×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতি, নির্বাচন অতঃপর সংসদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:০৭ পিএম

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনটি একটি বড় সুযোগ হয়ে এসেছে আওয়ামী লীগের হাতে। আওয়ামী লীগের নেত্রী ঘর গোছানোর নামে রাজনীতির চেহারাটাই বদলে দিতে পারেন। শুধু এমপি হওয়ার রাজনীতি থেকে সবাইকে বের করে আনার সুযোগ এসেছে তার হাতে। কেননা তিনিই এখন বৃহত্তম রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের অবিসংবাদিত নেত্রী। তিনিই পারেন রাজনীতিকে আবার বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির কাছে নিয়ে যেতে।

৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে সম্পন্ন হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগের পক্ষে আকাশচুম্বী জয় ছিনিয়ে নিয়ে এলেন সুযোগ্য সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তার কারিশমা, রাজনৈতিক দক্ষতা, কৌশল সবকিছু সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সাধুবাদ জানাই তাকে এবং তার দলকে।

নির্বাচন নিয়ে, নির্বাচন কমিশন নিয়ে এবং রাজনৈতিক দলের আচরণ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই বাংলাদেশে। প্রতিদিনই নতুন নতুন বিতর্কের সূচনা হচ্ছে। সেই বিতর্কে আজ আমি যাচ্ছি না। ওটা না হয় চলতে থাকুক ওভাবেই। আমি বরং সংসদ, নির্বাচন এবং রাজনীতি এই তিনটি বিষয় নিয়ে বাস্তবতার নিরীক্ষে নতুন একটি উপাখ্যান বর্ণনার চেষ্টা করছি।

মূল বিষয় শুরুর আগে আমি কিছু তথ্য তুলে ধরি। তাহলে আমার আসল সারমর্ম বুঝতে হয়তো পাঠক কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোট নমিনেশন পেপার বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ২৩টি, বিএনপির বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৫৮০টি, জাতীয় পার্টির ২ হাজার ৮৬৫টি, গণফোরামের ৩৫০টি, জেএসডির ৫৪৭টি, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের ৬০টি এবং আরো কিছু ছোট দলের কিছু কিছু। এর বাইরে ছিল ইসলামিক দলগুলোর অনেক আগ্রহী প্রার্থী।

বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের আসন সংখ্যা ৩০০। সেই হিসেবে মোটামুটিভাবে গড়ে প্রতিটি আসনের জন্য ৩০-৪০ জন ব্যক্তি ইচ্ছুক ছিলেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের গড় ছিল ১৩ জন এবং বিএনপির ছিল ১৫ জন। এবারের নির্বাচনে বড় দল থেকে কোনো কোনো আসনে ২০ জনেরও বেশি ইচ্ছুক প্রার্থী ছিলেন।

এদের মধ্যে আবার অনেকেই ছিলেন যারা কখনো রাজনীতি করেননি। রাজনীতির মাঠে নির্বাচন একটি অমোঘ হিসাব গণতন্ত্রের চর্চায়। নীতিগতভাবে সেখানে সবার আগে আসার কথা রাজনীতি, তারপর নির্বাচন এবং তারপর আসবে সংসদ। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনীতির এমন সরল হিসাবের বাতাস বইছে না অনেকদিন ধরেই।

এখানে সবার ওপরে উঠে পড়ে নির্বাচন। অর্থাৎ সবার আগে চলে যায় নির্বাচন। তার আগে রাজনীতির চর্চা খুব একটা চোখে পড়ে না। ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের মূল দৃষ্টি থাকে ক্ষমতা আর আর্থিক সুবিধায়। বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে থাকে অপেক্ষার পালা- কবে শেষ হবে বর্তমান সরকারের মেয়াদ।

তারপর হুট করে আসে নির্বাচন। নির্বাচনের আগে নতুন নতুন মুখ। বিশেষ করে নতুন মুখগুলো ভাগ হয়ে আসে বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে। ব্যবসা করে একটু বেশি অর্থ হাতে এলেই হঠাৎ যেন খায়েশ জাগে নির্বাচন করার। এই দলে সাবেক আমলা, সাবেক স্টার, গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, শিল্পী সবাই যোগ দেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে যান।

