×

মুক্তচিন্তা

এখন টার্গেট অর্জনই মুখ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৪৪ পিএম

বর্তমান সরকারের কাছে জনতার প্রত্যাশা অনেক। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, সরকারকে প্রথম গুরুত্ব দেয়া উচিত ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। আমাদের প্রবৃদ্ধির পরিমাণ সম্প্রসারণ হচ্ছে, এখন দরকার এর সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ানো। তরুণ প্রজন্ম, যাদের আমরা ডেমোগ্রাফিক্যাল ডিভাইডেন্ড বলছি, তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। আর এর মাধ্যমে আমাদের টার্গেট ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের ধনী দেশ হবে। এসব টার্গেট অর্জন করার জন্য আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান করতে হবে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় জয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করেছে। সরকারের কাছে জনতার প্রত্যাশা অনেক। এদিকে বিরোধী দল ছাড়া সংসদই বা কেমন হবে? এমন অনেক বিষয়ই এখন আলোচিত হচ্ছে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে একটি বিরোধী দল কাম্য।

কেননা বিরোধী দল সরকারের বিভিন্ন বিল এবং প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে গঠনমূলক বক্তব্য প্রদান করে। যা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিরোধী দলকে গণতন্ত্রের প্রাণও বলা হয়। কিন্তু এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে সবসময় সংসদে থাকতে হবে।

অর্থাৎ সরকারের বাইরে সংসদে যে দলই থাকবে, কেবল তারা বিরোধী দল হিসেবে গণ্য হবে- এমন ধারণ সঠিক নয়। বিরোধী দল সংসদের বাইরে অবস্থান করেও ভূমিকা পালন করতে পারে। সংসদের বাইরে অবস্থান করেও তারা জোরালো ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের গঠনমূলক সমালোচনা করবে এবং গণমানুষের বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ থাকবে।

অর্থাৎ সরকারের নানা ইস্যুতে সংসদের বাইরে থেকেও তারা বক্তব্য রাখতে পারবেন। এখন কেউ যদি মনে করেন, সংখ্যা বিবেচনায় সংসদে বিরোধী দলের জোরালো অবস্থান নেই, সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি এমন ধারণা সঠিক নয়। তারা কেবল সংসদে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখতে পারবেন না, কিন্তু সংসদের বাইরে তারা ঠিকই বক্তব্য রাখবেন।

অতীতে আমরা দেখেছি, খুব কম সংখ্যক সংসদ সদস্য নিয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যায়। দুই থেকে তিনজন সংসদ সদস্য নিয়েও বিরোধী দল অতীতে দেখা গেছে। যেমন- বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি একাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন।

অতীতে আমরা দেখেছি, অনেক বড় বিরোধী দল যাদের সংসদ সদস্য সংখ্যা শতাধিক, তারা জাতীয় সংসদে যাননি এবং কথা বলেননি। অনেক সংখ্যক সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দল অনবরত সংসদ বর্জন করেছে- এমন নজিরও রয়েছে। কাজেই বিরোধী দলকে সবসময় সংসদে থাকতে হবে- এমন কোনো কারণ নেই।

বর্তমানে নতুন মন্ত্রিসভা অবশ্যই সংসদীয় রীতি অনুযায়ী গঠন করা হয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে প্রতীয়মান হবে, সেই দলের প্রধান সংসদীয় নেতা হবেন। রাষ্ট্রপতি দল প্রধানকে সরকার গঠন করার জন্য অহ্বান জানান।

এ হিসেবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে সংসদীয় দল নেতা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভায় শেখ হাসিনাকে নেতা নির্বাচন করা হয়। রাষ্ট্রপতি তাকেই সংসদীয় সরকার গঠন করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তারণ্যনির্ভর মন্ত্রীসভা গঠন হল। এখন প্রশ্ন হলো মন্ত্রিসভার গুণগত বিষয়গুলো কী হবে? অথবা এ ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যাশা কী? মন্ত্রিসভার এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করছে।

তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞার আলোকে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। যেখানে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে। কাজ করার দক্ষতা, কার্যকারিতা এবং যোগ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, এগুলোর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উদ্ভাবনী ক্ষমতা।

যারা নতুন চিন্তা করেন, সৃজনশীল নেতাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিনিয়র ব্যক্তির এবং অভিজ্ঞতার অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। মন্ত্রিসভা যেন আমলাতন্ত্র নির্ভরশীল না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমলারা যা বলবেন, সেই অনুযায়ী মন্ত্রী কাজ করবেন, তা যেন না হয়।

