিটসহ কাগজপত্র দেয়ার জন্যও সঠিক ও বৈজ্ঞানিক উপায় অনুসরণ করা খুব জরুরি। নতুন সরকারের জন্য এসব সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন তিনি। গত বছরের ২৯ আগস্ট বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিমের নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে এবং নিজেরাই চালকের লাইসেন্স পরীক্ষাসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে। ওই সময় নিয়ম না মেনে যানবাহন চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন মন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশসহ অনেকেই। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। কিন্তু সরকারের শেষ সময়ের ওই সিদ্ধান্তগুলোর বেশিরভাগই অবাস্তবায়িত থেকে যায়। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল চলাচলের সময় সব গণপরিবহনের দরজা বন্ধ রাখা, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া যাত্রী উঠানামা বন্ধ করা, বাসের ভেতর চালক ও হেলপারের ছবিসহ পরিচয় ও ফোন নম্বর টানানো, সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা, স্বয়ংক্রিয় ও রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করা প্রভৃতি। এ ছাড়া মহাসড়ক বা দূরপাল্লার বাসে চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা, ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসের দুই পাশের ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপারের অন্য ব্যবস্থা বন্ধ করা, শহরের সব সড়কে জেব্রা ক্রসিং ও রোড সাইন দৃশ্যমান করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, অবৈধ পার্কিং ও স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্তও হয় সে সময়। নতুন মেয়াদে সরকার গঠনের পর সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করার ওপর নির্ভর করছে সড়ক শৃঙ্খলা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App