রাজনীতির মাঠে হাঁটাহাঁটি করা দুয়েকটি মুখ আস্তে করে তখন লুকিয়ে পড়ে চোরাবালির ঢিবিতে। অরাজনৈতিক শক্তিধরদের দাপটে নতুন করে রাজনীতির মাঠ হয়ে পড়ে সরগরম। এদের ভিড়ের মধ্যে দুই পা উঁচিয়ে রেখেও প্রকৃত রাজনীতিবিদ যে ক’জন থাকেন, তারা ভিড়ের মধ্যে তাদের মুখ উঁচিয়ে দেখাতে সক্ষম হন না সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে।

ফলে সিদ্ধান্ত হয় একতরফা। তৃণমূলের কোনো আবেদনই পৌঁছে না কর্তৃপক্ষের কর্ণকুহরে। কাজেই এসে যায় ভারী ভারী মুখ, নতুন মুখ, পয়সাওয়ালা মুখ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেখানে সবই থাকে, থাকে না শুধু রাজনৈতিক মুখগুলো। সংশ্লিষ্ট লোকগুলো ধরেই নেন যে, রাজনীতির মাঠে হাঁটতে হলে সবার আগে যেতে হবে সংসদে সাংসদ হিসেবে।

ব্যবসা বড় করার জন্য, অনায়াসে অধিক অর্থ হাতে পাওয়ার জন্য, ব্যবসায়িক জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, সমাজে ক্ষমতা দেখানোর জন্য সবচেয়ে সহজ এবং সোজা রাস্তা হলো এমপি নিযুক্ত হওয়া। কাজেই রাজনীতি বুঝুক আর না বুঝুক, এমপি তাকে হতেই হবে।

নির্বাচনের আগে তাই নানা ধরনের ধড়পাকড় শুরু হয়ে যায়। অগ্রিম লগ্নিই হোক, লবি করেই হোক, পরিচয়ের বেড়াজালেই হোক- কোনোভাবেই পিছপা হওয়া যাবে না। সোনার হরিণ ধরতেই হবে। দলের মার্কার কারণে এবং অর্থের দৌরাত্ম্যে এদের বিজয়ও ঘটে যায়। তারপর তাদের হাতে আসে সংসদ, আসে সংসদীয় অঞ্চলের রাজনীতিও।

নব্য সংসদ সদস্যের হতে চলে যায় স্থানীয় রাজনীতির চাবিকাঠি। তখন অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার সর্বত্রই চলে নতুন সংসদ সদস্যের নিজস্ব স্টাইলের রাজনীতি। আগে যে ক’জন প্রকৃত রাজনীতিবিদ টিমটিম করে টিকেছিলেন, নতুন মানুষের হাতে নেতৃত্ব আসায় তারাও এক সময় হারিয়ে যান। ফলে সর্বত্রই বিরাজ করে ক্ষমতার রাজনীতি কিংবা বিরাজনীতিকরণের নতুন পদ্ধতি।

বাংলাদেশে তাই চলছে উল্টোরথ। রাজনীতি, নির্বাচন এবং সংসদ নয়; এখানে সর্বাগ্রে আসে নির্বাচন, তারপর সংসদ এবং সবশেষে আসে রাজনীতি। এখানে যেহেতু রাজনীতির স্থান তৃতীয় স্তরে, তাই এখানে রাজনীতি প্রধান না হয়ে নির্বাচন হয়ে পড়ে প্রধান। সবাই অপেক্ষা করে নির্বাচনের আশায়।

রাজনীতি করার প্রয়োজন যেহেতু হচ্ছে না, তাই নির্বাচনের আগে রাজনীতি করার ইচ্ছা জাগে না কারো মনে। বরং এখানে রাজনীতি কেমন হবে তা নির্ভর করে সংসদ সদস্য কেমন হবে তার ওপর। আর সংসদ সদস্য কেমন হবে তা তো নির্ভর করে নির্বাচনের ওপর।

সুতরাং এখানে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজনীতি নামের অসহায় বোবা যন্ত্রটি। রাজনীতি করেন না অথবা বুঝেন না এমন অনেক লোক নির্বাচন করছেন, তারপর তিনি সংসদ সদস্য এবং সবশেষে তিনিই পরিচালনা করছেন ওই অঞ্চলের রাজনীতি এবং এ সংখ্যাটা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্বেগের জায়গাটি এখানেই।

ফলাফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। রাজনীতি তার গুণগত পরিবর্তন করতে পারছে না। উল্লিখিত আসনটিতে ২০ জন ইচ্ছুক প্রার্থীর মধ্যে ক’জন রাজনীতির মাঠে আছেন, জনগণের সঙ্গে আছেন- সে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকছেই। অন্য আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। এটি সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত যে, সংসদ সদস্যের মূল ভূমিকা সংসদে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে।