বরং মন্ত্রী তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় জনতার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে দূরদৃষ্টি নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন পূরণে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন, তা যেন বাস্তবায়িত হয়, সে ক্ষেত্রে নতুন যারা মন্ত্রী হয়েছেন, তাদের নতুন চিন্তা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন হবে আশা করছি।

বর্তমান সরকারের কাছে জনতার প্রত্যাশা অনেক। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, সরকারকে প্রথম গুরুত্ব দেয়া উচিত ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। আমাদের প্রবৃদ্ধির পরিমাণ সম্প্রসারণ হচ্ছে, এখন দরকার এর সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ানো। তরুণ প্রজন্ম, যাদের আমরা ডেমোগ্রাফিক্যাল ডিভাইডেন্ড বলছি, তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে।

আর এর মাধ্যমে আমাদের টার্গেট ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের ধনী দেশ হবে। এসব টার্গেট অর্জন করার জন্য আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান করতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দেশে প্রচুর লোক বেকার। তারা কাজ পাচ্ছে না।

আরেক দিকে আমাদের দেশের কাজ করার জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর লোক নিয়ে আসতে হচ্ছে। দেশে এখন কয়েক লাখ বিদেশি দক্ষ লোক কাজ করছেন। আমাদের যারা মেধাবী তরুণ, তাদের জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু দক্ষতার বড় অভাব। অর্থাৎ তারা কাজটি সঠিকভাবে করার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

তাত্ত্বিকভাবে তারা খুব ভালো করবে। কিন্তু ব্যবহারিকভাবে কাজ করার জন্য তাদের যে দক্ষতার দরকার ছিল, সেই শিক্ষা আমাদের তরুণরা পায়নি। সেই আমাদের কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব কাজ তরুণরা করবে, সেসব কাজের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

এ জন্য অবিলম্বে আমাদের কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে শিক্ষার মানগত প্রসারতাও করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় থাকার পরও আমাদের যে পরিমাণে দক্ষতার উন্নয়ন করা দরকার, তা হয়নি। সে জন্য কারিগরি, প্রকৌশল প্রশিক্ষণের দিকে আমাদের যেতে হবে।

আশা করি আগামী ৫ বছরের মধ্যে কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ নিশ্চিত হবে। দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স দেখানোর পরও দুর্নীতি শেষ হবে না। বরং দুর্নীতি কিছু থেকেই যাবে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যখন উন্নয়নশীল ধারায় থাকে, তখন রাষ্ট্র কতকগুলো স্তর অতিক্রম করে, তার একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে দুর্নীতি।

যতটা সম্ভব দুর্নীতি মিনিমাম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আগামী ১০০ দিনের মধ্যে সরকারকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে বিষয় দৃশ্যমান করতে হবে, তা হলো দুর্নীতি কোনোভাবেই প্রশ্রয় না দেয়া। আর এর চাইতেও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দুর্নীতি করে মানুষ যেসব টাকা উপার্জন করেছে, তা যেন বিদেশে যেতে না পারে।

আমাদের সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতিবাজরা টাকা বিদেশ পাচার করে। দুর্নীতি করেও অর্থ যদি দেশে রাখত, ব্যাংকে কিংবা বিনিয়োগ করত তাহলে সুফল পাওয়া যেত। কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতের টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। কিন্তু দুর্নীতি টাকা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিভিন্ন কায়দায় মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে পাচার করে।

বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ট্যাক্স নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের দুর্নীতির ক্ষেত্র জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। আর একটি সমস্যা হচ্ছে, যে হারে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, গড় আয়ু বাড়ছে, কিন্তু সে হারে ধনী-দরিদ্রের সমতা বাড়ছে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম একটি দিক ধনী দরিদ্রের মধ্যে সমতা আনয়ন। বাংলাদেশ একটি সাম্যের দেশ হবে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার অবশ্যই শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, সামাজিক নিরাপত্তার যে নেটওয়ার্ক আছে, তা আরো জোরালো করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন, কোনো মানুষ গৃহহারা থাকবে না, না খেয়ে থাকবে না, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে না। তার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় আরো জোরালো করতে হবে। এ জন্য অর্থের সংস্থানের লক্ষ্যে সবাইকে ট্যাক্সের নেটওয়ার্কে আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৩০ লাখ মানুষের টিন নম্বর আছে। তার চেয়েও দুঃখজনক ২০ লাখের কম মানুষ ট্যাক্স দেয়। এমনটি হতেই পারে না। আমাদের দেশে সব করযোগ্য লোককে করের আওতায় নিয়ে আসতেই হবে।

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App