দক্ষতার প্রমাণ রাখতে তাকে তো ন্যূনতমভাবে বিল হিসেবে আগত খসড়া আইনটি পড়তে হবে, বুঝতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে। কিন্তু তিনি তা করবেন না কিংবা করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে তার যোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তিনি তো ওই আইনের ক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা দেখানোর তাড়া অনুভব করেন না। বরং তিনি স্থানীয় উন্নয়নের গতিধারা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

থোক বরাদ্দ, বিনা করে গাড়ি আমদানি, বেতনভাতা এবং ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন এমন জাতীয় কিছু এমপি সাহেবরা। কে ধার ধারে আইনের ব্যাখ্যায় কিংবা আইন কোনটা পাস হবে তা নিয়ে? সংবিধানের ৭০ ধারা তো তাদের রেহাই দিয়েই রেখেছে। যা বোঝার, যা বলার সংসদ নেতা, উপনেতা, বিরোধী নেতা, তারাই তো ওইসবের জন্য আছেন।

অন্য একটি দিক তুলে ধরছি। একজন সংসদ সদস্য আক্ষরিক অর্থেই একজন নেতাকর্মী নন। ভেবে দেখুন, একটি আসনের জন্য একটি দলের আগ্রহী প্রার্থীর সংখ্যা যদি ২০ জন হয়, তবে কি সহজেই ধরে নেয়া যায় না যে সেখানে তাদের দলের অন্তত ২০ জন নেতা আছেন? সবাই যদি নেতা হয়ে যান তবে কর্মী কোথায়? এমনিতেই আমাদের রাজনীতিতে ক্রমশ কর্মীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিষয়টি যদি গুণগতভাবে সত্যি হতো, তবে হয়তো বলার তেমন কিছু থাকত না। কিন্তু বাস্তব বিষয়টি উল্টো। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের যুগে স্বস্বীকৃত, স্বমহিমার কর্মী রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার ছড়িয়ে দিয়ে নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যান। তাই তিনিও নেতা। একদিন তিনিও ইচ্ছা প্রকাশ করেন সংসদ সদস্য হতে।

কেননা আল্টিমেট গোল সেখানেই- সংসদ সদস্য হতে হবে। একটি থানায় সংসদ সদস্য কে হতে পারেন- যোগ্যতার বিচারে সেই অনুভূতি এবং বিবেচনা যদি ব্যক্তি প্রার্থীর না থাকে তবেই বিড়ম্বনা। একটি সংসদ অঞ্চলে একটি দল থেকেই যদি ২০ জন সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি থাকেন, তবে তো সেই অঞ্চলটি রাজনৈতিক নেতার বাসস্থান।

কিন্তু বাস্তবে যদি এমনটা না হয়, যদি নেতৃত্ব নিয়ে কাড়াকাড়ি করেন যোগ্য-অযোগ্য উভয় দলই- তবে সেখানে সুযোগ থাকে রাজনৈতিক অহেতুক দলাদলির। ভুল করে যদি অযোগ্য লোকটি তার অন্য শক্তির বলে সেখানে এসে যান, তবে তার হাতে দুমড়ে মরবে সংসদ এবং রাজনীতি। ক্ষতি শুধু তখন ওই দলেরই নয়, ক্ষতি হয় রাজনীতির, ক্ষতি হয় দেশের।

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনটি একটি বড় সুযোগ হয়ে এসেছে আওয়ামী লীগের হাতে। আওয়ামী লীগের নেত্রী ঘর গোছানোর নামে রাজনীতির চেহারাটাই বদলে দিতে পারেন। শুধু এমপি হওয়ার রাজনীতি থেকে সবাইকে বের করে আনার সুযোগ এসেছে তার হাতে।

কেননা তিনিই এখন বৃহত্তম রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের অবিসংবাদিত নেত্রী। তিনিই পারেন রাজনীতিকে আবার বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির কাছে নিয়ে যেতে। তিনিই পারেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির সেই মূলমন্ত্রÑ প্রথমে রাজনীতি, তারপর নির্বাচন এবং সবশেষে সংসদ এমন ধারায় ফিরে আসতে। এমনটা হলে নির্বাচন, সংসদ তারপর রাজনীতি এমন সর্বনাশা প্রস্তুতি থেকে আমরা হয়তো একদিন বেরিয়ে আসতে পারব।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App